খারাপ ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থার কারণ অনুসন্ধান ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

ফারুক মঈনউদ্দীন, ব্যাংকার ও লেখক। বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের ভাইস চেয়ারপারসন হিসেবে কাজ করছেন। এর আগে তিনি ছিলেন ট্রাস্ট ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও। ট্রাস্ট ব্যাংকে যোগদানের আগে তিনি সিটি ব্যাংক লিমিটেডের একাধারে অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, চিফ রিস্ক অফিসার এবং মানি লন্ডারিং বিরোধী প্রধান পরিপালন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও এবি ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবেও কর্মরত আছেন। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নানা বিষয় নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

দুর্বল ও সবল ব্যাংকের মার্জারে কি দুর্বল সবল হবে নাকি সবলকে দুর্বল করবে?

প্রকৃতপক্ষে মার্জার বা একীভূত হওয়ার বিষয়টা ঘটে সমানে সমানে, যা ব্যবসা বৃদ্ধি এবং উভয় প্রতিষ্ঠানকে আরো শক্তিশালী করার জন্য কৌশলগত ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত মোতাবেক হয়ে থাকে। ব্যাংকসহ বিশ্বের নামিদামি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে একীভূত হয়ে আরো শক্তিশালী হয়েছে। তবে সবল প্রতিষ্ঠান যদি আদৌ কোনো দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে নিতে চায়, সেটি ঘটে ভিন্ন কারণে। যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন, বাজারের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণ ইত্যাদি। কিন্তু সেই মার্জার বা অধিগ্রহণ যদি সমানে সমানে না হয়ে সবলের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সবল প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সবল থাকা দুরূহ হয়ে পড়ে, যদি দুর্বল প্রতিষ্ঠানের দায়দেনাসহ সব দুর্বলতা সবলকে বহন করে যেতে হয়। 

ব্যাংকগুলো কেন খারাপ হলো? ভালো ব্যাংকগুলো কেন খারাপের দায়িত্ব নেবে?

ব্যাংকগুলো খারাপ হওয়ার একাধিক কারণ আছে। নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা করা, মালিক পক্ষের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ, ব্যাংক ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা ও দুর্বলতা, দুর্নীতি—এ জাতীয় সবগুলো একত্রে কিংবা আলাদাভাবে খারাপ হওয়ার জন্য দায়ী। ব্যাংক পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবর্তিত ও নিয়মাচার এবং প্রচলিত ব্যাংকিং রীতিগুলো পরিপালনে ব্যর্থতা ও অনীহা থেকেই ঘটেছিল সুশাসনের ঘাটতি। ফলে যা পরিণতি হওয়ার তা-ই হয়েছে। 

অনেক সময় জাতীয় স্বার্থে ভালো ব্যাংকগুলোকে খারাপ ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে হতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে কিছু পূর্বশর্ত ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। খারাপ ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থার কারণ অনুসন্ধান ও সে বিষয়ে যথাযোগ্য জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ভারতেও একাধিক ক্ষেত্রে এ রকম ঘটেছে এবং তার সবগুলো যে সফল হয়েছে, সে কথা বলা যাবে না। 

এখন থেকে ৪৫ বছরের কম বয়সের কেউ ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হতে পারবেন না। স্বতন্ত্র পরিচালকদের বয়স হতে হবে সর্বনিম্ন ৪৫ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ বছর। এছাড়া ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হতে হলে দেশের স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি, ব্যাংকিং, ফাইন্যান্স, ব্যবসায় প্রশাসন, আইন, হিসাববিজ্ঞান বা কস্ট অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। এ সিদ্ধান্তকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ব্যাংক কিংবা যেকোনো পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিতে, বিশেষ করে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত না হয়ে মূল মালিক/পরিচালকের প্রভাবমুক্ত থেকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা নিশ্চিত করা এবং তার যোগ্যতা অনুযায়ী যথাযথ অবদান রাখা। অতীতে এ রকম নির্দিষ্ট যোগ্যতার বিষয়টি আইনে ছিল না। ফলে দেখা গেছে, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকলেও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যারা কোনো অবদান রাখতে পারেননি। যে বিষয়গুলোর ওপর ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য সেগুলো অত্যাবশ্যক, বিশেষ করে বর্তমান পরিবর্তিত ব্যাংকিং ব্যবসায়। অবশ্য এ নতুন নীতিমালাও যে ফুলপ্রুফ, সে কথা বলা যায় না। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে মূল উদ্যোক্তা পরিচালক তথা পরিচালনা পর্ষদের অভিপ্রায় ও সদিচ্ছার ওপর। নির্দেশিত বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও একজন স্বতন্ত্র পরিচালক যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবেন, সেটা সর্বক্ষেত্রে সঠিক নাও হতে পারে, যদি পরিচালনা পর্ষদ স্বতন্ত্র পরিচালককে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা না দেয়। 

⁠বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, স্বতন্ত্র পরিচালকরা প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা স্থায়ী সম্মানী পাবেন। আগে অবশ্য স্বতন্ত্র পরিচালকদের স্থায়ী সম্মানী ছিল না। এছাড়া কোম্পানির পর্ষদ বা সহায়ক কমিটির প্রতিটি সভায় উপস্থিতির জন্য সম্মানী হিসেবে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পাবেন তারা। এটা কি যথেষ্ট ও যথার্থ হয়েছে?

স্বতন্ত্র পরিচালক যদি যথার্থ অর্থে স্বতন্ত্র এবং যোগ্য হন, যদি ব্যাংক পরিচালনায় প্রকৃত ও ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হন, তাহলে এ সম্মানী যথেষ্ট বলেই মনে করি। অবশ্য এ অংকের সম্মানী যখন দেয়া হতো না, তখনো যোগ্য, সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ স্বতন্ত্র পরিচালকরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে নিরুৎসাহী ছিলেন না। নতুন সম্মানীর বিষয়টা নিবেদিত পরিচালককে আরো নিবিষ্ট হতে উৎসাহ জোগাবে। 

বাংলাদেশে বেশ অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। দেখা গেছে অবকাঠামোর একটি বড় অংশ দেশী ও বিদেশী ঋণে করা। আবার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার। এ বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখছেন? 

ঋণ নেয়া যে সমর্থনযোগ্য নয় তা নয়। ঋণ অবশ্যই নিতে হবে। সবাই নেয়। দেশে যত বড় শিল্পায়ন ঘটেছে, এ শিল্পায়নের একটি বিশাল অংশ ঋণনির্ভর। সুতরাং ঋণ নেয়া বড় ইস্যু নয়। বড় ইস্যু হচ্ছে ঋণটা কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সেই ঋণের অর্থনৈতিক সুবিধা কী সেটা দেখতে হবে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে কিনা সেটা দেখতে হবে। এখন বিদেশী কোনো রাষ্ট্র যখন একটি দেশকে ঋণ দেয়, তারা গ্রহীতা দেশের সক্ষমতা বিবেচনা করে। সুতরাং বাংলাদেশ যে ঋণ পেয়েছে, সেটাকে আমি নেতিবাচক বলব না। বরং বিদেশীরা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই বিবেচনা করেছে এবং বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে সক্ষম বলে গণ্য করেছে বলেই তারা ঋণ দিয়েছে। বাংলাদেশের ঋণ নেয়াকে নেতিবাচক অর্থে দেখি না। বরং ইতিবাচকভাবেই দেখছি। বাংলাদেশের ঋণ গ্রহণযোগ্যতা আছে বলেই সে ঋণ পেয়েছে। এখন দেখতে হবে অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে সেই ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছি কিনা। যদি অর্জন করে না থাকি, বা অর্জন করতে ব্যর্থ হই, সেই অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করার জন্য যা যা করণীয় সেটি সরকারকে করতে হবে। 

তিনটি ঋণমান সংস্থা ফিচ, মুডি’স ও এসঅ্যান্ডপি আমাদের ঋণমান কমিয়েছে। সেটা কি আমাদের বৈদেশিক বিনিয়োগকারী ও ঋণদানকারী সংস্থার কাছে আমাদের অবস্থান ঝুঁকিতে ফেলল বলে মনে হয়? 

ঋণমান তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও কমিয়েছে। ঋণমান কমেছে অবশ্যই। তাতে বিদেশী দাতা ও ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে সাবধানে আচরণ করবে, এটা স্বাভাবিক। তবে নাকচ করে দেয়ার মতো কিছু ঘটবে না। বাংলাদেশ যে সামনে আবার এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাবে সেই বিষয়ে আভাস দিয়েছে বিদেশী সংস্থা। কিন্তু অবশ্যই তাদের এ পূর্বাভাস নির্ভর করবে কতখানি দক্ষভাবে দেশের অর্থনীতিকে পরিচালিত করছি আমরা এবং আমাদের যা যা প্রয়োজন অর্থনীতিকে ঠিকমতো রাখা ও চালানোর জন্য যা সংস্কার করা দরকার সেটি করছি কিনা। তার ওপর নির্ভর করবে বিদেশীরা আমাদের সম্পর্কে যে আভাস দিয়েছে, সেটিকে সত্যে পরিণত করার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। 

আপনি ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন কাজ করছেন? খেলাপি ঋণ ও নন-পারফরমিং লোন (এনপিএল) নিয়ন্ত্রণে আপনার পরামর্শ কী হবে? 

এখানে দুটো বিষয় আছে। বাংলাদেশে ৬০-এর অধিক ব্যাংক আছে। সব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার এক? মোটেই নয়। কিছু কিছু ব্যাংক আছে যাদের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে। ৫ শতাংশ মানে ৫ শতাংশই। অনেক ব্যাংক আছে তারা হয়তো বলছে, তাদের খেলাপি ঋণ ৬ শতাংশ? কিন্তু দেখা যাবে তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ বা ১০ শতাংশ। অর্থাৎ আমি যা বোঝাতে চাইছি, সবগুলো ব্যাংক কমপ্লায়েন্স মেনে খেলাপি ঋণ ঠিকভাবে রিপোর্ট করে না। কিংবা লুকিয়ে রাখার একটি প্রবণতা আছে। সুতরাং মূল বিষয় হচ্ছে, আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, যারা ঋণদানে ব্যাংকের সুশাসন নিশ্চিত করে, তাদের খেলাপি ঋণ সত্যিকার অর্থে কম। যেসব ব্যাংক ঋণদানের সুশাসন নিশ্চিত করে, কারো প্রভাবে ঋণদান করে না, ঋণ আদায়ের সক্ষমতায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে এবং ঋণ দেয়ার আগে বিশ্বমান বজায় রেখে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া নিরপেক্ষভাবে করে, সর্বোপরি এসবের জন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকে—সেসব ব্যাংকে কখনো খেলাপি ঋণ বাড়বে না। 

আমাদের এখানে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কোলাটেরাল বা বন্ধক হিসেবে জমি বা ফ্ল্যাট বন্ধক রাখা হয়। এটা কি টেকসই বা ভালো প্রক্রিয়া বলে মনে করেন? 

আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কোলেটারেল-ভিত্তিক ধারণাটি পুরনো হয়ে গেছে। আগে এককালে ট্র্যাডিশনাল ব্যাংকার যারা আমাদের ব্যাংকিং শিখিয়েছেন, তাদের কাছে একটি জিনিস দেখেছি, কোলেটারেল আছে? আচ্ছা দিয়ে দাও। কিন্তু আধুনিক ব্যাংকিংয়ে এটা অপ্রচলিত হয়ে গেছে। অনেক সময় অভিযোগের সুরে বলা হয়, যথেষ্ট কোলেটারেল রাখা হয়নি। বিষয়টি আসলে কোলেটারেল রাখার ওপর নয়, মূলত দেখতে হবে যে ব্যবসা বা প্রকল্পের জন্য ঋণ নেয়া হবে সেই প্রকল্প বা ব্যবসা বাস্তবসম্মত এবং লাভজনক কিনা। অর্থাৎ সেই প্রকল্প বা ব্যবসা থেকে মুনাফা অর্জন করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা গ্রাহকের আছে কিনা সেটি হচ্ছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন