বিবিএসের সাময়িক প্রতিবেদন

জিডিপির উপাত্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান চিত্র ফুটে ওঠেনি

ছবি : বণিক বার্তা

টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি প্রান্তিক জনগণের উন্নয়ন। অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে আগে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হবে। যারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত, তারা যদি সন্তোষজনক মজুরি পায়, তাহলে উৎপাদনে গতিশীলতা আসবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে কীভাবে সমতার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এখন অনেক বেশি। কোনো দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য নির্ধারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারকে সূচক হিসেবে মানতে নারাজ অনেক অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলনে জিডিপির পরিমাণ সবসময়ই কিছুটা বাড়িয়ে বলার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। মানুষের জীবনের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি কতটুকু বাড়ল তার প্রতি নজর দেয়া উচিত। জিডিপি দিয়ে এগুলো নির্ণয় করা যায় না। আয়বৈষম্য, দারিদ্র্য, পুষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব খাতের ব্যাপারে আমাদের মনোযোগী হতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জিডিপির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ হতে আর কিছুদিন বাকি। এর আগেই চলতি অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা বেড়ে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হবে বলে পূর্ভাবাস দিয়েছে বিবিএস। এ প্রবৃদ্ধি আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সাময়িক হিসাবে বলা হচ্ছে, চলতি অর্থবছরে সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে শিল্প খাতে। শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশে। আগের অর্থবছরে তা ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির হিসাবে সবচেয়ে খারাপ কৃষি খাতে ৩ দশমিক ২১, আগের অর্থবছরে তা ছিল ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৮, আগের অর্থবছরে তা ছিল ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।  যদিও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) বলছে, প্রবৃদ্ধি আরো বেশি হবে। রফতানির ওপর নির্ভর করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১ শতাংশ হবে বলে এডিবির পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে বলে জানিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক এই ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি।

ষাটের দশক পর্যন্ত একটি দেশের উন্নতির পরিমাপক হিসেবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন বেশ জনপ্রিয় ছিল। তবে অর্থনীতিবিদেরা জিডিপি থেকে সরে এসেছিলেন সত্তরের দশকে এসে। কারণ জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা বা মোহ দেশের মধ্যে আয়বৈষম্য বাড়ায়। তবে জিডিপি মানেই উন্নতি—এ ধারণা থেকে সবাই যে বেরিয়ে গেছে, তা বলা যাবে না। জিডিপি নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। তবে বাংলাদেশে এ নিয়ে আলোচনা অবশ্যই অনেক বেশি হওয়া প্রয়োজন। কেননা বাংলাদেশ যেমন সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী কয়েকটি দেশের একটি, তেমনি সর্বোচ্চ আয়বৈষম্যের দেশগুলোরও একটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সবাই যখন প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা ধরনের বুদ্ধিভিত্তিক আলোচনা করছে, তখন আমরা কথা বলছি প্রবৃদ্ধির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে, পরিসংখ্যানের যথার্থতা নিয়ে।

এ অবস্থায় জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধি থেকে আমরা কী পাচ্ছি, তা নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। দৃশ্যমান প্রভাব না থাকলে জিডিপির প্রকৃত অর্জন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। দুভাবে প্রবৃদ্ধির মান বুঝতে পারা যায়। এর একটি আয়বৈষম্য, যা বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে। অন্যটি কর্মসংস্থান, যা উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও তেমন বাড়ছে না। 

উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে রফতানি ও প্রবাসী আয়ের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। শিল্প খাতের উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গেও বেসরকারি বিনিয়োগের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসা পরিচালনার ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ পেছনের সারির একটি দেশ। অথচ ক্রমবর্ধমান মূলধন উৎপাদন অনুপাত (ইনক্রিমেন্টাল ক্যাপিটাল আউটপুট রেশিও) কমছে বলে সরকার বলছে। এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। 

প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে। আবার এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে যেহেতু বিনিয়োগ বেশি হয়নি, সেহেতু শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশি হতে হবে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে এমন কোনো প্রযুক্তি বা উদ্ভাবন যুক্ত হয়নি বা রূপান্তর ঘটেনি যে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৈপ্লবিকভাবে বেড়ে গেছে। আর শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়লে শ্রমিকের আয় বাড়ার কথা। কিন্তু সরকারের তথ্য-উপাত্তই বলছে, বৈষম্য বাড়ছে। সুতরাং যে ধরনের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তাতে আয় ও কর্মসংস্থানের যে চিত্রটি আসে, তা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি দেখাচ্ছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। উৎপাদন সক্ষমতা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান খুব বেশি না বাড়লেও কেবল ভোগ ব্যয়ের ওপর ভর করে বড় প্রবৃদ্ধি অর্জনের হিসাব বিশ্বাসযোগ্য হবে না।

ডলারের দাম বাড়ার মধ্যেও দেশে গড় মাথাপিছু আয় বাড়ল। মাথাপিছু আয়ের হিসাবেও অসংগতি প্রকাশ পায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে দেশে মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৭৮৪ ডলার। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৪৯ ডলার। এক বছরের ব্যবধানে এই আয় ৩৫ ডলার বেড়েছে। অথচ খোলাবাজারে টিসিবির ট্রাক থেকে কম দামে পণ্য কিনতে মানুষের লম্বা লাইন ও সেখানে মধ্যবিত্তের ভিড় বাড়ছে, এ থেকে প্রশ্ন জাগে, ২ হাজার ৭৮৪ ডলার কোথায় গেল বা মাথাপিছু আয় আসলে বাড়ল কাদের? কতজনের বাড়ল? গত অর্থবছরের তুলনায় এবার মাথাপিছু আয় ১ দশমিক ২৬ শতাংশ বাড়ল কীভাবে? হয়তো ধনী ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে অনেক বৈষম্য এবং তথ্যের বিভ্রাটও থাকতে পারে। 

দেশের জিডিপি প্রকাশে বাংলাদেশে ব্যয় নিরূপণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ বর্তমান বাজারে চূড়ান্ত পণ্যের মূল্যই জিডিপি হিসাব করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এতে কোনো কারণে এমনকি মূল্যস্ফীতির কারণেও পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ব্যয় বেড়ে যায়, ফলে জিডিপি বেড়ে যায়। কোনো কিছু না করেও মূল্যস্ফীতির ব্যর্থতা জিডিপি বাড়াতে সহায়তা করে।

দেশের জনসংখ্যার মধ্যে রয়েছে ভিক্ষুক, শ্রমিক থেকে শুরু করে হাজার কোটি টাকার মালিকও। এই বিশাল বৈষম্যপূর্ণ জনসংখ্যার সমষ্টি দিয়ে জাতীয় আয়কে ভাগ দিলে একটি ফল পাওয়া যাবে ঠিকই, তবে তা দেশের বাস্তব চিত্র নয়। অধিকন্তু ধনী ও অতিধনীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাড়ছে গরিবের সংখ্যাও। একই সঙ্গে সমাজে বৈষম্য ও মানুষের আয়ের ফারাক অনেক বেশি হচ্ছে, যার প্রতিফলন সরকারি পরিসংখ্যানে হচ্ছে না। সেজন্যই মাথাপিছু আয় মানুষের কাছে গুরুত্ব পায় না। বিনিয়োগ বাড়ছে না, সরকারের রাজস্ব আয় কম, বাড়ছে না মানুষের আয়, সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে মূল্যস্ফীতি অথচ রাতারাতি বেড়ে যাচ্ছে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়। মানুষের মাথাপিছু এই আয় বর্তমান বাজারের প্রকৃত চিত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে সন্দেহ তা অযৌক্তিক নয়। বেশ অনেকদিন ধরেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে বলার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সে কারণে বিশ্বব্যাংক বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) হিসাবের সঙ্গে প্রতি বছরই আমাদের সরকারি হিসাবের পার্থক্য দেখা যায়। বাংলাদেশে যে পদ্ধতিতে জিডিপি হিসাব করা হয় সেখানে অনেক কারসাজির সুযোগ থাকে। আর জিডিপির যেহেতু এখন রাজনৈতিকীকরণ হয়ে গেছে এর থেকে বের হয়ে আসা সহজ হবে না।

জিডিপি নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট সবসময় দেখা দেয়। এ সংকট নিরসন জরুরি। কেননা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা একটা বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান ব্যবস্থা তৈরি করতে পারিনি। দুঃখজনক হচ্ছে, বিশ্ব যখন প্রবৃদ্ধির বাইরে গিয়ে সুখ বা ভালো থাকার উপায় নিয়ে কথা বলছে, আমরা তখন আলোচনা করছি জিডিপির পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। পরিসংখ্যান সঠিক না হলে দেশের প্রকৃত চিত্র জানা যাবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন