মানুষের মস্তিষ্কে আছে অগণিত স্নায়ুকোষ। এসব কোষ থেকে তৈরি হয় ডোপামিন নামক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক রাসায়নিক উপাদান, যা হাঁটাচলা, কথা বলা, লেখালেখি, মেজাজ ও মনোযোগসহ শারীরিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বার্তা পাঠানোর কাজে এ ডোপামিনকে ব্যবহার করে মানুষের মস্তিষ্ক। কিন্তু পারকিনসনসে আক্রান্ত হলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো ধীরে ধীরে মরে যায়। এতে শরীরে ডোপামিন উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে সৃষ্টি হয় নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা।
পারকিনসনস কী?
পারকিনসনস হলো নিউরো ডিজেনারেটিভ বা মস্তিষ্কের স্নায়ুক্ষয়জনিত রোগ। এটি এমন এক শারীরিক অবস্থা যাতে মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়। মস্তিষ্কের একটা নির্দিষ্ট অংশ ঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিলে ধীরে ধীরে স্নায়ুকোষগুলোর মৃত্যু হয়। মস্তিষ্কে রয়েছে অগণিত স্নায়ুকোষ, যা রাসায়নিক উপাদান ডোপামিন উৎপাদন করে। ডোপামিন শরীরের নড়াচড়া ও ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এ ডোপামিনের উৎপাদন যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন সে ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। পারকিনসনস রোগের লক্ষণ শুরুতে বোঝা না গেলেও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। একপর্যায়ে রোগীর হুইলচেয়ারেরও প্রয়োজন হতে পারে।
পারকিনসনস ডিজিজের লক্ষণ ও উপসর্গ
হাত ও পায়ে কাঁপুনি হয়। চোয়াল, ঠোঁট ও থুতনিতেও কাঁপুনি হতে পারে।
হাত ও পা স্বাভাবিকের তুলনায় শক্ত হয়ে যায়। ঘুরতে ফিরতে গেলে বা হাত বাঁকাতে গেলে কষ্ট অনুভূত হয়।
হাঁটার সময় শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে যায়।
হাঁটার সময় আরো কিছু সমস্যা হয়, যেমন ধীরগতিতে থেমে থেমে হাঁটতে হয়, ছোট ছোট পদক্ষেপে হাঁটতে হয়।
কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে যায়। খাবার গিলতে কষ্ট হয়।
ঘুমের জটিলতা তৈরি হয়। হতাশা, উদ্বেগ, উদাসীনতা ও মনোযোগহীনতা তৈরি হয়।
কখনো কখনো স্মৃতি ভুলে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
কোষ্ঠকাঠিন্য ও মূত্রনালির সমস্যা দেখা দেয়।
কারা বেশি ঝুঁকিতে?
৫০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে পারকিনসনস বেশি দেখা যায়।
নারীদের চেয়ে পুরুষরা পারকিনসনসে অধিক আক্রান্ত হন।
পরিবারে পারকিনসনস রোগের ইতিহাস থাকলে এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
বংশগত কারণ থাকলে কম বয়সেও পারকিনসনস হয়ে থাকে।
পারকিনসনস ডিজিজে কী করবেন
পারকিনসনস রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে ওষুধের মাধ্যমে কিছু লক্ষণ প্রশমিত করা যায়। আবার সার্জারির মাধ্যমে মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত কিছু অংশের উন্নতিও করা যায়। তবে তা রোগমুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। পারকিনসনস পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না। তবে নিয়ন্ত্রণে রেখে অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়। তাই পারকিনসনস রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে কালক্ষেপণ না করে একজন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগের ইতিহাস জেনে ও শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পারকিনসনস রোগ সম্বন্ধে নিশ্চিত হলে আপনাকে মেনে চলতে হবে কিছু জীবনযাপন পদ্ধতি। এক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি ও কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক ব্যায়াম খুব উপকারে আসে।
ফিজিওথেরাপি
পারকিনসনস রোগ নিয়ন্ত্রণে ওষুধের পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফিজিওথেরাপি আক্রান্ত ব্যক্তির কর্মক্ষমতা ও ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে তোলে। দুটি পদ্ধতিতে রোগীকে থেরাপি দেয়া যেতে পারে।
১. মেকানিক্যাল থেরাপি
আক্রান্ত ব্যক্তিকে মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে কিছু থেরাপি দেয়া যেতে পারে। যেমন আইআরআর, ওয়াক্স প্যাক, লো লেভেল স্টিমুলেশন ও মাসেল ভাইব্রেটর থেরাপি।
২. ম্যানুয়াল থেরাপি
রোগের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কিছু থেরাপি দেয়া যেতে পারে। যেমন প্যাসিভ মুভমেন্ট অব দ্য জয়েন্ট, স্লো প্যাসিভ স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ, প্রগ্রেসিভ স্ট্রেনদেনিং এক্সারসাইজ, প্যাসিভ জয়েন্ট মোবিলাইজেশন এক্সারসাইজ ও ব্যালান্স এক্সারসাইজ ইন সিটিং ইত্যাদি থেরাপি।
নিয়ম মেনে নিয়মিত ব্যায়াম করুন
একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের কাছ থেকে ব্যায়ামের মাত্রা ও ব্যায়াম করার পদ্ধতি জেনে নিন। ব্যায়াম করার জন্য একটি তালিকা তৈরি করুন এবং তা মেনে চলুন। যেসব ব্যায়াম করতে পারেন—স্ট্রেচিং, স্কোয়াটিং, ব্যালান্সিং ও হাঁটা।
পারকিনসনস ডিজিজ প্রতিরোধে করণীয়
দুশ্চিন্তা কমিয়ে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সাহস বাড়িয়ে তুলুন।
সুস্থ হওয়ার আগ্রহ তৈরি করুন।
স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজ করার চেষ্টা থাকা জরুরি।
নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে দিন শুরু করুন।
হাত, পা, ঘাড় ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন।
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন।
ভিটামিনযুক্ত সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
লেখক: সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, নিউরোলজি বিভাগ, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা