বাংলাদেশ রাজনৈতিক অর্থনীতির দেশ, এটি মাথায় রেখেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কাজ করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং পরিচালিত হয়ে আসছে। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বেশকিছু নীতি সংযোজন করা হয়েছে। আগের নীতিমালা আর বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক তফাত কী দেখছেন? 

অনেক আগে থেকেই অফশোর ব্যাংকের কার্যক্রম চালু থাকলেও সেটি ছিল সীমিত পরিসরে। আগের নিয়মে ব্যাংকগুলো বাইরে থেকে ঋণ নিয়ে আসতে পারত এবং ওই ঋণ বিদেশী মুদ্রায় অভ্যন্তরীণ বাজারে বিনিয়োগ করত। নতুন করে অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আমানত রাখার সুযোগ দেয়া হয়েছে। ওই আমানত গ্রাহক চাইলে স্থানীয় বা বিদেশী মুদ্রায় প্রত্যাহার করতে পারবেন।

অফশোর ব্যাংকিংয়ের জন্য জনপ্রিয় দেশ যেমন সুইজারল্যান্ড, হংকংসহ অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের নতুন আইনের পার্থক্য কোথায়?

অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে আমাদের অবস্থান প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে। হংকংয়ে অফশোর ও অনশোর দুই ধরনের ব্যাংক ব্যবস্থা আছে। তাদের অফশোর অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্য পৃথক নীতিমালা আছে। এ জায়গায় ওদের সঙ্গে আমাদের তফাত রয়েছে। দেশীয় যে আইন বা অনশোর ব্যাংকিংয়ের জন্য নীতিমালা রয়েছে, সেগুলো অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। অফশোর ব্যাংক ভিন্ন নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়।

মরিশাসও অফশোর ব্যাংকিংয়ের জন্য দীর্ঘদিন আলোচিত ছিল। তাদের ব্যাংক ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থার ভিন্নতা কোথায় এবং আমরা কি তাদের মতো হতে পারব? 

অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা ও বিনিয়োগের শীর্ষ দেশগুলোর একটি মরিশাস। এর কারণ এক্ষেত্রে তাদের গৃহীত নীতি বেশ উদার। আমাদের নীতি কেমন এবং কতটা উদার হবে তার ওপর নির্ভর করছে আমরা তাদের মতো হতে পারব কিনা। এক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা। কারা টাকা রাখল, কত টাকা রাখল এসব বিষয়ে দেশীয়ভাবে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল রাখতে হবে। 

নতুন আইনের মাধ্যমে আগের নীতির কিছুটা উদারীকরণ করা হয়েছে। করমুক্ত সুবিধা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশী প্রবাসী ও বিদেশীদের জন্য আর কোন কোন সুবিধা আমরা যুক্ত করতে পারি?  

কেবল প্রবাসী নয়, সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, আমরা এ ব্যাংক ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিতে চাই কিনা। অফশোর ব্যাংকিং আইন আরো উদার করা হবে কিনা, সেটি একটি মৌলিক সিদ্ধান্ত। কারণ পাচারকৃত অর্থ পার্কিয়ের জন্য অফশোর ব্যাংকিংয়ের কুখ্যাতি আছে।

মরিশাস তো দীর্ঘদিন বেনামি ব্যাংক ব্যবস্থা, অর্থ পাচার প্রভৃতি কারণে কালো তালিকাভুক্ত ছিল?

মরিশাস অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার, সন্ত্রাসী অর্থায়নের জন্য কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল। আমরা যদি অফশোর ব্যাংকিংকে প্রাধান্য দিতে চাই তাহলে অবশ্যই মরিশাসের কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার পেছনে দায়ী কারণগুলোকে চিহ্নিত করতে ও আমলে নিতে হবে। ওই সমস্যাগুলো এড়াতে পারলে আশা করা যায় আমরা সফলতার পথে এগিয়ে যাব। 

সুশাসনের ঘাটতির কারণে দেশের ব্যাংক খাতের ওপর সাধারণ মানুষ, প্রবাসী ও বিদেশী সবারই এক ধরনের আস্থাহীনতা আছে। আস্থা পুনরুদ্ধারে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন?

আস্থা ফেরাতে পুরো ব্যাংক খাতের সংস্কার প্রয়োজন। এজন্য পাঁচ বছরের একটি সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে এবং এটি ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাতারাতি এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া এ দেশের ব্যাংক খাত আর এগোতে পারবে না।

সংস্কার কার্যক্রমের শুরুটা কী দিয়ে হতে পারে?

প্রথমেই কোন ব্যাংকের অবস্থা কেমন, বিশেষ করে খারাপ ব্যাংকের অবস্থা কেমন তা মূল্যায়ন করতে হবে। মূল্যায়নের মাধ্যমে দেখতে হবে সম্মিলিত সমস্যা কতটা প্রকট। ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ কত তা জানতে হবে। এটি কি ১ লাখ কোটি, ২ লাখ কোটি নাকি ১০ লাখ কোটি তা জানতে হবে। তারপর সে মোতাবেক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

এক্ষেত্রে সরকারের বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কি সবচেয়ে জরুরি?

অবশ্যই। সরকারের সিদ্ধান্ত ছাড়া এ সংস্কারকাজ শুরুই করা যাবে না।

সরকারের বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংক কি সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে?

না, সরকারের সাপোর্ট ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়া তার দৃষ্টান্ত। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিতেও ভুল ছিল। আর যে নীতি নেয়া হয়েছিল, সেগুলোর জন্য রাজনৈতিক সাপোর্ট শক্তিশালী করা প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ রাজনৈতিক অর্থনীতির দেশ, এ বিষয়টি মাথায় রেখেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কাজ করতে হবে। 

ছয় মাসে আগে অফশোর ব্যাংকিংয়ের জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত যতটা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, সে হিসাবে অফশোর ব্যাংকিং কতটা আলোর মুখ দেখবে বলে আপনার ধারণা?  

আমি মনে করি, অফশোর ব্যাংকের মাধ্যমে অনায়াসেই আমরা প্রতি বছর কয়েক বিলিয়ন ডলার আমানত আনতে পারব। তবে এক্ষেত্রে ভালো ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এ ব্যাংক ব্যবস্থাকে পরিচালিত করতে হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে এ ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখা উচিত। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অফশোর ব্যাংক ব্যবস্থা সফল হবে।

আমাদের ব্যাংক খাতের আমানতের ওপর ইন্স্যুরেন্স গ্যারান্টি আছে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে কি এমন গ্যারান্টি থাকা উচিত?

অবশ্যই, ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা থাকা উচিত। এর জন্য একটি গাইডলাইনও থাকা দরকার। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ নেয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে স্বাভাবিকভাবেই ১৪ বা ১৫ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে। কিন্তু অফশোর ব্যাংক ব্যবস্থায় যদি কম সুদে ঋণ পাওয়া যায় তাহলে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। ডলার প্রবাহ বাড়বে। আমাদের আর্থিক হিসাব ঘুরে দাঁড়াবে। অর্থাৎ ইতিবাচক হবে, যেটি এই মুহূর্তে নেতিবাচক অবস্থানে আছে। আর্থিক হিসাব ইতিবাচক হলে রিজার্ভও বাড়বে। বাজার ব্যবস্থাপনা ও ডলার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকলে অফশোর ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়াটা বেশি সুবিধাজনক হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন