প্রস্তাবিত বাজেটে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ

অর্থ পাচার ঠেকাতে ব্যর্থ হলে অপ্রদর্শিত অর্থ মূলধারার অর্থনীতিতে আসবে না

ছবি : বণিক বার্তা

আসন্ন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। অন্যান্য বছরের বাজেটের মতো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। স্থাবর সম্পত্তি যেমন ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট কর এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা যাবে। এমনকি দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন এক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন তুলতে পারবে না। অন্যদিকে বৈধ আয়ে সর্বোচ্চ করারোপ করা হয়েছে ৩০ শতাংশ। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার এ পন্থায় খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায় না। এনবিআরের তথ্যানুসারে, কালো টাকা সাদা করার ঘোষণার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা বৈধ করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ কালো টাকা সাদা হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ওই সময় ১০ শতাংশ করারোপ করা হয়। এক অর্থবছরে এত বিশাল অংকের টাকা সাদা হওয়ার পেছনে অন্যতম একটি কারণ ছিল করোনার প্রভাব। কর্মকাণ্ড ও যোগাযোগের শিথিলতার কারণে অর্থ পাচার হতে পারেনি; দেশের অভ্যন্তরেই সরাসরি বিনিয়োগ করা হয়। কালো টাকা সাদা করার ধারাবাহিকতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এক বছরের জন্য পাচার করা টাকা ৭ শতাংশ হারে কর দিয়ে দেশে ফেরত আনার আইনি সুযোগ দেয়া হয়। তবে অর্থবছর শেষে দেখা যায়, এতে কোনো লাভ হয়নি। 

স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। বরং এসব উদ্যোগ নিয়মিত করদাতাদের প্রতি অন্যায্য সিদ্ধান্তকে প্রতিফলিত করে এবং নিরুৎসাহিত করে কর প্রদানে। কালো টাকা সাদা করার এমন সুযোগ পৃথিবীর অন্য অনেক দেশেও আছে। তবে সফল কেবল তারাই হতে পেরেছে যারা এর মাধ্যমে কর ফাঁকি ও অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক আপসে যায়নি। এদিকে বাংলাদেশ বৈধ করদাতাদের ওপর বেশি টাকা করারোপ করছে, অন্যদিকে বিনা প্রশ্নে কম হারে অপ্রদর্শিত অর্থকে বৈধ করার সুযোগ দিচ্ছে। এ উদ্যোগের পেছনে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি হলো, অপ্রদর্শিত অর্থ মূলধারার অর্থনীতিতে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়া। এ সুযোগ না দেয়া হলে আরো অর্থ পাচার হয়ে যাবে। কিন্তু অর্থ পাচার বন্ধ না হলে আদৌ কি সামষ্টিক অর্থনীতিতে রাজস্ব প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব! সব উদ্যোগেরই পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকে। তবে এটির সপক্ষে যে যুক্তি তা কেবল সরকারের আর্থিক অব্যবস্থাপনাকে স্পষ্ট করে, তেমনভাবে সুফল বয়ে আনে না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসার বদলে অর্থ পাচারের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি গত বছর মে মাসে বিকল্প বাজেট প্রস্তাবে উল্লেখ করে, ৫০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) পরিসংখ্যানমতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-১৫ সময়কালে মোট অন্তত ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অংকে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ কেবল পণ্য আমদানিতে অধিক মূল্য ও পণ্য রফতানিতে কম দাম দেখানোর মাধ্যমে এ পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে ওই সময়। অবশ্য টাকা পাচার পরিমাপের কোনো সর্বজনীন পদ্ধতি বা আন্তর্জাতিক মাপকাঠি না থাকায় টাকা পাচারের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরাও মুশকিল। কিন্তু সংখ্যাটি যে বেশ বড় তাতে কারোরই কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।

কালো টাকা সাদা করার বিষয়টি সবসময়ই বিতর্কিত থেকেছে। এবারো এটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, প্রস্তাবিত বাজেট দেশের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় করেই নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বাজেটের আকার তুলনামূলক ছোট রাখা হয়েছে। এবারের বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এ বাজেটে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে। প্রবৃদ্ধির চেয়ে এ সময় এটিই জরুরি। চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সঙ্গে থাকছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়ন ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ। প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের জন্য মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বহির্ভূত খাত থেকে আসবে আরো ১৫ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এ বাজেটে কর-জিডিপি ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে। এ বিবেচনায় আসন্ন বাজেটে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আসছে আমদানি শুল্ক কাঠামোয়। প্রস্তাবের মধ্যে যেমন রাজস্ব আয় বাড়ানোর উপায় দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, আবার দেশীয় শিল্প সুরক্ষায়ও কিছু প্রস্তাব রয়েছে। এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি সুবিধা খারিজ করা হয়েছে। সীমিত হচ্ছে লাগেজ সুবিধাও। সাধারণত অনুমোদিত গাড়ি আমদানিতে কোনো শুল্ক কর দিতে হয় না সংসদ সদস্যদের। সাধারণ পাঁচ বছরের জন্য একটি গাড়ি আমদানিতে এ সুবিধা পান এমপিরা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ সুবিধা আর থাকছে না। এমপিদের গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। এতে মোট করভার হবে ৪৩ শতাংশ। এবারের বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করে এ অঙ্গীকার সত্যি হোক—এ প্রত্যাশা। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন