প্রবাসীদের আস্থার সংকট কাটাতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

ছবি : বণিক বার্তা

বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি, রিজার্ভ সংকট দূর ও এলসি খোলার সংকট সমাধানসহ বিদেশী বিনিয়োগ আরো উৎসাহিত করার লক্ষ্যেই সরকার অফশোর ব্যাংকিং আইন তৈরি করেছে। বিধিবদ্ধ আইন না থাকলেও আশির দশক থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো সীমিত পরিসরে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। নতুন আইনে এ কার্যক্রম আরো বিস্তৃত ও যুগোপযোগী করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি নয়, বরং আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই এ আইন জরুরি ছিল। 

নতুন যে বিষয়টি অফশোর ব্যাংকিং সেবায় যুক্ত হয়েছে, সেটি হলো আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব। ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী অনিবাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের মনোনীত নিবাসীর নামে অফশোর অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট নিয়ে আমাদের বেশকিছু প্রডাক্ট আগে থেকেই চালু ছিল। নতুন করে আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব নামে একটি ডিপোজিট সেবা চালু করা হয়েছে। বর্তমানে এ ব্যাংক হিসাবে মুনাফার হার বেশ ভালো। ডলারের ক্ষেত্রে যা বার্ষিক প্রায় ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।

নতুন সেবা চালুর পর থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে আমরা বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি। তবে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য একটু সময় নিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা প্রবাসীদের কাছ থেকে ব্যক্তি হিসাবে প্রায় ২ লাখ এবং বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৪৮ দশমিক ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করতে পেরেছি। অনিবাসী বাংলাদেশীদের পাশাপাশি বিদেশীরাও অফশোরের মাধ্যমে আমানত রাখতে পারেন। এ সুবিধা আগেও ছিল। কিন্তু এটা নিয়ে তেমন প্রচার ছিল না। বর্তমানে সব ব্যাংকই এটা নিয়ে জোরালোভাবে কাজ করছে। 

করপোরেট সুশাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান সামনের সারিতে। এ কারণে আমাদের ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা দৃঢ়। আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে আমানত রাখতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি। ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডা থেকেও ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। প্রচারণার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে আমরা শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের বিশাল দক্ষ কর্মীবাহিনীর ওপর আস্থা রাখছি। আমাদের কর্মীরা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রবাসীদের মধ্যে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যেই ব্যক্তি গ্রাহকদের কাছ থেকে ২০-২৫ মিলিয়ন ডলারসহ বিদেশী উৎস থেকে অন্তত ১০০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্যও শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকে আরএফসিডি নামে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব পরিচালনার সুযোগ রয়েছে। এ শ্রেণীর গ্রাহকদের কার্ড প্রদানসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়া হয়। মূলত বাংলাদেশী নাগরিকরা বিদেশ থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় সঙ্গে বহন করা অনধিক ১০ হাজার ডলার বা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা কোনো ঘোষণা ছাড়াই জমা করতে পারেন। তার চেয়ে বেশি হলে নির্ধারিত ফরমে যথাযথ ঘোষণা প্রদান সাপেক্ষে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংকে আরএফসিডি অ্যাকাউন্টে জমা করা যায়। পরবর্তী সময়ে মুনাফাসহ সমুদয় অর্থ বিদেশে পাঠানো অথবা ভ্রমণের সময় সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে আমাদের ব্যাংকের আরএফসিডি হিসাবের স্থিতি প্রায় ৪ লাখ ডলার। আগামীতে এ স্থিতি আরো বাড়বে বলে আশা করছি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নানা উদ্যোগের ফলে আরএফসিডি হিসাবের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। তবে এ হিসাবকে আরো জনপ্রিয় করতে অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে। যেমন এ হিসাবের সুবিধাগুলোর ব্যাপক প্রচার এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। বিমানবন্দরসহ যেসব পথে নাগরিকরা দেশে প্রত্যাবর্তন করেন, সেখানে লিফলেট বিতরণ, ব্যাংকের বুথ খুলে আরএফসিডি হিসাব খোলা ও বৈদেশিক মুদ্রা জমা-গ্রহণের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। আবার এফএমজে ফরমের ঘোষণা ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা আনার লিমিট বাড়ানোর উদ্যোগও নেয়া যায়।

এক্ষেত্রে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্টকে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ বলে বিবেচনা করা হয়। এর মাধ্যমে প্রবাসী পাকিস্তানিদের ডিজিটাল ব্যাংকিং সুবিধা দেয়া হয়। দেশটির প্রবাসী জনগোষ্ঠী প্লাটফর্মটি ব্যবহার করে দেশের ব্যাংকের সঙ্গে হিসাব পরিচালনা করতে পারে। ২০২০ সালে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এটা শুরু করেছিল। বর্তমানে ১৪টি ব্যাংক এর সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার কিছু সরকারি বন্ড চালু থাকলেও যথাযথ প্রচার ও অনলাইন লেনদেনের সুবিধার অভাবে খুব বেশি কার্যকর হয়নি। এখন অফশোরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব জনপ্রিয় করা গেলে অল্প সময়ের ব্যবধানে ৫-৭ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করার সম্ভাবনা রয়েছে।

এটা সত্য যে কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে দেশ-বিদেশে আস্থার কিছুটা হলেও ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তবে সব ব্যাংকের ওপরই যে আস্থার সংকট আছে, তা ঠিক নয়। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে সংকট অচিরেই কেটে যাবে। দুষ্টচক্র চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে জনগণের অর্থ লুণ্ঠন হবে না। অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের টাকা ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংক আইনের কঠোর প্রয়োগ এক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনতে পারে। সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রবাসীদের মধ্যে দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আস্থার সংকট কাটাতে সাহায্য করবে বলে মনে করি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন