পর্যালোচনা

বৈশ্বিক শস্য ঘাটতির পেছনের কারণ

জয়তী ঘোষ

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ক্রমবর্ধমান খাদ্যমূল্য, নিয়মিত বন্যা ও তার তীব্রতা, খরা এবং অন্যান্য আবহাওয়াজনিত কারণে খাদ্যশস্য সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। বিশেষ করে বিশ্বের দরিদ্র ও সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য বিপর্যয় নিয়ে এসেছে তা। জলবায়ু পরিবর্তন মধ্যমেয়াদ থেকে দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের জন্য হুমকি হিসেবে হাজির। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনকেই চলমান খাদ্য সংকটের জন্য দায়ী করতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্যমান সংকটের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে আড়াল করছে। 

এটা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই, যুদ্ধের ফলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম রফতানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ দুই উৎপাদকের রফতানি হ্রাসের ফলে বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। যুদ্ধের আগে তারা বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ গম রফতানির প্রতিনিধিত্ব করত। ২০২২ সালের শুরুতে খাদ্যশস্যটির দামের উল্লম্ফনের পেছনে যুদ্ধকে দায়ী করেছেন নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকরা।

রুশ আগ্রাসনের শুরুর মাসগুলোয় গমের দাম ২৩ শতাংশ বাড়লেও গত বছরের জুনের দিকে কমতে শুরু করে। ডিসেম্বর নাগাদ যুদ্ধপূর্ব মাত্রায় পৌঁছায় গমের দাম। এর পেছনে অবশ্য কৃষ্ণ সাগরীয় শস্য চুক্তির (বিএসজিআই) ভূমিকার কথা সামনে আনেন বিশ্লেষকরা। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনের শস্য রফতানি গন্তব্যে নিরাপদে পৌঁছিয়ে দিতে মস্কোর সঙ্গে এ চুক্তি হয়েছিল। সম্প্রতি চুক্তি থেকে রাশিয়ার বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তে ফের বৈশ্বিক শস্য বাণিজ্যে ক্ষতিকর প্রভাবের শঙ্কা জেগেছে। 

তবে এ শঙ্কা যে সঠিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই তার কারণ দুটি। প্রথমত, ইউক্রেন যুদ্ধের পরও বৈশ্বিক গম সরবরাহ (উৎপাদন ও বাণিজ্য) প্রায় সমপরিমাণই রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইনস কাউন্সিল ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দি এগ্রিকালচারাল মার্কেট ইনফরমেশন সিস্টেমে গম উৎপাদন, ব্যবহার ও বাণিজ্য উপাত্ত উঠে এসেছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২-এর জুন নাগাদ বৈশ্বিক গম উৎপাদন ৫০ লাখ টন বেড়েছে এবং বাণিজ্য বেড়েছে ৩০ লাখ টন। গমের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির এ সময়ে মজুদও বেড়েছে ৩০ লাখ টন। এই যে গমের মজুদের এ উপাত্ত দেখতে পাচ্ছি তাতে কিন্তু বৈশ্বিক স্বল্পতার বয়ানকে বড় আকারের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। একইভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩-এর জুনের মধ্যে চাহিদার চেয়ে গমের জোগান বেশিই থাকবে। 

দ্বিতীয়ত, বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে উৎপাদন ও বাণিজ্য বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টিপাত না করে বিশেষ অঞ্চলের স্বল্পতার দিকে জোর দেয়ার প্রয়াস দেখা যায় গণমাধ্যম ও বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর। বাস্তবতা হলো, গম বিশ্বব্যাপীই উৎপাদন হচ্ছে। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, এক অঞ্চলের স্বল্পতা অন্য অঞ্চলে উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা যায়।

তাহলে গমের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ কী? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অর্থপ্রবাহের দিকে নজর দিতে হবে। বৈশ্বিক খাদ্যশস্য বাজারের নিয়ন্ত্রণ একটি অলিগোপলি (স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন কোনো পণ্য বা সেবা নিয়ন্ত্রণ করে) গোষ্ঠীর হাতে। বিশ্বের শীর্ষ চার শস্য বাণিজ্য কোম্পানি আর্চার-ড্যানিয়েলস-মিডল্যান্ড, বাঞ্জ, কারগিল ও লুই ড্রেফাসের হাতে রয়েছে গমের বাজারের ৭০ শতাংশেরও বেশি হিস্যা। গ্লেনকোরের হাতে রয়েছে ১০ শতাংশের মতো নিয়ন্ত্রণ। 

ইউক্রেন যুদ্ধের একেবারে প্রাথমিক ধাপে, বিশেষত গত বছরের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে শীর্ষ চার কোম্পানি রেকর্ড আয় ও মুনাফা করেছে। কারগিলের বার্ষিক আয় ২৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। অন্যদিকে লুই ড্রেফাসের মুনাফা ৮০ শতাংশ বেড়েছে। গমের উচ্চমূল্যে ভর করে বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর বড় অংকের মুনাফার সঙ্গে প্রকৃত বৈশ্বিক চাহিদা ও জোগানের সম্পর্ক নেই। 

এছাড়া গত বছরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে শস্যের ভবিষ্যৎ সরবরাহ বাজারে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ দেখা যায়। পেনশন ফান্ডসহ আর্থিক খাতের বিনিয়োগকারীরা প্যারিসে গমের ভবিষ্যৎ সরবরাহ বাজারে হিস্যা বাড়াতে শুরু করে। ২০১৮ সালের মে মাসে এ বাজারে যেখানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ছিল ২৩ শতাংশ, ২০২২ সালের এপ্রিলে হিস্যা ৭২ শতাংশে দাঁড়ায়। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের ফলে খাদ্য মূল্যবৃদ্ধির সুবিধা নিয়ে সুযোগসন্ধানী ১০টি হেজ ফান্ডের পকেটে যায় ১৯০ কোটি ডলার। এ ধরনের তৎপরতা আটকে দেয়া কিংবা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেয়ে বরং বিনা বাধায় চলতে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নীতিনির্ধারকরা। 

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রফতানির গন্তব্য নয় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলো। কৃষ্ণ সাগরীয় চুক্তির ফলে রফতানি হওয়া ৩ কোটি ২৯ লাখ টন শস্যের ৮১ শতাংশের গন্তব্য ছিল উচ্চমধ্যম আয়ের দেশগুলো। বিশেষত, স্পেন, ইতালি ও নেদারল্যান্ডসের পাশাপাশি চীন ও তুরস্কের মতো দেশ। নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় গেছে ইউক্রেনের মাত্র ৩ শতাংশ খাদ্যশস্য। এর মধ্যে গম ছিল ৯ শতাংশ (যার বড় অংশ এসেছে বাংলাদেশে)। শস্য চুক্তি ভেসতে গেলে আফ্রিকার দেশগুলো না খেয়ে থাকবে এমন দাবি আসলে অতিরঞ্জন। 

কৃষ্ণ সাগরীয় চুক্তি আসলে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবেলার সর্বরোগের ওষুধ নয়। বরং ইউক্রেন থেকে শস্য রফতানি মসৃণে এটি আসলে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এছাড়া সমুদ্রপথে রুশ অবরোধের পাশাপাশি স্থলপথেও নানা বিধিনিষেধে আটকা পড়ে আছে ইউক্রেনীয় শস্য বাণিজ্য। বিশেষ করে পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া ও রোমানিয়ার মতো মধ্য ও পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো ইউক্রেনের শস্যের বিপরীতে স্থানীয় কৃষকদের সুরক্ষায় সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেমনটা আরো অনেকেই বলছেন, কৃষ্ণ সাগরীয় শস্য চুক্তি আসলে এগ্রিবিজনেস খাতের জায়ান্টদের অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ করে দিয়েছে এবং এক্ষেত্রে আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা এতে মদদ দিচ্ছে। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈশ্বিক খাদ্য সংকট বেড়েছে, এ কথা সত্য। কিন্তু এর জন্য শস্যের ঘাটতি দায়ী নয়। বরং রফতানি হ্রাস, দোদুল্যমান বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় আয়, অর্থ পাচার, উচ্চ ঋণ পরিষেবা ব্যয় অনেক দেশের খাদ্যপণ্য আমদানি সক্ষমতা সংকুচিত করেছে। 

বিদ্যমান এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের অন্যদিকে মনোযোগ দিতে হবে। দান-খয়রাতের অংশ হিসেবে খাদ্যশস্য বিলি না করে দরিদ্র দেশগুলোর মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিরতা কীভাবে লাঘব করা যায়, প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের দেশীয় ও আঞ্চলিক উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে মনোযোগ দেয়া উচিত নীতিনির্ধারকদের। বৈশ্বিক ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা অবশ্যই জয়ী হতে পারি। তবে বর্তমান সংকটের পেছনের প্রকৃত কারণ যদি চিহ্নিত করতে পারি তখনই তা সম্ভবপর হবে।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

জয়তী ঘোষ: ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, ক্লাব অব রোমের ট্রান্সফর্মেশনাল ইকোনমিকস কমিশনের সদস্য

ভাষান্তর: সাবিদিন ইব্রাহিম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন