অভিমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় অসম প্রতিযোগিতায় ছেলেমেয়েরা

ড. মো. এরশাদ হালিম

মানুষের মৌলিক অধিকার পাঁচটি—খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। এদের কোনো একটিকেও অগ্রাহ্য করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করা আদৌ সম্ভবপর নয়। এটিই বাস্তবতা। তাই স্থান, কাল, পাত্রভেদে এ পাঁচ মৌলিক অধিকারকে সঠিক পন্থায় সংরক্ষণ ও ভোগ করার নিমিত্তে গ্রহণ করতে হয় নানা সংস্কার। নিতে হয় যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। আর সেটি করতে না পারলে মানুষ তার ফসল সঠিক পন্থায় ভোগ করতে পারে না। উপভোগ করতে পারে না জীবনকে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পিছিয়ে পড়ে কোনো ব্যক্তি, সমাজ বা সম্প্রদায়। 

মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে শিক্ষা। এদের মধ্যে প্রথম চারটি সমগ্র প্রাণিকুলের জন্যই অপরিহার্য, যদিও-বা শীতপ্রধান অঞ্চল ব্যতীত অন্য সব জায়গায় বস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অতটা উল্লেখযোগ্য নয়। শেষেরটি হলো শিক্ষা, যার সঠিক অর্জন ও প্রয়োগের মাধ্যমেই মানবজাতি অন্যান্য প্রাণিকুল থেকে স্বাতন্ত্র‍্য লাভ করে। তাই শিক্ষা অমূল্য এক সম্পদ, জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতিই সামনে অগ্রসর হতে পারে না। কারণ শিক্ষাই মানুষের ভেতরকার সুপ্ত আত্মাকে জাগরিত করে। বিকশিত করে তোলে সব প্রতিভাকে। মানুষকে ভালো আর মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়। তাদের অন্ধকার থেকে আলোর জগতে নিয়ে আসে এবং করে তোলে বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন। এজন্য প্রতিটি জাতির জন্যই শিক্ষা ব্যবস্থা হওয়া উচিত সর্বজনীন। যদি সেটা সম্ভবপর না হয় তবে কোনো সমাজ বা জাতিই প্রকৃতপক্ষে আলোর মুখ দেখতে পায় না। তাই সময়ের প্রয়োজনে কখনো উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার অনুসরণে আবার কখনো-বা দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদদের দেয়া ফর্মুলা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামেও বারবার আনয়ন করা হয়েছে নানা সংস্কার। এ সংস্কার সাধিত হয়েছে কখনো দীর্ঘমেয়াদে, কখনো স্বল্পমেয়াদে, আবার কখনো-বা দৈবদুর্বিপাক চলাকালে। এরই ধারাবাহিকতায় আমার দেখা মতে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে এসএসসি লেভেলে প্রথমবারের মতো প্রতি বিষয়ে ৫০ শতাংশ অবজেকটিভ কোর্স পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল এবং ফাইনাল পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ের এই অবজেকটিভ পার্ট মূল্যায়নের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫০০ প্রশ্নের এক সিলেকটিভ প্রশ্ন ব্যাংক। ফলাফল প্রকাশের পর চোখে পড়ার মতো ছিল বর্তমান গোল্ডেন জিপিএ ৫-এর মতো তৎকালীন স্টার (৭৫ শতাংশ ও তদূর্ধ্ব নম্বর) প্রাপ্তদের গণজোয়ার, যাদের অনেকেরই তৎকালীন সদ্য ভূতপূর্ব পরীক্ষা পদ্ধতিতে দ্বিতীয় বিভাগে (৪৫ থেকে ৫৯ শতাংশ নম্বর) পাস করার যোগ্যতাও হয়ত-বা ছিল না। পরবর্তী পর্যায়ে খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে এ ছাত্রছাত্রীরাই যখন এইচএসসি লেভেলে শুধু সাবজেকটিভ কোর্স পদ্ধতিতে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল তখন হঠাৎ করেই দেখা গিয়েছিল গণফেলের অভিনব এক উত্থান। পুরো বিপরীতধর্মী দুটি চিত্র। এবারে করোনা পরিস্থিতির কারণে এসএসসি ও এইচএসসি লেভেলে প্রণীত শর্ট সিলেবাস পদ্ধতিতে পরীক্ষা আয়োজনের ক্ষেত্রেও সেই একই ফলাফলের প্রতিচ্ছবি অনেকটাই যেন প্রত্যাবর্তিত হয়েছে। এখানে মেধা যাচাইয়ে সত্যিকারের ভালো আর মন্দের মধ্যে কোনো ধরনের পার্থক্য আদৌ দৃশ্যমান হয়নি। যারা শিক্ষক বা অভিভাবকদের অথবা উভয়ের সহযোগিতায় সরাসরি মূল বই পড়ে নিজেদের ভিত্তি নিজেরাই তৈরি করে সত্যিকার অর্থেই ফলাফল ভালো করেছে এবং যারা স্পুন ফিডিংয়ের মতো বিভিন্ন কোচিং সেন্টার হতে গৃহীত হাতে গোনা কিছু শিট গৎবাঁধা মুখস্থ করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অপ্রত্যাশিতভাবে ভালো করেছে, মূলত এ দুই শ্রেণীর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে ফলাফলে কোনো ব্যবধান বাহ্যিকভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। অটোপাসের কথা নাই-বা উত্থাপন করলাম। জাতির ক্রান্তিলগ্নে বৃহত্তর স্বার্থে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষকে অনেক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করতে হয়, যা অনেকটা ম্যালেরিয়ার কুইনাইন সেবনের মতো। ফলে পুরো বিষয়টা এমন যে বন্যার সময় বুড়িগঙ্গাসহ ম্যানহোলের পানি আর তথাকথিত অভিজাত পাড়ার বিলাসবহুল ফোয়ারার পানি যেমন একাকার হয়ে যায়, হয়তো-বা তেমনটাই হয়েছে। আর এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। পরবর্তী পর্যায়ে এ শিক্ষার্থীরাই যখন নিজ নিজ দুর্বল ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে বীরদর্পে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য কোনো রকমের চেষ্টা করেছে ঠিক তখন ধপাস করেই মর্ত্যের বুকে পতন ঘটেছে মহাশূন্যের এসব সদ্য সাবেক তারকাদের। স্থবির হয়ে গেছে অনেকেরই কাঙ্ক্ষিত পথযাত্রা। এসব ছাত্র-ছাত্রীই যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষার্থে স্নাতক লেভেলের একাধিক ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে তাদের অনেকেই ধরে রাখতে পারেনি তাদের ভূতপূর্ব সাফল্যের ধারাবাহিকতা। অনেকের ক্ষেত্রেই অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটেছে তার ছন্দপতন। মূলত প্রায় ৩০ বছর আগের সেই পুরনো দৃশ্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দিল।

এমনটা তো হবেই। ঘটে কিছু না থাকলে যা হওয়ার শুধু তাই-ই হয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে, অন্যের ওপর ভর করে খুব বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায় না, যেমনটা হয় কোনো মোটরযানের ইঞ্জিন দুর্বল হলে। সাময়িকভাবে ধার করা শক্তি দিয়ে গাড়ি খুব বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না। একইভাবে অনুপ্রেরণার নামে বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে আরোপিত এমন মানসিক চাপের শিকার হয়ে যারা এভাবে স্কুল, কলেজ পর্যায়ে গোল্ডেন জিপিএ ৫ বা সমমানের ফলাফল অর্জন করে আসে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা সমমানের প্রতিষ্ঠানে স্নাতক লেভেলের ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিযোগিতার বাজারে তারা কোনোভাবেই নিজ নিজ অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই অনেকটা একই দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। তাই যেনতেনভাবে শুধু গোল্ডেন জিপিএ ৫ অর্জনই যেন শিক্ষাজীবনের মূল উদ্দেশ্য না হয়। আমাদের অভিভাবকদের উচিত শুধু গোল্ডেন জিপিএ ৫-এর ওপর ষোল আনা গুরুত্ব না দিয়ে ছেলেমেয়েদের ভিত গড়ার দিকে বেশি নজর দেয়া। ভালো ফলাফল করা তো দোষের কিছু নয়। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা ভালো ফলাফলের নিমিত্তে অব্যাহত চেষ্টা ও প্রতিযোগিতা করবে। এটাই স্বাভাবিক পন্থা। তবে সেটা অবশ্যই হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। আমাদের সময়ে আমি নিজেও তৎকালীন দু-দুবারের বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছাত্র ছিলাম। এটা অবশ্যই ছিল আমার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, প্রতিযোগিতা ও সাধনার ফসল। ভালো ফলাফল তো সত্যিকার অর্থেই মেধার বহিঃপ্রকাশ, যেমন ভাবা হয় নিরপরাধ মুখচ্ছবি পরিচ্ছন্ন মনের আয়নাস্বরূপ। তবে সেটা হতে হবে শিক্ষার্থী কর্তৃক অর্জিত স্বকীয়তার ভিত্তিতে। অন্যথায় পুরো বিষয়টাই হতে পারে আত্মঘাতী। এভাবে সবাইকে জোর করে ভালো করতে বা করাতেই হবে এমন ধারণা অনেক ক্ষেত্রেই জন্ম দিতে পারে অসুস্থ এক প্রতিযোগিতার। এতে করে আমাদের কোমলমতি শিশুদের রীতিমতো মানসিক নির্যাতন করা হয় এবং আমাদের দ্বারা আরোপিত এ অতিরিক্ত চাপের কারণে বাধাগ্রস্ত হয় তাদের মেধার সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ। অকালেই ঝরে পড়ে বহু উদীয়মান প্রতিভা। রাষ্ট্র ও জাতি হারায় তার প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ এবং সুনাগরিক গঠনের মূল উপাদান। একসময় বিশ্ব প্রতিযোগিতার বাজারে মুখ থুবড়ে পড়ে পুরো দেশ ও জাতি।

উপরন্তু, যেনতেন প্রকারে গোল্ডেন জিপিএ ৫ বাগিয়ে নেয়া শোভনীয়ও নয়। যদি এমন হয় তবে তার মানকে রীতিমতো ছোট করা হবে। এটা কাউকে নিজের চেষ্টা ও যোগ্যতায় পারিপার্শ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে ডিজার্ভ করে নিতে হয়। যদি সেটা করতে না পারে তবে তার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠনের নিমিত্তে বিকল্প কোনো কর্মপন্থা বা কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা মাথায় আনতে হবে। উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থা সবার জন্য অত্যাবশ্যকও নয়। তবে সংবিধান মতে, অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ন্যূনতম শিক্ষা ব্যবস্থা সর্বজনীন হওয়া বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি এভাবে কাউকে জোর করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। এটা পণ্ডশ্রম বৈকি আর কিছুই নয়। যে নদী স্রোত হারিয়ে মরুপথে, হঠাৎ করেই ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিলে সে তার উপচে পড়া জোয়ার হজম করতে পারে না। জন্ম দেয় বন্যার ন্যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের। ডেকে আনে মহাবিপর্যয়। 

একইভাবে আমাদের কোমলমতি শিশুদের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ভালো কিছু করার অপপ্রয়াসে আমরাও তৈরি করছি সার্টিফিকেটধারী অসুস্থ এবং অথর্ব এক প্রজন্ম যা জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়নকে করছে বাধাগ্রস্ত। নিজেদের অগোচরেই ধ্বংস করে দিচ্ছি অনেক সুপ্ত প্রতিভা ও মেধাসম্পদ। দেশ ও জাতি বঞ্চিত হচ্ছে মেধাসম্পদের সঠিক ও সুষ্ঠু বিন্যাস ও প্রয়োগ থেকে। এ অবস্থান থেকে আমাদের এখনই দূরে সরে আসা উচিত। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতেই আমাদের এর চরম মূল্য দিতে হবে। প্রভাব পড়বে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপরও। বিষয়টিকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখার বিন্দুমাত্র কোনো অবকাশ নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এখন থেকেই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক সবাইকে একযোগে সচেতন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ধরনের কর্মশালা, সেমিনার কিংবা সিম্পোজিয়াম আয়োজনের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে পুরো বাস্তবতা। তাদের বোঝাতে হবে যথাযথ পদ্ধতি অবলম্বন করেই আমাদের সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। অন্যথায় আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েরা একসময় হারিয়ে ফেলবে পড়াশোনার সুস্থ ও স্বাভাবিক গতি। ভীতি সঞ্চার হবে জোর করে মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার প্রতি। একসময় লেখাপড়ার মাঠ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের এসব খুদে কারিগররা। তাই এ ব্যাপারে এখন থেকেই আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় সব পর্যায়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শারীরিক, মানসিক ও আবেগিক স্বাস্থ্য এবং তাদের সব ধরনের প্রতিভার সুস্থ বিকাশের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করেই মানবসম্পদ গঠনের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। হতে হবে অনেক বেশি দূরদর্শী। মনে রাখতে হবে, আজকের শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ কারিগর ও অগ্রযাত্রার কাণ্ডারী। যেমনটা কবি বলেন, “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা, সব শিশুরই অন্তরে। 

ড. মো. এরশাদ হালিম: অধ্যাপক ও গবেষক

সিনথেটিক অর্গানিক কেমিস্ট্রি ও কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালস

রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন