বিশেষ গোষ্ঠীর প্রভাব ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না, বাজেটে জনগণের বোঝা বাড়বে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

সম্পদ বিষয়ক তথ্য সেবাদাতা মার্কিন কোম্পানি ওয়েলথ-এক্সের বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০১৮ থেকে ২০২০ পর্যন্ত পরপর তিন বছর বিশ্বব্যাপী ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর অন্যতম ছিল বাংলাদেশ। বিভিন্ন মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ে তুলছেন, যা বৈধভাবে অর্জিত বা প্রদর্শিত নয় অথবা কালো টাকা হিসেবে বিবেচিত। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইউবিএস ব্যাংকের গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অর্থনীতির নানামুখী সংকট সত্ত্বেও দেশে বিলিয়নেয়ার বা শতকোটি টাকার মালিকের সংখ্যা ১ হাজার ৭০০ ছাড়িয়েছে, যারা দেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করছেন। দেশের বিশেষ এ গোষ্ঠীর সদস্যদের অপ্রদর্শিত সম্পদ বা কালো টাকাকে বৈধ করার সুযোগ রেখে জাতীয় সংসদে গতকালই উত্থাপন হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব। 

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী উত্থাপিত বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করতে সরকারকে কর দিতে হবে মাত্র ১৫ শতাংশ। সেক্ষেত্রে আয়ের উৎস নিয়েও আর কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। আর প্রদর্শিত বা বৈধ আয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ করহার হবে এর দ্বিগুণ বা ৩০ শতাংশ। 

এ বিষয়ে বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে ‘দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, কোনো করদাতা স্থাবর সম্পত্তি যেমন ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহার এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকারের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।’

বৈধ আয়ের ওপর আরোপিত সর্বোচ্চ করহার কালো টাকা সাদা করতে প্রয়োজনীয় করহারের দ্বিগুণ। এ পদক্ষেপ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনকে আরো উৎসাহিত করতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, বাজেটে বিশেষ গোষ্ঠীর অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকাকে বৈধ করার সুযোগ রাখা হলেও দেশের সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতিসহ বিদ্যমান সংকটগুলো থেকে বের করে আনার মতো বিস্তৃত দিকনির্দেশনা তেমন একটা নেই। বাজেটে গৃহীত পদক্ষেপগুলো জনগণের মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে পর্যাপ্ত নয়। বরং এতে জনগণের ভোগান্তি আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বাজেটের মাধ্যমে ‘কালচার অব ক্রনি-ক্যাপিটালিজম বা অসদুপায়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে বিশাল সম্পদ গড়ে তোলার প্রবণতা পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। সে-সংক্রান্ত কোনো ঘোষণাও এ বাজেটে নেই। ঘোষণা থাকলেও আমরা কিছুটা হয়তো আশ্বস্ত হতাম, সেটিও নেই। ব্যাংক খাত নিয়ে কোনো কথা বলা হচ্ছে না। সেটির প্রভাব সবার ওপর পড়ছে। আমাদের সুদহার বাড়ছে। আমাদের ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতে সরকারের নির্ভরশীলতা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই হিসেবে ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই যে একটা ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে ব্যাংক খাতে; চাহিদা বাড়ছে কিন্তু তাদের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সেটা কিন্তু অ্যাড্রেস করা হয়নি। কাঠামোগত কোনো সমস্যাকে এ বাজেটে মেনশন করা হয়নি বলে আমার ধারণা। উদারীকরণ ও সুদহার বেড়ে যাওয়ার কিছু প্রভাব হয়তো মূল্যস্ফীতিতে দেখা যাবে। তবে জনসাধারণের দুর্ভোগ সাময়িকভাবে কিছুটা বাড়তেও পারে। কারণ বিদ্যুৎসহ কিছু পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হবে। কাজেই দুর্ভোগ কমবে না।’ 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চাহিদায় রাশ টেনে ধরাসহ গৃহীত সরকারের পদক্ষেপগুলো এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে স্বীকার করছেন অর্থমন্ত্রী নিজেও। গতকাল বাজেট প্রস্তাব উত্থাপনকালে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি আমাদের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হওয়ায় এটি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে চাহিদার রাশ টেনে ধরা এবং সরবরাহ বৃদ্ধি করার দিকে আমরা বিগত দুটি বাজেটে সর্বাত্মক মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিলাম। এ পরিপ্রেক্ষিতে সামষ্টিক অর্থনীতির সুফল পেতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণের পাশাপাশি বিভিন্ন সহায়ক রাজস্ব নীতি গ্রহণ করা হয়। এ সত্ত্বেও আমদানিজনিত মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহ শৃঙ্খলে ত্রুটির কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি অনমনীয়ভাবে ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে।’

আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) এ নীতি অব্যাহত রাখা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাজেটে ফিসক্যাল কনসোলিডেশন তথা ঘাটতি হ্রাস এবং সীমিত কলেবরে হলেও বেল্ট টাইটেনিং তথা কৃচ্ছ্রসাধন অব্যাহত রাখা হবে। দীর্ঘমেয়াদে এ পন্থা অবলম্বন করা হলে প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে। এ কারণে আমাদের লক্ষ্য থাকবে অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে ধীরে ধীরে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা। এটি সম্ভবপর হবে যদি রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়। সে লক্ষ্যে কর অব্যাহতি ক্রমান্বয়ে তুলে নেয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির দিকে নজর দেব।’ 

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের অর্থনীতি বর্তমানে কিছুটা চাপের সম্মুখীন হলেও প্রাজ্ঞ ও সঠিক নীতিকৌশল বাস্তবায়নের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতিধারা অব্যাহত রয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির এ গতি আগামীতে ধরে রাখার লক্ষ্যে কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন উৎসাহিত করতে যৌক্তিক সব সহায়তা চলমান থাকবে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন এবং রফতানি ও প্রবাস আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। আশা করছি আমাদের এসব প্রাজ্ঞ নীতি-কৌশলের সুফল হিসেবে আগামী অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং মধ্যমেয়াদে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে পৌঁছাবে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত পদক্ষেপগুলোর সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য এর পাশাপাশি রাজস্ব নীতিতেও সহায়ক নীতি-কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিতে ফ্যামিলি কার্ড, ওএমএস ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। আমাদের গৃহীত এসব নীতি-কৌশলের ফলে আশা করছি আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে।’

বাজেট পর্যালোচনায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ মুহূর্তে সরকারের প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দেয়া বেশি প্রয়োজন। এজন্য অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মাণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাজেটে রাজস্ব নীতির সংস্কারমূলক দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি ছিল। অন্যথায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কাজে আসবে না। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বাজেট ব্যবসাবান্ধব ও জনবান্ধব নয়। লোকজনকে সুখী করার মতো তেমন কিছু নেই। লোকজন সুখী হওয়া মানে তো মূল্যস্ফীতি কমবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, আয়ের উৎস বাড়বে, ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যবসা প্রসারের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এগুলো নিশ্চিত করা গেলেই মানুষ সুখী হবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির ব্যাপারে তেমন কিছু দেখিনি। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না, সম্ভব না। এজন্য এক বছরের মধ্যে সরবরাহ বাড়াতে হবে, চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাজার মনিটর করলে হয়তো কিছু কমবে। কিন্তু প্রস্তাবিত ৬ দশমিক ৫-এ আনা যাবে না। তবে এবারের বাজেটের আকার গতবারের চেয়ে বেশি বড় হয়নি। এদিক থেকে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যয়ের কোনো সংকোচন হয়নি। উচিত ছিল আকারের মতো করে ব্যয়ও কমানো। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমালে ঘাটতি কম হতো। বিশেষ করে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যেখানে প্রকল্প আছে ১ হাজার ২০০-এর বেশি। এ সময়ে এতগুলো প্রকল্প নেয়ার কোনো অর্থ হয় না। এ রকম সময় আইটি, জ্বালানির মতো অত্যন্ত জরুরি কতগুলো অবকাঠামো বাদে বাকিগুলো যদি এডিপি অর্ধেক করে ফেলত, তাহলে ঘাটতিও অর্ধেক কমে যেত।’ 

‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের যাত্রা’ শীর্ষক বাজেট বক্তৃতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এ বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত এ বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায়, যা মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। বাজেট প্রস্তাবে আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। 

বাজেটে পৌনে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও বৈশ্বিক অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি এর প্রতিকূলে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আঁটসাঁট আর্থিক নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলো। শ্লথ হয়ে পড়েছে বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রবাহ। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা বাড়াচ্ছে রিজার্ভ পরিস্থিতি, টাকার অবমূল্যায়ন ও সরকারি ঋণের ঊর্ধ্বমুখিতা। 

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়ও এসব ঝুঁকির কথা উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ‘গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাইয়ের শেষে ছিল ৩৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, যা চলতি বছরের মে মাসের শেষে কমে ২৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রা বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়তে হয়েছে। ফলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে জুলাই ২০২২ থেকে চলতি অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ অবচিতি (অবমূল্যায়ন) ঘটেছে, যার ফলে আমদানীকৃত পণ্যের মূল্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এভাবে আমদানিজনিত মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির ওপর।’  

তিনি আরো বলেন, ‘সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট, যা বিশ্বে সুদের হারের অন্যতম রেফারেন্স রেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় সব উন্নত দেশ তাদের সুদহার পর্যায়ক্রমে বাড়াতে থাকলে ছয় মাসের গড় হিসাবে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট বেড়ে চলতি অর্থবছরের মে মাস নাগাদ প্রায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ইউরোপসহ অন্যান্য উন্নত দেশেও একই কারণে সুদহার বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে ইইউআরআইবিওআর, টিওএনএ ইত্যাদি রেফারেন্স রেটেও। ফলে বাংলাদেশকে দুই ধরনের চাপ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় মূলধনের বহিঃপ্রবাহের গতি বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তঃপ্রবাহও কমার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে একদিকে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বাড়ছে, অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায় বাড়ছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বার্ষিক ব্যয় ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশে সুদহার সামনের দিনগুলোয় কমে আসার যে পূর্বাভাস রয়েছে, তা সঠিক না হলে এ ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।’ 

বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়, সরকারের ব্যয়-সক্ষমতা বাড়াতে হলে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ এদিক থেকে সমতুল্য অনেক দেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। দেশে কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে রয়েছে। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে কর-জিডিপি অনুপাত ছিল যথাক্রমে ১৬ দশমিক ৯৮, ১১ দশমিক ৫৯, ১৪ দশমিক শূন্য ৩ এবং ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। মধ্যমেয়াদে দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে হলে ১০ শতাংশের বেশি কর-জিডিপি অনুপাত অর্জন করা জরুরি। 

বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আয় করা হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ গ্রহণ করা হবে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকার। এর মধ্যে শুধু ব্যাংক খাত থেকেই আসবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর ব্যাংকবহির্ভূত ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

ঘাটতি পূরণে সরকারের ব্যাংক খাতের ঋণের ওপর নির্ভরতা প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংক খাতে এমনিতেই দুরবস্থা। তারল্যসহ নানারকম সংকটে ভুগছে খাতটি। সব ঋণ যদি সরকারই নিয়ে নেয় আর ব্যক্তি যদি ঋণ না পায়, তাহলে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে? এটি না হলে এনবিআর কীভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আদায় করবে। এগুলোর একটার সঙ্গে অন্যটার তেমন যোগ-সংযোগ নেই। ছাড়া ছাড়া মনে হচ্ছে।’  

বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য সরকারের সুদ পরিশোধ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। গত ছয় বছরে সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত অর্থবছরেও মূল বাজেটে সুদ পরিশোধের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা।

সংসদে দেয়া বক্তব্যে গতকাল স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে আলোকপাত করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পরিবর্তিত বাস্তবতায় স্থানীয় শিল্পকে নিজেদের দক্ষতা ও কৌশল দিয়েই বহির্বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে উৎপাদনে নতুন ও উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন, নতুন পণ্য উদ্ভাবন এবং কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিল্পপণ্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি, পণ্য বৈচিত্র্যায়ন ও পণ্যের বহুমুখীকরণে যথাযথ নীতিসহায়তা প্রদানের মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণকে মসৃণ ও টেকসই করার লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সে উদ্দেশ্যে অর্থাৎ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য মসৃণ রূপান্তর কৌশল (এসটিএস) প্রণয়নের লক্ষ্যে সরকার উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটি এবং তার অধীনে গঠিত বিভিন্ন উপকমিটি এরই মধ্যে বিভিন্ন কৌশল নিরূপণ করেছে, যার ভিত্তিতে উত্তরণের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ বর্তমানে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।’

প্রস্তাবিত বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়। এসব পণ্যে উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হচ্ছে। পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, মটর, ছোলা, চাল, গম, আলু, মসুর, ভোজ্যতেল, চিনি, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ডাল, ভুট্টা, ময়দা, আটা, লবণ, গোলমরিচ, এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, খেজুর, তেজপাতা, পাট, তুলা, সুতা এবং সব ধরনের ফলসহ ৩০ পণ্য। 

এছাড়া বাজেটে যেসব পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সিগারেট, মোবাইল ফোনের সিমকার্ড, কল রেট, আইসক্রিম, বৈদ্যুতিক মিটার, সংসদ সদস্যদের জন্য আমদানি করা গাড়ি, কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকস, কাজুবাদাম ইত্যাদি। এছাড়া ভ্যাট বাড়ানোয় এসি-ফ্রিজ উৎপাদনে ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে। পাশাপাশি পানির ফিল্টার আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণায় ভোক্তা পর্যায়ে এ বাবদ ব্যয়ও বাড়তে যাচ্ছে। একইভাবে দাম বাড়তে পারে এলইডি বাল্বেরও। 

বাজেটে খেলাপি ঋণ আদায় ও পুঁজি পাচার রোধে স্পষ্ট নির্দেশনার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। আর এসব ঋণের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। তাই খেলাপি ঋণ আদায়ে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলে ভালো হতো। পুঁজি পাচার বন্ধ করতে হবে। নয়তো রিজার্ভ স্থিতিশীল হবে না। তাই পুঁজি পাচার ঠেকানো ও খেলাপি ঋণ আদায় এখন বড় দায়িত্ব। সংকটের সময়ে অপ্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন