সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে সাশ্রয়ী হতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে দেশে নির্মাণ করা হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। গত পাঁচ বছরে দেশে সৌরবিদ্যুতের বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এসব প্রকল্প থেকে সরকার বিদ্যুৎ ক্রয় করছে উচ্চ মূল্যে। নতুন যেসব সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে, সেগুলোরও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি হচ্ছে কিলোওয়াট প্রতি ঘণ্টা ১০-১১ টাকা, যা দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে ব্যয়বহুল। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় সৌরবিদ্যুতের দাম তিন গুণের বেশি। তাহলে কি বাংলাদেশে কম দামে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও ক্রয় চুক্তি সম্ভব নয়? খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌরবিদ্যুতের উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেশকিছু নীতি এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা গেলে বাংলাদেশেও কম মূল্যে সৌরবিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করা সম্ভব।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং ক্রয় চুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করতে হবে, যা প্রতিবেশী দেশ ভারতে রয়েছে। ভারতে সরকারি কোম্পানিগুলো সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে দরপত্র আহ্বান করে থাকে। যেখানে দরপত্র চূড়ান্ত পর্যায়ে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের সর্বনিম্ন মূল্যকে প্রাধান্য দেয়া হয়। একই সঙ্গে দরপত্রে কোথায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে, গ্রিড লাইন পর্যন্ত পৌঁছাতে ইউনিটপ্রতি কত অর্থ খরচ হবে সেটি বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করে দরপত্র চূড়ান্ত করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তার কেন্দ্র নির্মাণে প্রকল্প ব্যয়, বিশেষত জমির দাম, অবকাঠামো নির্মাণ, পরিচালন ব্যয় এবং নির্দিষ্ট সময় হিসাব করে বিদ্যুৎ ক্রয়ে সরকারকে প্রস্তাব দেয়। বিশেষ বিধানের আওতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির প্রস্তাব দেয়। ফলে এখানে প্রতিযোগিতার কোনো সুযোগ থাকে না। প্রস্তাবকারী কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো অনুমোদিত হয়, যে কারণে সৌরবিদ্যুতের দাম বেশি পড়ে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করতে হলে বিদ্যুতের বিশেষ আইন বা বিধানকে উঠিয়ে দিতে হবে। কারণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরির ক্ষেত্রে এ বিশেষ বিধান বা আইনটি প্রতিবন্ধক। 

গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ছয়টি সৌরবিদ্যুৎ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সোলার এনার্জি করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার (এসইসিআই) ক্রয় চুক্তিতে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে দশমিক শূন্য ৩২ সেন্ট। সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী ভারতীয় মুদ্রায় এ মূল্য দাঁড়ায় প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) ২ রুপি ৬০ পয়সা। আর বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ টাকা ৫২ পয়সায় (প্রতি ডলার = ১১০ টাকা ধরে)। বাংলাদেশেও তিনটি উপজেলায় মোট ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার তিনটি (প্রতিটির সক্ষমতা ১০০ মেগাওয়াট) সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিতে অনুমোদন দেয় সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এসব কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে খরচ পড়বে ১০ টাকা ৯২ পয়সা। এতে সরকারের মোট খরচ হবে ১০ হাজার ৬১২ কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো। 

সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে পতিত, অনাবাদি এবং অকৃষিজ জমি ব্যবহারের কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। বিশেষত সৌরবিদ্যুতের প্রসারে যে রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে তা আজও অনুমোদন হয়নি। ফলে সৌরবিদ্যুৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন ধরনের জমি ব্যবহার হবে তারও পরিষ্কার ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের অনেকগুলো সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও অনুমোদন হচ্ছে জমির বন্দোবস্ত না করেই। অনেক ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটছে, যেসব এলাকায় প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়, কাজ করতে গিয়ে জমিসংক্রান্ত জটিলতা মেটাতে খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। একই সঙ্গে প্রকল্পগুলো সঞ্চালন লাইন থেকে অনেক দূরে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে দীর্ঘ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে গিয়েও সেখানে বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। এ খরচ ট্যারিফের ওপর প্রভাব ফেলে, যার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে জমির অধিগ্রহণ ও সংস্থান সরকার নিজেই বন্দোবস্ত করে। এছাড়া সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পাশেই বড় আকারের সঞ্চালন অবকাঠামো রয়েছে। এ কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ও ক্রয় চুক্তিগুলো সাশ্রয়ী মূল্যে তারা করতে পারে। 

সোলার প্যানেলসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ ভারত নিজেই উৎপাদন করে। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগকারীরা দেশটির বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ সহায়তা পেয়ে থাকে। ফলে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় সেখানে কম হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সোলার প্যানেলসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানিনির্ভর। এ খাতের বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পান না। এ কারণে দেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ভারতের চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমাতে প্রয়োজন টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিদ্যমান নানা জটিলতা নিরসনে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই দেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমবে বলে আশা করা যায়। অন্যথায় অপরিকল্পিতভাবে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে গেলে দীর্ঘমেয়াদে তা মুখ থুবড়ে পড়বে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন