অভিমত

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি

নিজাম আশ শামস

এই তো কিছুদিন আগের ঘটনা। টানা বর্ষণে তলিয়ে গেল বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। অনেক জায়গায় বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। টানা দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকার কারণে মোবাইল টাওয়ারে সমস্যা হওয়ায় ফোনের নেটওয়ার্কও ঠিকমতো কাজ করছিল না। দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া প্লাবিত হলো। বন্যায় ডুবে গেল বান্দরবান। উপদ্রুত এলাকার অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে ত্রাণকার্যও যথাযথভাবে পরিচালনা করার সুযোগ ছিল না। তার চেয়েও ভয়াবহ খবর এসেছিল গণমাধ্যমে, যা মানুষের মনে ভীষণ ধাক্কা দিয়েছে। বন্যায় মারা যাওয়া লাশগুলো দাফন করার উপায় ছিল না। যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই পানি! লাশ দাফন করতে মাটি প্রয়োজন। সে মাটি তখন পানির নিচে। বছরখানেক আগে এর চেয়েও ভয়াবহ বন্যার অভিজ্ঞতা হয়েছিল সিলেটবাসীর। বাংলাদেশে নিয়মিত এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। যারা বেঁচে আছেন তারা বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের ঘরবাড়ি, বসতভিটা সব ভেসে গেছে। চরম দারিদ্র্য নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে দিন গুজরান করছেন তারা। তাছাড়া দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এসব রোগেও প্রাণ হারাচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ। এতে মানবসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অবকাঠামো ভেঙে পড়ছে। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘কি হাইলাইটস: কান্ট্রি ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্যানুসারে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি ডলার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ভয়াবহ বন্যার সময় বাংলাদেশের জিডিপি ৯ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে বলে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে। তবে এগুলো কেবল সূচনামাত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি রোধে পর্যাপ্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে, যতই দিন যাবে, বাংলাদেশ আরো ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হবে। ফলে একদিকে যেমন মোট ভূখণ্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তলিয়ে যাবে, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সুপেয় পানির অভাব, কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে এ দেশের ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। আর এসব সংকটের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে নারীরা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অত্যধিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা। প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। আবহাওয়ার এমন পরিবর্তনের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সব কিছুর পেছনে মূল কারণ হলো জলবায়ুর পরিবর্তন। এর নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে বাংলাদেশকে যথাযথ পরিকল্পনা ও কৌশল অনুসারে কাজ করতে হবে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, বাংলাদেশ এমন একটি কারণে ভুগছে, এমন একটি বিষয় নিয়ে তাকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে, যেটির জন্য তার দায় খুবই সামান্য। অন্যের দায়ভার কাঁধে নিয়ে ধুঁকতে হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠার লড়াইয়ে থাকা দেশটিকে। 

বাংলাদেশের বার্ষিক মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ দশমিক ৫ টন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ পরিমাণ ১৫ দশমিক ২ টন। বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ৩০ গুণ বেশি। সারা বিশ্বে যত কার্বন নিঃসরণ হয়, তার মাত্র দশমিক ৫৬ শতাংশের জন্য দায়ী বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনে এত নগণ্য ভূমিকা রাখলেও এর বিরূপ প্রভাবের কারণে অনেক বড় ঝুঁকিতে রয়েছে দেশটি। জার্মানওয়াচের গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (সিআরআই) ২০২১ অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় সপ্তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। জার্মানওয়াচের তথ্যানুসারে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ১৮৫টি মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংঘটিত এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের সংকট নিয়ে ‘দ্য ক্লাইমেট রিয়ালিটি প্রজেক্ট’-এ ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনটিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ঝুঁকি ও আর্থিক ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করব।

বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের তিন ভাগের দুই ভাগই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫ ফুটের কম উচ্চতায় অবস্থিত। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বাড়ছে। এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে প্রতি সাতজনের একজন বাস্তুচ্যুত হবে। এ সময়ের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৯ দশমিক ৬ ইঞ্চি (৫০ সেন্টিমিটার) বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশ ১১ শতাংশ ভূখণ্ড হারাবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। কেবল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণেই ২০৫০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। সময় যত গড়াবে, পরিস্থিতি তত ভয়াবহ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’-এর বরাতে ‘দি ক্লাইমেট রিয়ালিটি প্রজেক্ট’-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কয়েকজন বিজ্ঞানী পূর্বাভাস দিয়েছেন যে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পাঁচ-ছয় ফুট বাড়বে। এর ফলে পাঁচ কোটি মানুষ গৃহহীন হবে। 

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার আরো অনেক সমস্যা আছে। এর ফলে সমুদ্রের নোনা পানি কৃষিজমিতে ঢুকে পড়ে। পরিণতিতে জমিগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা হারায়। ‘বাংলাদেশ সয়েল রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট’-এর বরাতে প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত চার দশকে এ দেশের মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ প্রায় ২৬ শতাংশ বেড়েছে। এভাবে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়তে থাকলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে। এতে উপকূলীয় অঞ্চলের অন্তত এক কোটি লোক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। 

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বাস্তুচ্যুত এ বিপুল জনগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে শহরে এসে অপরিকল্পিত বস্তি তৈরি করছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের শহরের বস্তিবাসীদের প্রায় ৫০ শতাংশ নদীভাঙনের ফলে সৃষ্ট বন্যায় গৃহহারা হয়ে বস্তিতে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। সেখানে তারা মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। সংগত কারণেই নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আখড়া হয়ে উঠেছে বস্তিগুলো।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করা নিঃসন্দেহে বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (বিসিসিএসএপি) ২০০৯, বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান ২০৩০ ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে নেয়া এসব পদক্ষেপ যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, সেদিকে সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনগুলোয় নিজের অবস্থান আরো বেশি শক্তিশালী করতে হবে। যেসব উন্নত দেশ অত্যধিক হারে কার্বন নিঃসরণ করে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে, তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক বৈঠকের আয়োজন করতে হবে। তাদের কর্মকাণ্ডের ফলে এ দেশ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরতে হবে এসব বৈঠকে। উন্নত দেশগুলোর অত্যধিক হারে কার্বন নিঃসরণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে তারা একটি নির্দিষ্ট হারে জরিমানা দিতে বাধ্য। সেই ফান্ড দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি এড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। বর্তমানে যে হারে ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত কিনা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। একই সঙ্গে জরিমানার পূর্ণ হিস্যা বাংলাদেশ পাচ্ছে কিনা এবং তা যথাযথ খাতে ব্যয় করা হচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে। সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে একই সঙ্গে যুগোপযোগী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। 

নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন