নিরাপদ যাত্রার রেল কি অনিরাপদ হয়ে উঠছে?

সুজিত সাহা I চট্টগ্রাম ব্যুরো

গাজীপুরের জয়দেবপুর স্টেশনে গতকাল টাঙ্গাইল কমিউটার ও পণ্যবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত কোচ ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

সড়কে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ভিড়ে রেলপথে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুহার তুলনামূলক কম। এ কারণে ট্রেনের যাত্রী চাহিদা বেশি। ডি-রেইল বা লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা রেলপথে বেশি হলেও সম্প্রতি মারাত্মক দুর্ঘটনা বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মুখোমুখি, পেছন থেকে ধাক্কা দেয়া কিংবা ক্রসিংয়ের সময়ে অন্য একটি ট্রেনের ওপর চালিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা। কয়েক মাসের দুর্ঘটনার চিত্র পর্যালোচনা করে দেশে রেলের নিরাপদ যাত্রা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ডিসেম্বর থেকে ৩ মে পর্যন্ত পূর্বাঞ্চল রেলে ছোট-বড় মিলিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৫টি, যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে খোদ রেল কর্তৃপক্ষ। চলতি বছর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জানুয়ারিতে তিন, ফেব্রুয়ারিতে তিন, মার্চে দুই, এপ্রিলে ছয় এবং মে মাসে (৩ মে পর্যন্ত) একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।

শুধু একটি ঘটনায় নাশকতার প্রমাণ পাওয়া গেলেও অধিকাংশ দুর্ঘটনা হিউম্যান ফেইলিউরের (মানবসৃষ্ট ভুল) কারণে ঘটেছে। মূলত সিগন্যালিংয়ে ত্রুটি, ভুল সিগন্যাল, সিগন্যাল ওভারশুট, পয়েন্ট সেট করার আগে সিগন্যাল ছাড়াই ট্র্যাপ পয়েন্ট অকুপাইড করাসহ বিভিন্ন কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে। এক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে রেলকর্মীদের পাশাপাশি ট্রেন পরিচালনায় নানা অদক্ষতা উঠে এসেছে।

রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার তথ্য মতে, একসময় ট্রেনের চাকা সরে যাওয়া কিংবা ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা বেশি হলেও সম্প্রতি ট্রেনে বড় দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেশি হচ্ছে। পাশাপাশি ট্রেনে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। ট্রেন উদ্ধারে বিলম্বসহ সেবার মান যথেচ্ছ বিঘ্নিত হচ্ছে। গত ১৭ মার্চ গুণবতী-হাসানপুর সেকশনে বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় একসঙ্গে ২৫টি ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়।

সর্বশেষ গতকাল সকালে জয়দেবপুর স্টেশনে টাঙ্গাইল কমিউটার ও ৯৮১ নম্বর পণ্যবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় ট্রেনের আটটি কোচ ও ট্যাংক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনায় দুজন মারাত্মক আহত হন। তবে এ ঘটনায় অনেক যাত্রী হতাহত হওয়ার ঝুঁকি ছিল। মূলত প্রকল্পের অধীনে দায়িত্বরত পয়েন্টসম্যান ভুল পয়েন্ট সেট করায় দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে দাবি করেছে রেলওয়ে।

তবে এসব দুর্ঘটনার জন্য কম জনবল, অবসরে যাওয়া কর্মীদের দিয়ে কাজ করানো, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ, শত বছর ধরে প্রাপ্য সুবিধা বাদ দেয়া বা কমিয়ে দেয়া, অতিরিক্ত কাজের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাবঞ্চিত করা, কর্মীদের পদোন্নতি বন্ধ রাখাকেও দায়ী করছেন রেলওয়েসংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের অনুমোদিত জনবল ৪৭ হাজার ৬৩৭ জন। সারা দেশে রেল নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। ট্রেনের সংখ্যা ক্রমে বাড়লেও কর্মী সংখ্যা ২৬ হাজারের কিছু বেশি। রেলওয়ে শূন্য পদগুলোয় প্রায় আট হাজারের বেশি টিএলআর (টেম্পরারি লেবার রিক্রুট) পদ্ধতিতে জনবলের মাধ্যমে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, টিএলআর হিসেবে কর্মরতরা একটি নির্দিষ্ট সময় পর রাজস্ব খাতে আত্তীকরণ হয়ে যায়। কিন্তু আদালতের রায় থাকা সত্ত্বেও দশকের পর দশক কাজ করা টিএলআর কর্মীদের রেলওয়েতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না বরং আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে টিএলআর কর্মীদের পরিবর্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন লোকবল নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। রেলের মতো প্রকৌশল ও দীর্ঘ দক্ষতার কাজে নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের দিয়ে কাজ পরিচালনার কারণে দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রেলপথ কি অনিরাপদ হয়ে উঠছে? এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌এখনো দেশের যেকোনো গণপরিবহনের চেয়ে রেল নিরাপদ। হিউম্যান ফেইলিউরসহ বিভিন্ন কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তবে দুর্ঘটনার সংখ্যার তুলনায় হতাহতের পরিমাণ খুবই নগণ্য। আমরা রেলের দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কাজ করছি। তবে কিছু সেকশনের উন্নয়নমূলক কাজ কিংবা প্রকল্পের কাজ বিদ্যমান থাকায় কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলকিং সিস্টেমের পরিবর্তে প্রকল্পের অধীনে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ট্রেন অপারেশন করা হয়। এতে রেলের দায়দায়িত্ব থাকার অবকাশ নেই।’ এরপরও রেলওয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিরাপদ বাহন হিসেবে বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার সঙ্গে যাত্রী পরিবহনে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন তিনি।

বিষয়টি নিয়ে সম্পূর্ণ একমত বাংলাদেশ রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এসএন ভট্টাচার্য। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রেল একটি বিশেষায়িত খাত। স্টেশনমাস্টার, লোকোমোস্টার, গার্ড, পয়েন্টসম্যান, ট্রেন কন্ট্রোলারসহ বিভিন্ন মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা ট্রেনকে সুষ্ঠু পরিচালনায় ভূমিকা রাখে। কিন্তু প্রায় দুই যুগ ধরে এসব কর্মচারীর বিভিন্ন সুবিধা বাতিল, কমিয়ে দেয়াসহ পদোন্নতি আটকে রাখার মতো ঘটনা বাড়ছে। স্টেশনমাস্টাররা ১৯৭৭ সালে সৃষ্ট বেতন বৈষম্যের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে রিট করে। রায় পেয়ে আপিল ও রিভিউ পিটিশন খারিজ হয় ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এখন পর্যন্ত রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ মাস্টারদের দাবি মেনে নেয়নি। আদালত অবমাননার পর কোর্টে গিয়ে রায় বাস্তবায়নের আশ্বাস দিলেও সেটি বাস্তবায়ন করছে না। যার কারণে লোকবল সংকটের সময়েও নিয়োগের পর প্রায় অর্ধেক নতুন সহকারী স্টেশনমাস্টার রেলের চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।’

একই চিত্র দেখা যায়, রেলওয়ের ট্রেন কন্ট্রোলারদের ভাতা নিয়েও। ‘কঠিন প্রকৃতির কষ্টসাধ্য দায়িত্ব’ স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ট্রেন কন্ট্রোলারদের মূল বেতনের সঙ্গে ৩০ টাকা অতিরিক্ত ভাতা দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৩০ টাকার পরিবর্তে কন্ট্রোলারদের তিনটি অগ্রিম ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়। ১৯৮০ সাল থেকে চারটি অগ্রিম ইনক্রিমেন্টকে পার্ট অ্যান্ড পার্সেল পে হিসেবে ভাতা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ট্রেন কন্ট্রোলারদের এসব সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। একইভাবে রেলের রানিং স্টাফদের মাইলেজ সুবিধা কমিয়ে দেয়া, প্রায় ১৬৮টি পদ শূন্য থাকা সত্ত্বেও ১৪ বছর ধরে গ্রেড-৩ থেকে গ্রেড-২-এ স্টেশনমাস্টারদের পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে না। এসব কারণে ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন রানিং স্টাফ নেতারা।

ঝুঁকিহীন ট্রেন ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ রেলকর্মী মেইনটেইনার সিগন্যাল (এমএস)। ২০২০ সালে আদালতের রায়ে এমএসরা নিয়মিত কর্মী হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করেন। এসব কর্মী আগে ১২ ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় কাজ করতেন। এ হিসাবে প্রতিটি রেলস্টেশনে ন্যূনতম চারজন করে এমএস থাকার কথা কিন্তু সেটি দিতে পারছে না রেলওয়ে প্রশাসন। এ কারণে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় রেলওয়ে স্টেশনগুলো এমএস ছাড়া চলছে। ট্রেন পরিচালনায় সিগন্যাল গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলেও এই পদে দ্রুত নিয়োগ না দিয়ে ট্রেন চলাচল আরো বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন ট্রেন অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত রেলওয়েসংশ্লিষ্টরা।

রেলওয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মীরা অভিযোগ করেন, বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের পরও দক্ষতা উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছে রেলওয়ে। জনবল কাঠামো সংশোধনের পরও এখনো পরিপূর্ণভাবে নিয়োগ শুরু করতে পারেনি। যার কারণে স্বল্প জনবল দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশের এক-চতুর্থাংশ স্টেশন লোকবল সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে আছে। রেলকর্মীদের তিন-চার বছর পরপর রিফ্রেশার কোর্সে পাঠানোর নিয়ম থাকলেও গত দুই দশক সেটি বাস্তবায়ন করছে না কর্তৃপক্ষ। দক্ষ কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন ও পদে নিয়োগ দেয়ার কথা থাকলেও তাদের ফেলে রাখা হচ্ছে অ-গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে। যার কারণে রেল দুর্ঘটনার হার বেড়ে ট্রেন যাত্রা আগের তুলনায় অনিরাপদ হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন