দেশে ৫০ ভাগ পরিবারে ফ্রিজ পৌঁছে গেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

শহর থেকে গ্রাম—বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়। বেড়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। তাই সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্তের পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরেও এখন জায়গা করে নিয়েছে রেফ্রিজারেটর। বিলাসী ইলেকট্রনিকস পণ্যটি পরিণত হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে। একসময় দেশে ব্যবহৃত ফ্রিজের পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। এখন ৯০ শতাংশই দখল করে নিয়েছে দেশে উৎপাদিত ফ্রিজ। বর্তমানে এ বাজারে দেশীয় কোম্পানিগুলোর আধিপত্য। অনেক বেশি সহজলভ্য হওয়ায় আকাশচুম্বী দামও কমেছে অনেকটা। বছরে এখন ২০-২৫ লাখ ইউনিট ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে ৫০ শতাংশের বেশি পরিবারেই পৌঁছে গেছে রেফ্রিজারেটর। এদিকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে পণ্যটি রফতানিও করছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। 

উন্নত বিশ্বে খাদ্য সংরক্ষণে অপরিহার্যভাবে রেফ্রিজারেশন করা হয়। কোনো আবদ্ধ স্থানের তাপমাত্রা যখন আশপাশের তাপমাত্রা থেকে কমিয়ে শীতল করা হয়, সে পদ্ধতিকে বলে রেফ্রিজারেশন। কৃত্রিমভাবে খাবার ও পানি ঠাণ্ডা রাখা এবং সংরক্ষণের একটি জনপ্রিয় যন্ত্র রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ। এতে থাকে তাপ নিরোধক কম্পার্টমেন্ট ও হিটপাম্প, যা ভেতর থেকে তাপ বাইরে বের করে দেয়। ফলে চারপাশের পরিবেশের চেয়ে ফ্রিজের ভেতরের তাপমাত্রা অনেক কম থাকে। সেখানে থাকা খাবারের অণুজীবের বৃদ্ধি রোধ করে। ব্যাকটেরিয়াও কম প্রজনন করে ও কম ছড়ায়। তাই ফ্রিজের খাদ্য সহজে পচে না।

দেশের বর্তমান জলবায়ু পরিস্থিতিতে জেলা শহর থেকে শুরু করে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ফ্রিজের চাহিদা বেড়েছে। অন্যদিকে রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরের ক্রেতাদের মধ্যে তীব্র আকর্ষণ উপলব্ধি করা যাচ্ছে সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি। পুরনো ফ্রিজ বদলে নতুন কেনার প্রবণতাও বেড়েছে অনেক। সব মিলিয়ে আরো বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে পণ্যটির বাজার। তবে দেশে এসব পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে সরকার যেসব নীতিসহায়তা দিচ্ছে, সেটি আরো কয়েক বছর অব্যাহত রাখার দাবি খাতসংশ্লিষ্টদের। তাতে যেমন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হবেন, তেমনি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের বিনিয়োগ তুলতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস প্রতিবেদন ২০২৩ অনুযায়ী, দেশের ৫৩ শতাংশের বেশি খানা বা পরিবারে এখন রেফ্রিজারেটর রয়েছে। ২০২১ সালে ফ্রিজ ছিল ৪৫ শতাংশের মতো পরিবারে। আর ২০২২ সালে পণ্যটি পৌঁছে যায় প্রায় ৫০ শতাংশ পরিবারের কাছে।  

বিভিন্ন পণ্যের আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ের বাজার পর্যালোচনার ভিত্তিতে নিয়মিত মার্কেট ইনসাইট প্রকাশ করছে স্ট্যাটিস্টা মার্কেট ইন্টেলিজেন্স। বৈশ্বিক ডাটাবেজটির বাংলাদেশে রেফ্রিজারেটরের বাজারসংক্রান্ত পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, টেকসই পণ্য উৎপাদনে সরকারের গৃহীত উদ্যোগ ও ভোক্তাদের মধ্যে প্রতিবেশসচেতনতা বাড়ায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী রেফ্রিজারেটরের চাহিদা বাড়ছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে রেফ্রিজারেটর বাজারে মোট আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৩০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ (সর্বশেষ বিনিময় হার ১ ডলারে ১১৭ টাকা ৩৫ পয়সা হিসাবে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা)। ২০২৪-২৯ সালের মধ্যে দেশে ইলেকট্রনিক পণ্যটির বার্ষিক গড় বাজার সম্প্রসারণের হার দাঁড়াবে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশে। আর চলতি বছর শেষে খানাপিছু গড় রেফ্রিজারেটরের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে দশমিক ১০-এ।

দেশে রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে প্রথম উদ্যোগ নেয় দেশীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। তারপর একে একে যমুনা, মিনিস্টার, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ভিশন, ট্রান্সকম, ইলেক্ট্রো মার্টের হাইকো, ওরিয়ন ও র‍্যানকন কারখানা স্থাপন করে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বাংলাদেশে উৎপাদন শুরু করে বিদেশী ব্র্যান্ড স্যামসাং, সিঙ্গার, ওয়ার্লপুল, কনকাসহ আরো বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড। এখন দেশী-বিদেশী ১৩টি কোম্পানি ফ্রিজ উৎপাদন করে বাজারজাত করছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে ফ্রিজের বাজার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। বাজারে পণ্যটির মডেল রয়েছে কয়েকশ। চাহিদার কথা বিবেচনায় তৈরি হচ্ছে এসব মডেল। বছরে ২০-২৫ লাখ ইউনিট ফ্রিজ বিক্রি হচ্ছে দেশে। 

বাংলাদেশে ফ্রিজ উৎপাদনে অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি ওয়ালটন ২০০৫ সালের শেষ দিকে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিজস্ব জমিতে কারখানা নির্মাণ শুরু করে। বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায় ২০০৮ সালে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালে ফ্রিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কম্প্রেসর উৎপাদন শুরু করে। দেশের পাশাপাশি রফতানি বাজারেও ভালো অবস্থান তৈরি করেছে ওয়ালটন। 

জানতে চাইলে ওয়ালটনের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) এসএম শোয়েব হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারের নীতিগত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়েই দেশী শিল্প উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় এখন ফ্রিজের মতো পণ্যের উৎপাদন সক্ষমতা বহু গুণ বেড়েছে। পণ্যটির মূল্য সংযোজন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ শতাংশের বেশিও হয়। সরকারই বলে দিয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ে ম্যানুফ্যাকচারড বলতে গেলে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হতে হবে। এটাই সবাই অনুসরণ করছে। এসব কারণে সরকার, দেশ ও জনগণ উপকৃত হচ্ছে। সরকারের এসব সুবিধা অব্যাহত রাখাসহ ক্রমে আরো বাড়াতে হবে, যাতে স্থানীয় শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা আরো বাড়ে।’

সাধারণত ক্রেতারা ফ্রিজ কেনার সময় দাম, স্থায়িত্ব, বিদ্যুৎ সাশ্রয়, কম্প্রেসর, বিক্রয়োত্তর সেবা, নকশা ও আধুনিক প্রযুক্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন। অন্যদিকে ফ্রিজ থেকে পানি বের হওয়া, কম্প্রেসরের বাড়তি শব্দ, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ, বেশি বরফ জমা, নির্দিষ্ট সময় পরপর কম্প্রেসরের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া নিয়ে অভিযোগ করতেও দেখা যায় অনেককে। তবে মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের (এমডব্লিউবি) এক গবেষণা বলছে, অপেক্ষাকৃত কম দামে মোটামুটি ভালো মানের ফ্রিজ তৈরিতে সক্ষম হওয়ার কারণে দেশীয় ব্র্যান্ডের ফ্রিজগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

দেশের বাজারে যেসব ফ্রিজের প্রবল চাহিদা রয়েছে সেই তালিকায় রয়েছে যমুনা ইলেকট্রনিকস। ২০১৪ সাল থেকে ফ্রিজ বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। ঈদ সামনে রেখে প্রতিষ্ঠানটির অর্ধলক্ষ ফ্রিজ বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

দেশীয় ব্র্যান্ডের পাশাপাশি বিদেশী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের উৎপাদিত পণ্যও দেশের বাজারে রয়েছে। সাধারণত দেশীয় ব্র্যান্ডের উৎপাদিত পণ্যগুলোর চাহিদা গ্রামাঞ্চল ও উপশহরগুলোয় বেশি। অন্যদিকে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর প্রতি শহরের মানুষের আকর্ষণ বেশি দেখা যায়। বর্তমানে দেশেই উৎপাদন হচ্ছে চীনা ব্র্যান্ডের কনকা ফ্রিজ। তাদের পণ্য দেশে উৎপাদন করছে ইলেক্ট্রো মার্ট। সোনারগাঁয় স্থাপিত কারখানায় কনকার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড হাইকোর ফ্রিজও উৎপাদন করছে। 

জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামরুন নাহার সিদ্দীকা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার এমনভাবেই নীতি প্রণয়ন করছে, যাতে দেশী শিল্প ক্রমেই আরো বিকশিত হয়। বেশকিছু শিল্পপণ্যের বাজারে আমরা এরই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি।’

দেশে মূলত তিন ধরনের ফ্রিজ বিক্রি হয়। এমডব্লিউবির গবেষণার তথ্য বলছে, সবচেয়ে বড় বাজার ফ্রস্ট ফ্রিজের। এর অংশ ৮৫ শতাংশের কাছাকাছি। এছাড়া নন ফ্রস্ট ৮ দশমিক ৩৩ ও চেস্ট বা ডিপ ফ্রিজ ৬ দশমিক ৭ শতাংশের মতো বিক্রি হয়। সামনেই ঈদ। আছে তীব্র গরমও। দেশী-বিদেশী সব প্রতিষ্ঠানই ক্রেতা টানতে মূল্যছাড়সহ বিভিন্ন অফার দিয়েছে। তাই এবার ফ্রিজ বিক্রি আরো বাড়বে বলে আশা খাতসংশ্লিষ্টদের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন