বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গলবিল প্রদাহের জন্য ভাইরাস দায়ী

ডা. সাদিয়া সুলতানা রেশমা

ছবি : সংগৃহীত

আমরা সবাই কখনো না কখনো গলা ব্যথা অনুভব করেছি, যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় ফ্যারিনজাইটিস বলা হয়। শীতকালীন দেশে বছরের ঠাণ্ডা মাসগুলোয় ঘটলেও আমাদের মতো ষড়ঋতুর দেশে আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে অনেকেই আক্রান্ত হয় ফ্যারিনজাইটিসে। 

ফ্যারিনজাইটিস

গলনালিতে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাল সংক্রমণের কারণে প্রদাহ সৃষ্টি হলে তাকে চিকিৎসা পরিভাষায় ফ্যারিনজাইটিস বলে। 

এতে কখনো টনসিল ফুলে যেতে পারে এবং ঢোক গিলতে অসুবিধা হয়।

গলা ব্যথা কিন্তু শুধু ফ্যারিনজাইটিস নয়, গলার অন্য অংশকেও আক্রান্ত করতে পারে। সে অনুযায়ী তিন ধরনের সমস্যা বা উপসর্গ হয়—

ফ্যারিনজাইটিস

এটি ফ্যারিংক্সে প্রদাহের উপস্থিতি (একটি নল যা গলার অংশ, মুখের পেছনে এবং অনুনাসিক গহ্বর)। 

টনসিলাইটিস

টনসিলের প্রদাহ (গলার পেছনের প্রতিটি পাশে অবস্থিত নরম টিস্যু ভরের জোড়া) তাদের মধ্যে ফোলা ভাব ও লাল ভাব সৃষ্টি করে।

ল্যারিনজাইটিস

স্বরযন্ত্রের প্রদাহ (সাধারণত ভয়েস বক্স বলা হয়, ঘাড়ের ওপরের অংশে একটি অঙ্গ যা শ্বাস-প্রশ্বাসে জড়িত, শব্দ তৈরি করে এবং খাদ্যের আকাঙ্ক্ষা থেকে শ্বাসনালিকে রক্ষা করে), যার ফলে এটি ফুলে যায় এবং লাল হয়ে যায়।

এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ প্রকারটি হলো ফ্যারিনজাইটিস। 

ফ্যারিনজাইটিসের কারণ

বর্ষা ও শীতের মৌসুমে গলা ব্যথা খুবই সাধারণ, বিশেষ করে শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা এ সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হয়। পাশাপাশি যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম তারাও অতি সহজে আক্রান্ত হয়। ফ্যারিনজাইটিস সাধারণত ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাল এজেন্ট দ্বারা সৃষ্টি হয় যেমন:

 হাম

 অ্যাডেনোভাইরাস, যা সাধারণ সর্দি ঘটায়

 ইনফ্লুয়েঞ্জা

 মনোনিউক্লিওসিস

 জলবসন্ত

 ক্রুপ যা শিশুদের মধ্যে একটি সাধারণ রোগ

 হুপিং কাশি

ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণেও গলা ব্যথা হতে পারে, যার মধ্যে স্ট্রেপ থ্রোট সবচেয়ে সাধারণ;

ঘন ঘন সর্দি এবং ফ্লুর স্পর্শ, বিশেষত সাইনাস এবং অ্যালার্জিযুক্ত লোকেদের জন্য:

সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোকের এক্সপোজার

অ্যালার্জি, শুষ্ক বাতাস, রাসায়নিক পদার্থ, ধোঁয়া এবং দীর্ঘ সময় ধরে চিৎকার বা কথা বলার কারণে গলার পেশিতে টান পড়াও গলাকে জ্বালাতন করতে পারে এবং গলা ব্যথা হতে পারে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গলবিল প্রদাহের জন্য ভাইরাস দায়ী। তবে ২৫ শতাংশ শিশু ও ১০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কের ক্ষেত্রে স্ট্রেপ্টোকক্কাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার জন্য সৃষ্ট যে গলবিল প্রদাহ হয় (ইংরেজিতে ‘স্ট্রেপ থ্রোট’ নামে পরিচিত), সেটি বিপজ্জনক। কারণ এতে বাতজ্বর হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই স্ট্রেপ্টোকক্কাসের জন্য গলবিল থেকে নেয়া নমুনা পরীক্ষা করতে হয় (স্ট্রেপ থ্রোট কালচার)। 

ফ্যারিনজাইটিসের লক্ষণ

ফ্যারিনজাইটিসের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  অত্যধিক কাশি এবং গলা শুষ্ক ভাব, চুলকানি

  কাশির সময় হাঁচি 

  হালকা সবুজ বা হলুদ শ্লেষ্মা স্রাব

  নাক দিয়ে পানি পড়া

  মাথাব্যথা, ক্লান্তি ভাব 

  শরীরে ব্যথা, জ্বর 

এছাড়া কিছু তীব্র মাত্রার লক্ষণ হতে পারে, যার কারণে অবশ্যই দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন:

  দীর্ঘদিন ধরে জ্বর 

  কাশি ভালো না হওয়া

  সারা শরীরে ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ, প্রদাহ এবং চুলকানি 

  জ্ঞান হারিয়ে ফেলা 

  জয়েন্টে ব্যথা এবং পেশি ব্যথা (প্রায়ই হাঁটু, গোড়ালি, কনুই ও কবজিতে)

  গলায় লিম্ফ গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, যেমন ঘাড়ের পাশে ছোট ছোট পিণ্ড অনুভব করা


ফ্যারিনজাইটিস নির্ণয় বা ডায়াগনোসিস

এ রোগের জন্যে সাধারণত কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। উপরোক্ত লক্ষণের মধ্যে মৃদু উপসর্গের জন্য ঘরোয়া পদ্ধতিই যথেষ্ট। তবে তীব্র মাত্রার হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।

রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি:


শারীরিক পরীক্ষা

র‍্যাশ থাকলে তার ধরন বিবেচনা করে ভাইরাল টেস্ট (নির্দিষ্ট ভাইরাসের জন্য নির্দিষ্ট পরীক্ষা)


  গলার রঙ দেখা সাদা বা ধূসর ছোপ, ফোলা এবং লাল ভাব পরীক্ষা করতে হবে 

  লিম্ফ নোডগুলো পরীক্ষা 

  কান ও নাকও পরীক্ষা করতে হতে পারে৷

  গলা থেকে সোয়াব পরীক্ষা:


যদি ডাক্তার অনুমান করেন যে স্ট্রেপ থ্রোট আছে, তাহলে থ্রোটে সোয়াব সি/এস (গলা থেকে নিঃসৃত পদার্থের একটি নমুনা সংগ্রহ)। 

রক্ত পরীক্ষা

কোনো ধরনের সংক্রমণ আছে কিনা তা নির্ধারণ করতে একটি সম্পূর্ণ রক্ত ​​গণনা (সিবিসি) পরীক্ষা যদি সুস্পষ্ট রোগ নির্ণয় করা না হয়, তবে ইএনটি সার্জন বা একজন অটোলারিঙ্গোলজিস্ট বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে পারেন।

ফ্যারিনজাইটিস চিকিৎসা

রোগীর রোগের মাত্রা মৃদু হলে ঘরে বসেই চিকিৎসা সম্ভব।

  জ্বরের ওষুধ প্যারাসিটামল দেয়া হয়।

  কখনো কখনো ব্যথার ওষুধ লাগতে পারে।

  কুসুম গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে অথবা স্যালাইন দিয়ে গড়গড়া করতে বলা হয়।

  অ্যান্টিহিস্টামিন লাগতে পারে। 

ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে ফ্যারিনজাইটিস হলে সময়মতো ব্যাকটেরিয়ানাশক বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। অন্যদিকে ভাইরাসজনিত গলবিল প্রদাহের জন্য ব্যাকটেরিয়ানাশক ওষুধ কোনো কাজে আসে না। এক্ষেত্রে শুধু উপসর্গ প্রশমনের জন্য ওষুধ দেয়া হয়। ব্যথানাশক ওষুধও প্রয়োজন। কারণ এটি জ্বর কমাতে এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। যেমন:

  প্যারাসিটামল বা অ্যাসিটামিনোফেন 

  আইবুপ্রোফেন

  টপিক্যাল ব্যথানাশক, কাশির সিরাপ এবং গলার স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ফ্যারিনজাইটিসের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।


গলা ব্যথা এড়ানো বা প্রতিরোধ

গলা ব্যথা রোধ করার একমাত্র সম্ভাব্য উপায় হলো রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো। তাই নিচের টিপস অনুসরণ করুন:


  সঠিক পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন, নিয়মিত হাত ধোয়া, মুখ ও মুখ থেকে হাত দূরে রাখুন।

  যারা অসুস্থ তাদের থেকে দূরে থাকুন।

  স্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং অস্বাস্থ্যকর জায়গায় খাওয়া এড়িয়ে চলুন।

  হাইড্রেটেড থাকার জন্য পর্যাপ্ত পানি পান করুন।

  ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খাবেন। 

  ভালোভাবে ঘুমান এবং স্ট্রেস লেভেল কমান।

  পরিবেশগত অ্যালার্জি থেকে দূরে থাকুন, যা থেকে গলা ব্যথা হতে পারে।

  খুব বেশিক্ষণ কথা বলে গলার পেশিতে চাপ না দেয়ার চেষ্টা করুন, কথার মাঝে বিরতি নিন, পানি পান করুন। 


লেখক: বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন