নারী উদ্যোক্তাদের আরো বেশি এসএমই ঋণ দিতে চায় সিটি ব্যাংক

ছবি : বণিক বার্তা

দ্য সিটি ব্যাংক পিএলসি প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ব্যাংকটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদান শুরু করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির হেড অব স্মল বিজনেস হিসেবে আছেন কামরুল মেহেদী

কভিডকালীন বাংলাদেশ সরকারের যতগুলো প্রণোদনা প্যাকেজ ছিল, যতগুলো কম সুদে ঋণ কর্মসূচি চালু হয়েছে, তার মধ্যে এসএমই সবচেয়ে বেশি কম সুদে ঋণ পেয়েছে। কভিডকালীন এসএমই সেক্টর একটি মার্জিলানাইজ লেভেল সেক্টর ছিল। এ খাত খুব বেশি অভিঘাত সহ্য করতে পারে না। কভিডের সময়ে প্রায় ৩০ শতাংশ যারা মার্জিন লেভেলে ছিল, তারা আর ব্যবসায় ফিরতে পারেনি। বাকি ৬০-৭০ শতাংশ যারা কিছুটা হলেও অভিঘাত কাটাতে পেরেছে, তারা এ দুই বছরে অনেক কম সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সুবিধা পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যে প্যাকেজগুলো ঘোষণা করেছেন, সে প্যাকেজগুলো নিয়ে তারা মোটামুটি তাদের ব্যবসাগুলো বন্ধ হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে। কেউ কেউ হয়তো লো স্কেলে চলছে, আবার কেউ কেউ হয়তো আগের মতোই চালাচ্ছে। কিন্তু অনেক কম সংখ্যকই ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পেরেছে। প্রতি বছরই স্বাভাবিকভাবে কিছুটা সম্প্রসারণ হয়। কিন্তু সেটা কভিডকালেও কভিডের পরবর্তী সময়ে হয়নি। তবে যতগুলো সরকারি প্যাকেজ চালু হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক তার কাঠামোর মাধ্যমে এটাকে বিতরণ করেছে। ৭০-৭৫ শতাংশ এসএমই প্রতিষ্ঠান নিজেদের পুনরুজ্জীবিত করে ধীরে ধীরে ধারাবাহিকভাবে কভিডের আগের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। ২০২৩-এর শেষের দিক থেকে বিশেষ করে এ বছর ব্যবসার জায়গাটাই একটা গতি ফিরে আসছে। কভিডের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার সংকট এসএমই খাতকে প্রভাবিত করেছে। এখনো কিন্তু ডলার সিচুয়েশন পুরোপুরি সেটেল ডাউন হয়নি, এখনো মূল্যস্ফীতি সেটেল ডাউন হয়নি। তবে কার্যক্রম যেভাবে এগোচ্ছে এসএমই তার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে, যদি না ইন্টারন্যাশনাল কোনো ব্লকেজ না আসে।

সরকারের যেকোনো ঋণ সুবিধা যদি ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হয়, তাহলে একটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার দরকার, একটা ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল দরকার। সারা বাংলাদেশে সবার ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল নেই। আমাদের যতটুকু তহবিল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তা আমরা সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে পারছি। আমাদের এসএমইতে প্রতি বছর ১৬-১৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সিটিব্যাংক আগে করপোরেটভিত্তিক একটা ব্যাংক ছিল। এখন সেটার অধীনে এসএমই, রিটেইল ও কার্ড আছে। এভাবে আমরা আমাদের পোর্টফোলিওটাকে ডাইভার্সিফাই করে ফেলছি এবং রিস্কের জায়গাটা কমিয়ে ফেলছি। যখন আপনি পোর্টফোলিও ডাইভার্সিফাই করে ফেলবেন, তখন রিস্ক ফ্যাক্টর কমে যাবে। এসএমইতে আমাদের পোর্টফোলিওর আকার ৯ হাজার কোটি।

এসএমই নিয়ে আমাদের বিশদ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা সামনের দিনগুলোতে এসএমইতে অর্থায়নের জন্য আমাদের এজেন্ট চ্যানেলটাকে কাজে লাগাতে চাচ্ছি। এটিকে উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। সিটি ব্যাংকের ৪০ শতাংশ এসএমই ঋণ এজেন্ট চ্যানেলের মাধ্যমে দেয়া হয় এবং ৬০ শতাংশ ঋণ শাখা ও উপশাখার মাধ্যমে দেয়া হয়। এ ঋণের ভেতরে ৭৮ শতাংশ ঋণ যাচ্ছে জেলা পর্যায়ে। ২১ শতাংশ এসএমই ঋণ যাচ্ছে মহানগর এলাকায়। সুতরাং সিটি ব্যাংক যে লক্ষ্য স্থির করেছে সেটা হলো আমরা উপশহর ও গ্রামীণ এলাকায় বেশি ঋণ দেব এবং এক্ষেত্রে আমরা ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল হিসেবে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর বেশি নির্ভর করতে চাচ্ছি। এটা আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

আমাদের এসএমই পোর্টফোলিওর মধ্যে দুটি ভাগ আছে—একটি মিডিয়াম আরেকটি স্মল। স্মল পোর্টফোলিওর মধ্যে ১৭ শতাংশ ঋণ নারী উদ্যোক্তাদের দেয়া হয়েছে। যত ধরনের নারী উদ্যোক্তা ঋণ আছে তা আমরা বাড়াতে চাই। আমরা আশা করছি এ বছরের শেষে নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষুদ্র ঋণ ২০ শতাংশে পৌঁছবে। আমাদের মূলত দুটি লক্ষ্য। ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন-এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর ভর করে আমরা রিমোট এরিয়ায় যেতে চাচ্ছি। পাশাপাশি আমরা নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রডাক্ট দিয়ে তাদের বেনিফিডেড করতে চাচ্ছি।

পোর্টফোলিওর ক্ষেত্রে আমরা ভাগ করি ট্রেড ও ম্যানুফ্যাকচারিং সার্ভিস। আবার লিঙ্গভেদে আমরা ভাগ করি। যেমন পুরুষ ও নারী। এগুলোর মধ্যেও অনেক সাব সেক্টর আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো নতুন নতুন সেক্টর বের হচ্ছে, যেখানে ফাইন্যান্সিং করা হচ্ছে।

এসএমই খাতে অর্থায়নের ক্ষেত্রে আমরা কৃষি ও কৃষিভিত্তিক খাতগুলোকে ফোকাস দিচ্ছি। আয় উৎপাদনকারী খাত যেমন সেবা খাত, উৎপাদন খাত এগুলোয় আমরা বেশি ফোকাস বেশি দিচ্ছি। এসব খাতের মাধ্যমে অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে।

রফতানিমুখী এসএমইর দিকেও আমাদের ফোকাস রয়েছে। আমরা চাচ্ছি তৈরি পোশাকের বাইরে এসএমই প্রডাক্টগুলোও রফতানি করা। যেমন ফিশ, ভেজিটেবল, ফ্রুটস ইত্যাদির দিকে নজর দেয়া। এ ধরনের রফতানি পণ্যগুলোর ওপর আমরা আরো বেশি মনোযোগ দেব। গ্রামাঞ্চলে বেশ ভালো একটা পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামীণ এলাকার উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি না থাকলেও তারা আউট অব দ্য বক্স প্রডাক্ট ভ্যারিয়েশন করতে পেরেছেন। গ্রামীণ ও উপশহর এলাকায় যেসব উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে তাদের অর্জনকে আমাদের জিডিপিতে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। 

ঋণ দেয়ার পাশাপাশি আমরা কাস্টমারের ক্যাপাসিটি বিল্ডিংও করছি। যে আমার সঙ্গে আছে তাকেও এগুলো শেখানো হচ্ছে, আবার যে আমার সঙ্গে কাজ করতে চাচ্ছে তাকেও শেখানো হচ্ছে। এ কাজটা খুব ভালোভাবে সিটি ব্যাংক করছে। আমাদের একটি ডিজিটাল প্লাটফর্ম আছে যার নাম সিটিটাচ। এসএমইর কাস্টমারকেও আমরা গ্র্যাজুয়ালি এখন সিটিটাচে নিয়ে আসছি। সিটিটাচ ব্যবহার করার মাধ্যমে সে অনেক ধরনের সুবিধা পাচ্ছে। এর মাধ্যমে সে বিল পেমেন্ট, বিকাশ পেমেন্ট, রিটেইলারের পেমেন্ট সবকিছু ডিজিটালি করতে পারছে। ছোট ছোট উদ্যোক্তা গ্রুপকে আমরা ট্রেনিং দিয়ে ফিজিক্যালি এ অ্যাপ ইনস্টল করে দিচ্ছি। কারণ এ অ্যাপ সম্পর্কে ব্যবহারকারীর জানতে হবে এবং এর ব্যবহার শেখাতে হবে। এটার কারণে ব্যবহারকারীর সময় ও খরচ দুটোই বেঁচে যাচ্ছে।

এসএমইর অর্থায়ন দেশের আর্থিক অবস্থার ওপরও নির্ভরশীল। আমাদের দেশে ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় অনেক কম। আমরা আশা রাখি এ বছরের মধ্যে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং এসএমই অর্থায়নও একই হারে বাড়বে। আমাদের বিরাট একটি অভ্যন্তরীণ বাজার আছে। এসএমইর যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা অধিকাংশ ব্যবসায়ী কিন্তু স্থানীয় বাজারের ওপরই বেশি নির্ভর করে। তাই আমরা আশাবাদী সামনের দিনগুলো ভালো যাবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ব্যাংকগুলোর জন্য বিভিন্ন খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া আছে। আমরা গর্ব করে বলতে পারি ওই লক্ষ্যমাত্রা আমরা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৬৮ শতাংশ অর্জন করতে পেরেছি। এ বছর আমরা ১০০ শতাংশের ওপর অর্জন করব বলে আশা রাখছি।

সিটি ব্যাংক পরপর তিনবার সাসটেইন্যাবল ব্যাংকের স্বীকৃতি পেয়েছে। এ হিসেবে আইডেন্টিফাই হয়েছে। এ সাসটেইন্যাবল ও গ্রিন ফাইন্যান্সিংয়ে আমরা বেশি গুরুত্ব দিই। পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ ও স্টার্টআপে আমরা ফাইন্যান্স করছি। এসএমই পুরো জাতির চালিকাশক্তি। এটি সবচেয়ে বেশি চাকরির সুবিধা তৈরি এবং আঞ্চলিক চাহিদা তৈরি করে। যত প্রকার আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে সবাই যাতে এসএমইতে বেশি বেশি অর্থায়ন করে। এটা যখন পুঞ্জীভূত হয়ে জিডিপিতে আসবে তখন আমরা ভবিষ্যতে শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন