কুশিং সিনড্রোম

সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা জরুরি

ডা. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (রাজু)

ছবি : বণিক বার্তা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিদ্ধ নিউরোসার্জন হার্ভে কুশিং ১৯১২ সালে প্রথম কুশিং সিনড্রোম রোগটি শনাক্ত করেন। তার নামানুসারে এটি কুশিং সিনড্রোম নামকরণ হয়। সিনড্রোম বলতে অনেকগুলো সমস্যার সমষ্টিকে বোঝায়।

কুশিং সিনড্রোমের লক্ষণ

. নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে

            ওজন বেড়ে যায়

            মুখটা ফুলে চাঁদের মতো হয়ে যায়! অতিরিক্ত ব্রণ হয়

            মুখ শরীর মোটা হলেও হাত পা চিকন থাকে, হেয়ার থিনিং বা চুল পাতলা হয়ে যায়

            ঘাড়ের পেছনের পেশি ষাঁড়ের মতো ফুলে ওঠে

            ত্বক পাতলা হয়ে যায়, ফলে খুব সহজেই ত্বক ফেটে যায়, পেটসহ ত্বকের বিভিন্ন অংশে লম্বালম্বী পার্পল দাগ (striae) দেখা দেয়

            মাথাব্যথা হয়, রোগী ডিপ্রেশনে ভোগে, ঘুম হয় না

            খুব দুর্বল লাগা, মাংসপেশিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে

            ডায়াবেটিস, ফ্যাটি লিভার, হৃদরোগ দেখা দেয়

            উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের চর্বি বেড়ে যায়

            হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপরোসিস

            খুব সহজে ইনফেকশন হওয়া

            পেপটিক আলসার ইত্যাদি

. পুরুষের ক্ষেত্রে

 যৌন দুর্বলতা

. নারীদের ক্ষেত্রে

     অবাঞ্ছিত পশম

     অনিয়মিত পিরিয়ড

     শিশুদের ক্ষেত্রে

     বৃদ্ধি স্থবির হয়ে যায়

কুশিং সিনড্রোমের কারণ

রক্তে কর্টিসোল হরমোনের মাত্রা বেড়ে সমস্যাগুলো তৈরি করে। কর্টিসোল একটি স্টেরয়েড হরমোন। এটি জীবন রক্ষাকারী একটি জরুরি উপাদান। কিডনির ঠিক ওপরে অবস্থিত অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে এটি তৈরি হয়। গ্রন্থির রাজা মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থির এসিটিএইচ নামক আরেকটি হরমোন এর নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে।

দুটো কারণে কর্টিসোল বাড়ে

. এন্ডোজেনাস বা শরীরে অতিরিক্ত কর্টিসোল তৈরি হলে: পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার বা ক্যান্সার হলে সেটি থেকে অতিমাত্রায় এসিটিএইচ নিঃসৃত হয়। তা অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিকে উদ্দীপনা দেয়। ফলে এটি বেশি বেশি কর্টিসোল তৈরি করে।

. এক্সোজেনাস বা বহিরাগত কর্টিসোল: বিভিন্ন কারণে আমরা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করি। যেমন শ্বাসকষ্ট হলে স্টেরয়েড ট্যাবলেট বা ইনহেলার, বাত ব্যথার বিভিন্ন রোগে স্টেরয়েড ট্যাবলেট (প্রেডনিসোলনদেখতে শসা দানার মতো), অ্যালার্জি বা চর্মরোগে স্টেরয়েড জাতীয় মলম। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ডোজ প্রয়োগ করেন ধীরে ধীরে তা কমিয়ে আনেন। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ইচ্ছেমতো ব্যবহার করলেই বিপত্তি ঘটতে পারে। অনেক সময় কিছু হোমিওপ্যাথিক ওষুধেও স্টেরয়েড থাকে। মোটা হওয়ার জন্য অনেক রোগী শালশাসহ বিভিন্ন কবিরাজি ওষুধ সেবন করেন। এসব শরীরে কর্টিসোলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। বাইরে থেকে সাপ্লাই পেতে থাকলে অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি কাজ না করে চুপসে যায়। ফলে হঠাৎ এসব ওষুধ বন্ধ করে দিলেও সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। জরুরি পরিস্থিতিতে যখন অনেক কর্টিসোল দরকার তখন আর শরীর থেকে এটি পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হয় না। ফলে রোগীর প্রেসার কমে যায় এবং সোডিয়াম পটাশিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়। এটি অ্যাড্রেনাল ক্রাইসিস নামে পরিচিত। অনেক রোগী ক্রাইসিস নিয়েই হাসপাতালে ভর্তি হয় পরবর্তী সময়ে কুশিং ডায়াগনোসিস হয়।

এছাড়া অ্যালকোহল সেবন অতিরিক্ত ডিপ্রেশনের ফলে মস্তিষ্কের কর্টিসোল রিলিজিং হরমোনের প্রভাবে এক ধরনের কুশিং হয়, যা সিউডো বা মিথ্যা মিথ্যি কুশিং হিসেবে পরিচিত। অ্যালকোহল ছেড়ে দিলে বা ডিপ্রেশন কমানো গেলে এটি সেরে ওঠে।

চিকিৎসা

রোগ নিরূপণে নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা পেতে এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বা হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। রোগ নির্ণয় চিকিৎসার জন্য অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বিশেষায়িত হাসপাতালের হরমোন রোগ বা এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগে রোগ নির্ণয় চিকিৎসার সুব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসা ব্যয়ও খুব বেশি নয়। তবে সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা গ্রহণ নিয়মিত ফলোআপ খুব জরুরি।

প্রতিরোধ

কুশিং সিনড্রোম থেকে বাঁচতে চাই সচেতনতা। চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোনো ধরনের ওষুধ সেবন না করা। বিশেষ করে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: মেডিসিন হরমোন বিশেষজ্ঞ, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, (প্রেষণেবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন