পর্যালোচনা

ডব্লিউটিওর মৎস্য ভর্তুকিসংক্রান্ত নতুন চুক্তির সুবিধা ও অসুবিধা

ফেরদাউস আরা বেগম

বাংলাদেশে প্রাণিজ প্রোটিনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসে মাছ থেকে। এছাড়া প্রায় দুই কোটি কর্মসংস্থান হয় এ খাতের মাধ্যমে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নারী। বর্তমানে প্রায় ৪৭ দশমিক ৫৮ টন মাছ উৎপাদন করে এ খাত জিডিপিতে প্রায় ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ অবদান রাখছে। ইলিশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশ্বজোড়া নাম রয়েছে। অন্যান্য দেশীয় উৎপাদন যেমন তেলাপিয়া এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এছাড়া মাছ রফতানিতে প্রায় অর্ধ বিলিয়ন ডলার আয় হয়, যা সামনে আরো বাড়তে পারে। সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তেমন অবদান না থাকলেও সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন প্রায় ৬ দশমিক ৮১ লাখ টন। এ খাতের অবদানকে উপর্যুপরি সামনের দিকে নিয়ে যেতে সরকার ও বেসরকারি খাত কাজ করছে। 

এরই মধ্যে সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য খাত হয়ে উঠেছে যা থেকে আমরা উপকার পেতে পারি, তবে খাতটিতে এখনো তেমন উন্নয়ন সাধন করা যায়নি। বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের সক্রিয় সদস্য। এ পর্যন্ত এলডিসি দেশ হিসেবে আমরা বেশকিছু বেনিফিট নিতে পেরেছি। তবে এলডিসি-উত্তরণ পরবর্তী সময়ে কীভাবে তৈরি হতে হবে সেখানে প্রস্তুতি একটি জরুরি বিষয়। এ ব্যাপারে একটি কোর কমিটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্থাপিত হয়েছে এবং কাজ করছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে মন্ত্রী পর্যায়ের ১৩তম কনফারেন্স, যা প্রতি দুই বছর পর অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সে বাংলাদেশ বরাবরের মতো এবারো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার আশা রাখে। ২০২৬-এর নভেম্বরে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে ১৪তম কনফারেন্সে বাংলাদেশের সর্বশেষ এলডিসি হিসেবে যোগদানের সুযোগ থাকবে। এরপর বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এই কনফারেন্সে যোগ দেবে। তাই নতুন বিষয়গুলোর প্রতি বাংলাদেশ গভীর মনোযোগের সঙ্গে অনুসরণ করে যাচ্ছে। এ রকম একটি বিষয় হলো ফিশারিজ এগ্রিমেন্ট। 

গত ১২তম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে (এমসি-১২), মৎস্য ভর্তুকির ওপর একটি নতুন চুক্তি এগ্রিমেন্ট অন ফিশারিজ সাবসিডিতে (এএফএস) সম্মত হয়েছে এবং ২০২২ সালের ১৭ জুন তা প্রচার করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া পরবর্তী মন্ত্রী পর্যায়ের মিনিস্টারিয়াল কনফারেন্স বা এমসি-১৩-তে চুক্তির অবশিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। চুক্তিটির জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অর্থাৎ কমপক্ষে ১০৯ ডব্লিউটিও সদস্য দেশের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। এখন পর্যন্ত ৪০টি সদস্য দেশ চুক্তিটি অনুমোদন করেছে। নতুন মৎস্য ভর্তুকি চুক্তিতে (ধারা ১২) উল্লেখ করা হয়েছে, যদি এ চুক্তি কার্যকর হওয়ার চার বছরের মধ্যে ব্যাপকভাবে সমর্থন না পায় হয় এবং সাধারণ পরিষদ দ্বারা গৃহীত না হয়, তবে চুক্তিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। 

মৎস্য ভর্তুকি ২০০১ সালে ডব্লিউটিওর গ্রুপে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ২০০৫ সালে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা শুরু হয়। ২০১৫ সালে ইউএন এসডিজি গ্রহণ এবং এসডিজি ১৪ দশমিক ৬-এর মাধ্যমে একটি নতুন আদেশ যেখানে পরিবেশগত দিক থেকে ঝুঁকি বিবেচনা করে অবৈধ আনরিপোর্টেড অ্যান্ড আনরেগুলেটেড (আইইউইউ) মাছ ধরার জন্য অতিরিক্ত ক্ষমতা এবং অতিরিক্ত মাছ ধরার জন্য মৎস্য ভর্তুকি নিষিদ্ধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার ভিত্তিতে এটি জোরদার হয় এবং খসড়া চুক্তি হিসেবে প্রকাশ পায়।

চুক্তিতে ভর্তুকি অর্থাৎ সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের বিষয়টি মূলত এ মাছ ধরার জন্য বোঝানো হয়েছে, অভ্যন্তরীণ জলজ চাষের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। যেকোনো জিটুজি চুক্তিও এর আওতার বাইরে থাকবে। নতুন চুক্তিটি চূড়ান্তভাবে শেষ হলে বাংলাদেশের সামুদ্রিক মাছ ধরার ওপর প্রভাব ফেলবে। 

বংশবিস্তারের তুলনায় অত্যধিক মাছ ধরার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে মাছের মজুদ ধসে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি আনুমানিক পরিসংখ্যান দেখা যায় যে বিশ্বব্যাপী মাছ মজুদের প্রায় ৩৪ শতাংশ অতিরিক্ত ধরা হচ্ছে, যা ১৯৭৪ সালে ছিল ১০ শতাংশ। অন্যদিকে মূল্যায়নকৃত মজুদের প্রায় ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত মাছ ধরা হচ্ছে। এত অধিক হারে মৎস্য আহরণ নানা সমস্যা তৈরি করতে পারে এবং এর পরিবেশগত বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভর্তুকির বিভিন্ন ধরন রয়েছে। বেশ কয়েকটি দেশ বিভিন্ন উপায়ে ভর্তুকি দিচ্ছে। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বন্দরে প্যাকেজিং, প্রক্রিয়াকরণ, মাছ পরিবহনের আকারেও ভর্তুকি দেয়া হয়ে থাকে। গভীর সাগরে মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের জাহাজ, নৌকা এবং অনুরূপ অন্যান্য সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়। দক্ষ অপারেটরও এ জাহাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা হয়। এগুলোর ক্ষেত্রে ভর্তুকি সমভাবে সব দেশের জন্য প্রদান সম্ভব নয়। যেসব দেশ এদিক থেকে পারদর্শী তারাই এ সুযোগ পুরো ব্যবহার করতে পারছে। বাংলাদেশের সক্ষমতা এদিক থেকে অনেক পেছনে।

তথ্যের বিভিন্ন উৎস থেকে এটি পাওয়া যায় যে ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় ৩৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে, যার মধ্যে চীনের আধিপত্য উল্লেখযোগ্য। অন্য দেশগুলো হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, কোরিয়া প্রভৃতি (সূত্র: ইআরডি সেমিনার)। ডব্লিউটিওর আসন্ন মৎস্য চুক্তিতে আইইউইউকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা পরিহার করার ক্ষেত্রে এ চুক্তি কাজ করবে।

রাষ্ট্রের অনুমতি ব্যতীত বা তার আইন ও প্রবিধান লঙ্ঘন করে যদি কার্যকলাপগুলো পরিচালিত হয় তবে সেগুলো আইইউইউ হিসেবে বিবেচিত হবে। আইইউইউর পরিমাণ বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে (অনুচ্ছেদ ৪ দশমিক ২) নির্ধারিত হবে যাতে মাছের স্টক অনেক বেশি ধরা হলে তার স্বরূপ খুঁজে বের করা যায়। এর মানে হলো, কোনো সদস্যদেশ মাছ ধরা বা মাছ ধরা সম্পর্কিত কার্যকলাপের জন্য একটি মূল্যবান সদস্যের এখতিয়ারের বাইরে যেতে পারে না। এখানে Regional Fisheries Management Organization or Arrangement (RFMO/A) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। 

উপকূলীয় সদস্য কিছু ক্ষেত্রে অন্য দেশের পতাকা ব্যবহার করে ক্ষেত্র বিশেষ মাছ ধরতে পারে, সেক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়া যাবে না। রিপোর্টিং পোর্ট স্টেট নিশ্চিত করে মৎস্য শিকার করতে হবে। বাংলাদেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে (ইইজেড) কেউ মাছ ধরার কাজ সম্পন্ন করলে তা জানাতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশের জন্য বিশেষ এবং ডিফারেনশিয়াল ট্রিটমেন্ট আছে এবং তাই এসব দেশ ভর্তুকি বাতিলের প্রেক্ষাপটের বাইরে থাকবে। চুক্তিতে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে গ্র্যাজুয়েশনের পর একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশেষ এবং ডিফারেনশিয়াল ট্রিটমেন্ট (S&DT) সুবিধা চলমান থাকবে। উন্নয়নশীল দেশের সদস্য যতক্ষণ না এফএও দ্বারা নির্ধারিত শেয়ারের একটি নির্দিষ্ট অংশ স্তরে না পৌঁছে ততক্ষণ S&DT ট্রিটমেন্ট পেতে সক্ষম হতে পারে। তাই উন্নয়নশীল দেশকেও FAO দ্বারা সংজ্ঞায়িত সংলগ্ন এলাকার বাইরে বা মাছ ধরার আওতার বাইরে রাখা যেতে পারে।

সামুদ্রিক মৎস্য ধরার জন্য নতুন চুক্তিতে বাংলাদেশের ঝুঁকি তেমন উল্লেখযোগ্য নাও হতে পারে, কারণ বাংলাদেশের একোয়াকালচারই বেশি। দেশের সামুদ্রিক মাছ ধরার পরিমাণ নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এর পরিমাণ অনেক কম। যখন আমরা একটি সামুদ্রিক মাছ ধরার তুলনা দেখার চেষ্টা করেছি ২০২১-২২ সালে, এটি মোট মাছ ধরার মাত্র ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যার মধ্যে ইলিশের পরিমাণই কিছুটা উল্লেখযোগ্য। আমাদের অনেক অব্যবহৃত সুযোগ রয়েছে এখনো, সুনীল অর্থনীতিকে এখনো তেমনভাবে কাজে লাগাতে পারিনি, এমনকি ইইজেডের বাইরেও মাছ ধরা পরিচালনা করতে পারিনি।

তবে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ভর্তুকিসংক্রান্ত বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। উল্লিখিত বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় যে বাংলাদেশের একটি রিপোর্টিং সিস্টেম তৈরি করতে হবে। এর জন্য মৎস্য শিকার এবং আহরণে জড়িত বেশকিছু অনিবন্ধিত বা আনরেজিস্টার্ড আরটিসানকে নিবন্ধন করা দরকার হবে। এছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির সর্বোচ্চ ফলনের জন্য আমাদের ইইজেড এলাকায় স্টক মূল্যায়ন প্রয়োজন হবে। মাছের নার্সারি এলাকায় ইলিশের সঙ্গে আরো প্রজাতির মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিত ও কার্যকর করতে হবে। গার্হস্থ্য জলজ চাষে আমাদের প্রতিযোগিতা বজায় রাখার জন্য সরাসরি ভর্তুকি দেয়ার পরিবর্তে স্যানিটারি এবং সাইটোস্যানিটারি ব্যবস্থা, মান নিয়ন্ত্রণ, সার্টিফিকেশন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তার উন্নতির জন্য আরো মনোযোগ দেয়া উচিত।

বর্তমানে বাংলাদেশ রফতানি কর্মক্ষমতা ধরে রাখতে সমুদ্রের ট্রলার, জ্বালানি ইত্যাদির ওপর কিছু ভর্তুকি প্রদান করছে। গ্র্যাজুয়েশনের পর এক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে আসতে পারে, বিশেষ করে বিপুলসংখ্যক এ কর্মসংস্থান ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, যার একটি উল্লেখযোগ্য অনুপাত নারী। হিমায়িত চিংড়ি ও হিমায়িত অন্যান্য মাছের বরফ আচ্ছাদনের ওপর ভিত্তি করে ভর্তুকি দেয়া হয়। এগুলোর ব্যাপারে এখন থেকে পরিকল্পনা করা দরকার।

বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আসন্ন এমসি ১৩-তে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং এ সময়ের মধ্যে এএফএসে আরো কিছু উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে। আমরা আমাদের ব্লু-ইকোনমিকে কাজে লাগাতে চাই। যদিও চুক্তিটি এ মুহূর্তে আমাদের জন্য তেমন একটি চ্যালেঞ্জ নয় বলে প্রতীয়মান, তবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হতে এখনই ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তাই চুক্তিটির ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই নজর রাখা দরকার।

ফেরদাউস আরা বেগম: সিইও, বিল্ড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন