প্রতি ৯৭ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক

শিক্ষক সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে সরকারি কলেজগুলোয়

ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

ছবি : বণিক বার্তা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পটিয়া সরকারি কলেজ। কলেজটি সরকারীকরণ হয় ৪৪ বছর আগে। বর্তমানে এখানকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষক সংকট। প্রতিষ্ঠানটিতে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এর বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ৪৯ জন। এ অনুযায়ী কলেজটিতে প্রতি ২০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র একজন। 

কলেজটিতে সর্বশেষ নতুন শিক্ষকের পদ সৃজন করা হয়েছিল এটিকে সরকারি করার সময় ১৯৮০ সালে। সে সময়ে এখানে শিক্ষকের পদ সৃজন করা হয়েছিল ৫৬টি। এরপর গত ৫৩ বছরে এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়েছে। যদিও এ সময় নতুন করে আর কোনো শিক্ষকের পদ সৃজন করা হয়নি। এমনকি এখন এ ৫৬ পদের মধ্যেও আটটি শূন্য অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে এ কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রির প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন একজন। অ্যাকাউন্টিংয়ে উচ্চ মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন তিনজন। দর্শনের জন্য শিক্ষকের পদ মাত্র দুটি। এমনকি কলেজটিতে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ ছাড়া আর কোনো অধ্যাপকের পদ নেই।

একই সমস্যায় কম-বেশি ভুগছে দেশের অধিকাংশ সরকারি কলেজ। বাংলাদেশ শিক্ষাতত্ত্ব ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি কলেজগুলোয় শিক্ষক সংকট ক্রমেই বেড়ে চলছে। বর্তমানে সরকারি কলেজগুলোয় প্রতি শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী আছে ৯৭ জন, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৮ সালে দেশে সরকারি কলেজগুলোয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ছিল ১:৭৯।

ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি কলেজগুলোর মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত সবচেয়ে বেশি স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজগুলোয়। এসব কলেজে এখন প্রতি ১১৭ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন একজন। এছাড়া স্নাতক পর্যায়ে ৭৮ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন, ডিগ্রি (পাস) কলেজগুলোয় ৫৫ ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজগুলোয় ৪১ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন করে শিক্ষক রয়েছেন। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভাগীয় ও জেলা শহর পর্যায়ের কলেজগুলোয় পর্যাপ্ত শিক্ষক থাকলেও এর বাইরে অধিকাংশ কলেজেই শিক্ষক সংখ্যা অপ্রতুল। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব কলেজকে সরকারীকরণ করা হয়েছে, সেসব কলেজে সংকট সবচেয়ে বেশি। এর ফলে কলেজগুলোয় শিক্ষার মান যেমন নিশ্চিত হচ্ছে না, তেমনি নিয়মিত ক্লাস না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হারও বাড়ছে।

ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক তালাত সুলতানা বলেন, ‘‌সরকারি কম-বেশি সব কলেজেই শিক্ষক সংকট রয়েছে। বিশেষত শহরের বাইরের কলেজগুলোয় এ সংকট বেশি। সংকট নিরসনে পদ সৃজন, সঠিকভাবে পদায়নের পাশাপাশি দ্রুত নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগে বিশেষ বিসিএসের কথাও বিবেচনা করা উচিত।’

সাম্প্রতিক সময়ে যেসব কলেজ সরকারি করা হয়েছে তাদের মধ্যে একটি বরগুনার আমতলী সরকারি কলেজ। কলেজটিকে ২০১৬ সালে সরকারি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যক্ষ ছাড়া শিক্ষকের মোট পদ ৩১টি। এর মধ্যে ১২টিই শূন্য। প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১৯ জন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত প্রায় ১:১৩০। কলেজটিতে ১১টি বিষয়ের কোনো শিক্ষকই নেই।

এ বিষয়ে আমতলী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমাদের কলেজে যে পরিমাণ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রয়োজন, সে পরিমাণ পদ সৃজন হয়নি। এছাড়া যেসব পদ রযেছে তারও অনেক পদ শূন্য। আমরা বিষয়টি একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। প্রায় প্রতি মাসে চিঠি দিচ্ছি। কিন্তু ২০১৬ সালের পর আর কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। বরং আগে যারা ছিল, তাদেরও অনেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। ফলে শিক্ষক সংকট আরো বেড়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পাঠদান করতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

শিক্ষক সংকট সবচেয়ে বেশি প্রকট হওয়া কলেজগুলোর অন্যতম গাইবান্ধা সরকারি কলেজ। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর জন্য কলেজটিতে শিক্ষক রযেছেন মাত্র ৫৩ জন। ফলে শিক্ষক সংকটে প্রায় নিয়মিতই কলেজটিতে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। কলেজের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কলেজটিতে শিক্ষকের ২৯টি পদ শূন্য রয়েছে। ৮২‍টি শিক্ষক পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ৫৩ জন। কলেজসংশ্লিষ্টদের দাবি এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া মেলেনি।

একই অবস্থা ফেনী সরকারি কলেজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ সরকারি কলেজ, সাতকানিয়া সরকারি কলেজ, নওগাঁ সরকারি কলেজসহ অর্ধসহস্রাধিক সরকারি কলেজের। 

কলেজপ্রধানরা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষক পদ সৃজন না হওয়া, সদ্য নিয়োগকৃতদের কলেজগুলোয় সুষমভাবে বণ্টন না করা এবং দীর্ঘ নিয়োগপ্রক্রিয়া কলেজগুলোর শিক্ষক সংকটের জন্য দায়ী। 

পটিয়া সরকারি কলেজের সদ্য অবসরে যাওয়া অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, ‘‌আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট চাহিদা অনুযায়ী পদ সৃজন না হওয়া। এছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রেও অনেক সময় দেখা যায় যে কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষক রয়েছেন, সেখানে আরো শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ যাদের সংকট রয়েছে, তারা শিক্ষক পাচ্ছে না। যেমন আমাদের কলেজ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বোর্ডে এবং স্নাতক ফলাফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর মধ্যে সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে। সে হিসেবে আমাদের কলেজে সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের না আছে ভালো অবকাঠামো আর না আছে শিক্ষক।’

শিক্ষা খাতে ক্রমহ্রাসমান বরাদ্দ কলেজসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকেই এ ধরনের সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। বরাদ্দ বৃদ্ধি ও পর্যাপ্ত মাত্রায় জনবল নিশ্চিত করা না গেলে এ সংকট আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা তাদের। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক প্রফেসর ড. এম অহিদুজ্জামান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জিডিপির ৪ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু জিডিপিতে শিক্ষায় বরাদ্দ সে তুলনায় অনেক কম। এমনকি আগের তুলনায় এটি বাড়ার পরিবর্তে কমেছে। শিক্ষায় উন্নতি নিশ্চিত করতে হলে জিডিপিতে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।’

শিক্ষক সংকটকে দেশের কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার মান নিশ্চিতের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংকও। সংস্থাটির কয়েক বছর আগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‌বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত অনেক বেশি। এমনকি যেসব শিক্ষক রয়েছেন তাদের মাঝেও যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। 

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল ২০১৯ সালে। ওই সময়ের পর থেকে দেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত আরো বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার মান নিয়ে নানামুখী অভিযোগও। 

কলেজগুলোয় শিক্ষার মান নিশ্চিতে শিক্ষক সংকট দূর করার পাশাপাশি তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘‌আমাদের সরকারি তথা সব কলেজের ক্ষেত্রেই শিক্ষক, বিশেষত প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংকট প্রকট। ফলে শিক্ষার মান নিশ্চিতও চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। এ সংকট দূর করতে হলে আমাদের শুধু শিক্ষক নিয়োগ দিলেই হবে না, তাদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষিতও করতে হবে।’

দ্রুত নিয়োগ ও পর্যাপ্ত মাত্রায় প্রশিক্ষণ নিশ্চিতের মাধ্যমে এ সংকট অনেকটাই দূর করা সম্ভব বলে মনে করছেন কলেজ শিক্ষকরাও। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শওকাত হোসেন মোল্লা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌শিক্ষক সংকট বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত একটি সমস্যা। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেটি আরো বেশি। সরকারি কলেজগুলো অনেক আগের শিক্ষক প্যাটার্ন দ্বারা পরিচালিত। আগের তুলনায় এখন কারিকুলাম ও কোর্সের বিস্তৃতি ঘটেছে, কিন্তু সে তুলনায় শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। আদর্শ শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত যদি ১:৪০-ও ধরা হয়, তাহলে সরকারি কলেজগুলোয় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মানসম্মতভাবে পড়াতে হলে এক লাখের বেশি শিক্ষক প্রয়োজন। অথচ শিক্ষা প্রশাসনসহ সরকারি কলেজগুলোয় মোট শিক্ষকের সংখ্যা ১৬ হাজার। সরকারি কলেজগুলোয় যেখানে অনার্স-মাস্টার্স আছে, সেখানে পদ সংখ্যা থাকার কথা কমপক্ষে ১১টি। অথচ দুঃখজনকভাবে শিক্ষকের সংখ্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চারজন। কোথাও কোথাও দুজন দিয়ে চলছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘‌এক্ষেত্রে আমি মনে করি তিনটি কাজ করা উচিত। প্রথমত, মাউশি যেভাবে পদসৃজনের প্রস্তাব করছে, সেভাবে পদসৃজনের কাজ দ্রুত শেষ করা। দ্বিতীয়ত, যেখানে-সেখানে অনার্স কোর্স বন্ধ করা দরকার। সর্বশেষে শিক্ষার্থী ভর্তির আসন সংখ্যা যৌক্তিকভাবে সীমিত পর্যায়ে নামিয়ে আনা।’

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের কলেজ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।  

তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কলেজ শাখার উপপরিচালক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘‌সরকারি কলেজে শিক্ষক সংকট নিরসন এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে সরকার সচেষ্ট। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষক সংকট নিরসনে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং কীভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ সংকট নিরসন করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা চলছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন