ওস্তাদ মনসুরের আঁকা পাখির দুনিয়া

আহমেদ দীন রুমি

ওস্তাদ মনসুরের আঁকা ধনেশ পাখি ছবি: মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট

সতেরো শতকেই বিলুপ্ত হয়ে যায় ডোডো পাখি। হাঁসের মতো দেখতে পাখিটি আগে মরিশাস ও পূর্ব মাদাগাস্কারে ঘুরে বেড়াত। বিলুপ্ত সে পাখিটি আসলে কেমন ছিল, স্বাভাবিকভাবে আজ জানার জো নেই। তবে সেটা সম্ভব করেছে চিত্রকলা। সমকালের দুজন প্রত্যক্ষদর্শী চিত্রকর এঁকেছেন ডোডো পাখির প্রতিকৃতি। তাদের একজন দিল্লির মানুষ ওস্তাদ মনসুর। শুধু ডোডো পাখি নয়, মোগল দরবারে থাকা এ শিল্পী এঁকেছেন হরেক কিসিমের পাখি ও ফুল।

ওস্তাদ মনসুর সক্রিয় ছিলেন ১৫৩০ সাল থেকে ১৬২৪ সাল পর্যন্ত। তিন দশকের বেশি সময়জুড়ে বিস্তৃত ক্যারিয়ারে অবিশ্বাস্য সব চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে আরোহণ করেন অনন্য উচ্চতায়। সম্রাট আকবরের আমলের শেষভাগেই লাভ করেন ওস্তাদ খেতাব। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে দেন নাদিরুল আসার বা স্বীয় যুগে অপ্রতিদ্বন্দ্বী উপাধি। সম্রাটের সংগ্রহে থাকা টার্কি মুরগি ও সাইবেরিয়ান সারসের মতো অনেক পাখি প্রাণ পেয়েছে তার তুলিতে। বলে রাখা দরকার, সাইবেরিয়ান সারসের প্রথম নামকরণ করা হয় ১৭৭৩ সালে, নামকরণ করেন পিটার সাইমন প্যাল্লাস। অথচ তার বহু বছর আগেই ছবি এঁকে রেখে গেছেন ওস্তাদ মনসুর। অন্যান্য কারণেও জীববিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ওস্তাদ মনসুরের শিল্পকর্ম; যে ডোডো পাখির ছবিকে তার অন্যতম অবদান হিসেবে বিবেচনা করা হয, মনে করা হয় তা সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে এসেছিল পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রিত গোয়া হয়ে। ইংরেজ পর্যটক পিটার মুন্ডি সুরাটে দুটি ডোডো পাখি দেখেছেন। মুন্ডি সুরাটে ছিলেন ১৬২৮-৩৮ সাল পর্যন্ত। ডোডো ও সাইবেরিয়ান সারস দুটোই নিখুঁত ও বিস্তৃত। সাইবেরিয়ান সারস তো এতটাই বিস্তৃত যে পায়ের চামড়ায় থাকা দাগ ও চোয়ালের কাছে থাকা ছোট পশমও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। চিত্রকর্মটি বিশিষ্ট শিল্প-ঐতিহাসিক ইবি হাভেল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখান, যা তাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।

ওস্তাদ মনসুরের কাজের পরিসীমা ব্যাপক। ১৬১৯ সালে যখন জাহাঙ্গীরের প্রিয় বাজপাখিটি মারা যায়, তখন ওস্তাদ মনসুর এঁকে দেন বাজপাখিটিকে। সম্রাটের সংগ্রহে থাকা জোড়া সারসের প্রতিকৃতিও আঁকেন তিনি। ইথিওপিয়ার তুর্কি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনা একটি জেব্রা উপহার এসেছিল দরবারে। বিচিত্র সুন্দর সে প্রাণীটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন সম্রাট। জেব্রাটির ছবিও প্রাণ পায় মনসুরের হাতে। সময় পেলেই সম্রাট কাশ্মীরে বেড়াতে যেতেন; স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গে নিয়ে যেতেন ওস্তাদ মনসুরকে। এভাবে মনসুর কাশ্মীরের প্রায় ১০০টি ফুলের ছবি এঁকেছেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল টিউলিপ। ওস্তাদ মনসুরের আঁকা ভারতীয় একটি গিরগিটির ছবি পাওয়া গেছে, যেটিতে এত চমৎকারভাবে গিরগিটির শরীরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠেছে, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। মনসুরের আঁকা সব পাখিই যে বাস্তব, তা না। কিছু পাখি তিনি এঁকেছেন কল্পনার মিশেল থেকে। কিছু ক্ষেত্রে রঙ ব্যবহার করেছেন সৌন্দর্য বিবেচনায়। তবে স্টাইলের দিক থেকে তার পাখিগুলো খুবই বিস্তৃত ও প্রতিটি সূক্ষ্ম বিষয়কে হাজির করেছেন। পাখিগুলো দাঁড়ানো কিংবা খাওয়ার ভঙ্গিতে।

বিশ্বাসের দিক থেকে উদারনৈতিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন সম্রাট আকবর, স্থাপত্যকলার অনন্য নজির স্থাপন করেন শাহজাহান। জাহাঙ্গীরের আমলে নান্দনিক সে ধারা ঠাঁই নেয় চিত্রকলার ওপর। ফলে ব্যাপক বিস্তার বিকাশ দেখা যায় চিত্রকলায়। চিত্রকর হিসেবে মোগল দরবারে কেবল ওস্তাদ মনসুর ছিলেন না; ছিলেন আবুল হাসান, ফররুখ বেগ, গোবর্ধন, ইনায়াত, মনোহর, মুহম্মদ নাদির ও মুরাদের মতো চিত্রশিল্পীরা। তবে জাহাঙ্গীরের কাছে মনসুর ও আবুল হাসান ছিলেন ব্যতিক্রমী চিত্রকর। সম্রাট তাকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘নাদিরুল আসার’; সত্যিকার অর্থেই তিনি নাদিরুল আসার হয়ে টিকে আছেন। তিনি কতটা প্রতিভাবান ও গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ছিলেন তার জন্য আরো একটা উদাহরণ দেয়া যায়। আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালে তার সম্মানে ‘বুধ’ গ্রহের একটি ক্রেটারের নাম রাখে ‘মনসুর’।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন