অভিমত

ভরা মৌসুমে সবজির অগ্নিমূল্যে অস্থির স্বল্প আয়ের মানুষ

নিতাই চন্দ্র রায়

বাংলাদেশে একসময় শীতকালেই সবজি উৎপাদিত হতো। গ্রীষ্মকালে তেমন সবজির দেখা মিলত না। গ্রীষ্মকালে সাধারণত কুমড়াগোত্রের কিছু সবজি যেমন—চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, ঝিঙা, করলা, কাঁকরোল, উচ্ছে এবং অন্য গোত্রের ডাঁটা, পানি কচু উৎপাদিত হতো। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বীজ কোম্পানিগুলোর বারোমাসি সবজির বীজ উদ্ভাবন, বাজারজাত, সম্প্রসারণ কর্মী ও কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশে সবজি চাষে এক নীরব বিপ্লব সংঘটিত হয়। এখন সারা বছরই পাওয়া যায় প্রায় সব ধরনের সবজি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। 

সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত তখন কিছু লোভী ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগী মজুদদার আটা, তেল, চিনি, চাল, আলু ও পেঁয়াজের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে ভোক্তাকে ফেলেছে মহাবিপদে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার পাইকারিবাজারে মানভেদে আলু ৬২-৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা কেজি দরে। ময়মনসিংহ জেলার হাটবাজারে করলা ১০০ টাকা, টমেটো ৮০, শিম ৮০, মূলা ৩০, বেগুন ৬০, গাজর ৬০ এবং প্রতিটি মাঝারি মানের ফুলকপি ৫০ ও বাঁধাকপি ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। গত বছরও এসব সবজির কেজিপ্রতি দাম ছিল অর্ধেক। বারো মাসের ব্যবধানে দাম বাড়ার হার শতকরা ১০০ ভাগ।

গত ২০ বছর ডিসেম্বরের শেষদিকে আলুর এত দাম কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। আমি সেতাবগঞ্জ সুগার মিলে চাকরির কারণে দেখেছি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, লালমনিরহাট অঞ্চলের কৃষক আমন মৌসুমে আগাম জাতের আমন ধান কাটার পর অক্টোবরের মাঝামাঝি পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ ও মই দিয়ে আগাম জাতের লাল পাকড়ি ও গ্র্যানুলা জাতের আলু রোপণ করেন। রোপণের ৭০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ডিসেম্বরের প্রথমে এ আলু বিক্রি করে কৃষক প্রচুর লাভবান হন। এই সময় পুরনো আলু ১৫-২০ এবং নতুন আলু ৫০-৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়। আলুর দামের সঙ্গে অন্য সবজির দাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আলুর দাম বাড়লে অন্য সবজির দাম বাড়ে। আবার আলুর দাম কমলে অন্য সবজির দাম কমে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৩০০ টন সবজি উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে শীতকালীন সবজির পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টন আর গ্রীষ্মকালীন সবজির পরিমাণ ৭৬ হাজার ৪৭ টন। এ বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে আমন ধানের পরিপক্বতা বিলম্বিত হয়। জমিতে সময়মতো সবজি বীজ/চারা রোপণ করতে পারেননি কৃষক। অনেক সবজির চারাও পচে নষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় মিধিলার কারণে পাকা আমন ধানসহ শীতকালীন সবজির কম ক্ষতি হয়নি। নোয়াখালীর নয়টি উপজেলায় ১ হাজার ২৩৭ হেক্টর ও চাঁদপুরে ৪২০ হেক্টর জমির মৌসুমি সবজিখেত নষ্ট হয়ে যায় মিধিলার প্রভাবে। এছাড়া টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জেও ঘূর্ণিঝড়ে শীতকালীন সবজির বেশ ক্ষতি হয়। 

আমাদের দেশে সাধারণত অক্টোবরের শেষে বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে শীতের শুরু হয়। এ বছর অক্টোবরের ১৮ তারিখে মিধিলার কারণে সারা দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ধান পরিপক্ব হতে বিলম্বিত হয়। পানি জমে থাকার কারণে এ বছর সঠিক সময়ে জমি চাষ করে আগাম শীতকালীন সবজির চাষ করতে পারেননি কৃষক। ফলে নভেম্বর-ডিসেম্বরে বাজারে সবজির জোগান হ্রাস পায় এং চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে সবজির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায় এবং স্বল্প আয়ের মানুষ পড়ে মহাবিপদে। ঘন ঘন হরতাল, অবরোধ এবং সার ও কীটনাশকের দাম বৃদ্ধি সবজির দাম বাড়ার কারণ।

বাংলাদেশে বছরে প্রায় এক কোটি টন আলু উৎপাদন হয়। আমাদের বার্ষিক চাহিদা ৮০-৯০ হাজার টন। এ বছর কোল্ড স্টোরেজগুলোয় ধারণক্ষমতা মোতাবেক আলু সংরক্ষিত ছিল না। কারণ আলুর উৎপাদন ছিল অন্য বছরের চেয়ে কম। যদিও কৃষি বিভাগ বলেছে, গত বছর ১ কোটি ১০ লাখ ৫৮৩ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। 

মে মাসের ২০ তারিখের পর হিমাগার থেকে আলু খালাস শুরু হয় তখন হিমাগার শেডে কাঁচা আলুর দাম ছিল প্রতি কেজি ২৬-২৭ টাকা। এই দরেই প্রকারভেদে আলুর বিক্রয় শুরু হয়েছিল, যা বর্তমানে হিমাগার থেকে ৩৪-৩৬ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আলুর মূল্য বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা, যা কোনো মতেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন মনে করে, মূল্য বৃদ্ধির কারণ হলো যারা আলু সংরক্ষণ করেছে তারা। তারা মনে করছে, আলুর মজুদ কম হয়েছে। সেজন্য তারা আলুর দাম বাড়িয়ে চলছে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী ২০২৩ সালে ২৩ লাখ ১২ হাজার টন আলু বিভিন্ন হিমাগারে সংরক্ষিত হয়েছে। আগের বছর ছিল ২৪ লাখ ১৯ হাজার ৭৬০ টন। এ হিসাবে গত বছরের তুলনায় এবার ১ লাখ ৭ হাজার ২৩৪ টন কম আলু সংরক্ষিত হয়েছে। 

কৃষি বিপণন অদিধপ্তরের তথ্যানুযাযী, ২০২৩ সালে ২৪ লাখ ৯২ হাজার ৮২ টন আলু সংরক্ষিত হয়েছে এবং গত বছর ছিল ২৭ লাখ ৮ হাজার ৫৯৫ টন। এ হিসাবে ২০২২ সালের চেয়ে এবার হিমাগারে ২ লাখ ১৬ হাজার ৫১৩ টন আলু কম সংরক্ষিত হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে অন্যান্য সবজির দামে।

করোনা মহামারীর সময় দেখা গেছে, বগুড়ার বৃহৎ সবজির হাট মহাস্থানে কৃষক যে দামে সবজি বিক্রি করেন, সেই সবজি তিন থেকে চার হাত বদল হয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ভোক্তার কাছে তা দুই-তিন গুণ দামে বিক্রি হয়। বগুড়া থেকে এক ট্রাক সবজি ভাড়া যদি বেড়ে ১২ টাকাও হয় তাহলেও সবজির দাম কোনোমতেই এত বেশি হওয়া উচিত নয়। এটা নেহাত মধ্যস্বত্বভোগীর কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। 

একজন সুস্থ-সবল মানুষের জন্য প্রতিদিন ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু আমরা গ্রহণ করি মাত্র ৫০-৬০ গ্রাম। বিভিন্ন প্রকার খনিজ লবণ ও ভিটামিনের উৎস সবজি। দেশে প্রচলিত চাষ করা সবজির সংখ্যা ৯০টি। এর মধ্যে ৩০-৩৫টি প্রধান সবজি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে ২ কোটি ১৬ লাখ ৭০৩ টন সবজি উৎপাদিত হয়। আর প্রতিদিন ২২০ গ্রাম হিসাবে ১৭ কোটি ৫০ লাখ মানুষের সবজির প্রয়োজন হয় ১ কোটি ৩৮ লাখ টন। মাঠ থেকে উত্তোলন-উত্তর সংরক্ষণের অভাবে উৎপাদিত সবজির ৩০ ভাগ নষ্ট হলেও বছরে সবজির প্রাপ্যতা দাঁড়ায় ১ কোটি ৫১ লাখ টন। বিদেশে সবজি রফতানি হয় বড়জোর দুই লাখ টন। তাহলে বছরে উদ্বৃত্ত সবজির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ টন। এছাড়া দেশে প্রায় এক কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত আলুর সিংহভাগই সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমার মনে হয়, সবজি উৎপাদন ও ভোগের হিসাবের মধ্যে কোনো গরমিল রয়েছে। যদি কৃষি বিভাগের হিসাবকে সত্য বলে মনে করা হয়, তাহলে দেখা যায় দেশে উৎপাদিত সবজির শতকরা ৬৫ ভাগ শীতকালে, ৩০ ভাগ খরিফ-১ মৌসুমে ও বাকি ৫ ভাগ উৎপাদিত হয় খরিফ-২ মৌসুমে। এ কারণে খরিফ-২ মৌসুমে সবজির দামটা অধিক থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই সবজিচাষীদের ন্যায্যমূল্য প্রদান এবং ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে নিম্নলিখিত বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা উচিত।

এক. দেশে বারোমাসি সবজির আবাদ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বগুড়ার মতো বর্ষাকালে পলি হাউজে সবজি চাষ করতে হবে। দুই. সবজি সংরক্ষণে অঞ্চল ভিত্তিতে হিমাগার স্থাপন করতে হবে। তিন. সবজিচাষীদের স্বল্পসুদে কৃষিঋণ প্রদান করতে হবে। 

চার. বারোমাসি সবজির বীজের দাম কৃষকের সাধ্যের মধ্যে রাখতে হবে। পাঁচ. গ্রীষ্মকালীন সবজিচাষীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ছয়. ভোক্তার কাছে সরাসরি বিক্রির জন্য প্রতিটি উপজেলা, জেলা শহরে কৃষক বাজার চালু করতে হবে। সাত. সর্বোপরি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। আট. সবজি উৎপাদনে উত্তম কৃষিচর্চা সঠিকভাবে অনুসরণ কবতে হবে। নয়. সবজি পরিবহনে চাঁদবাজি বন্ধ করতে হবে। দশ. সবজি উৎপাদন এলাকাগুলো থেকে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে সবজি পরিবর্তনের জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কার্গো ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে অনলাইনে সবজি বিক্রয় ও সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

নিতাই চন্দ্র রায়: সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন