বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস ফিল্ডের আয়ুষ্কাল আর মাত্র এক বছর

আবু তাহের

গ্যাস উত্তোলনের দিক থেকে বিবিয়ানা দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস ফিল্ড। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের নিয়ন্ত্রণাধীন এ গ্যাস ফিল্ড স্থানীয় গ্যাসের মোট ৩৮ শতাংশ জোগান দিচ্ছে। ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে উৎপাদনে থাকা এ গ্যাস ফিল্ডে মজুদ রয়েছে আর মাত্র ২৫৪ বিসিএফ (বিলিয়ন কিউবিক ফুট) গ্যাস। পেট্রোবাংলার হিসাবে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে দৈনিক গড়ে প্রায় ১ হাজার ১৫০ এমএমসিএফ (মিলিয়ন কিউবিক ফুট) গ্যাস উত্তোলন হয়েছে। এ হারে গ্যাস উত্তোলন করা হলে মজুদকৃত গ্যাসের আয়ুষ্কাল হবে মাত্র ২২০ দিনের মতো। আর উত্তোলন কমে তা দৈনিক ৮০০ এমএমসিএফে নামলেও তাতে মেয়াদ এক বছরের বেশি নয়।

পেট্রোবাংলা-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো গ্যাস ফিল্ডের মজুদ আকস্মিকভাবে নিঃশেষ হয়ে যায় না। বরং উৎপাদন কমে যায়। কারিগরি সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে দ্রুত গ্যাস উত্তোলন করা হবে নাকি উত্তোলন কমিয়ে রাখা হবে। তবে এ গ্যাস ফিল্ড থেকে এখনো দুই-তিন বছর একটি নির্ধারিত মাত্রায় গ্যাস পাওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত (টুপি) গ্যাসের মজুদ ৫ হাজার ৭৫৫ বিসিএফ (প্রায় ৬ টিসিএফ)। এর মধ্যে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে ৫ হাজার ৫০১ বিসিএফ (সাড়ে ৫ টিসিএফ)। বাকি রয়েছে মাত্র ২৫৪ বিসিএফ। গত ছয় মাসে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাসের দৈনিক গড় উত্তোলন ছিল ১ হাজার ১৫০ এমএমসিএফের ওপরে। এ হারে গ্যাস ফিল্ডটি উৎপাদনে থাকলে প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী, ২২০ দিন গ্যাস উত্তোলন করা যাবে।

যদিও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট গ্যাস উত্তোলনের হিসাব ধরে গ্যাসকূপের আয়ুষ্কাল বলা মুশকিল। তবে বিষয়টি নির্ভর করে কারিগরি সক্ষমতা ও গ্যাস উত্তোলনের ওপর। গ্যাস উত্তোলন কমে গেলে সেক্ষেত্রে কূপের উৎপাদন সময় যেমন দীর্ঘ হয়, তেমনি পুনরায় মজুদ সম্ভাব্যতা যাচাই করলে গ্যাসের মজুদও বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।

তবে বিবিয়ানায় গ্যাসের আয়ুষ্কাল যে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে তা পেট্রোবাংলার ছয় মাসের উত্তোলন চিত্র থেকেও বোঝা যায়। পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উত্তোলন প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড থেকে দৈনিক গড় গ্যাস উত্তোলন ছিল ১ হাজার ১৪৫ এমএমসিএফ, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ১৩৯ এমএমসিএফ, মার্চে ১ হাজার ১৩৭ এমএমসিএফ, এপ্রিলে ১ হাজার ১১০ এমএমসিএফ, মে মাসে ১ হাজার ১৯৯ এমএমসিএফ এবং জুনে ১ হাজার ১০৪ এমএমসিএফ।

হবিগঞ্জ জেলার নবিগঞ্জ উপজেলায় বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৮ সালে। এরপর ২০০৭ সালের মার্চে গ্যাস ফিল্ডটি থেকে প্রথম গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়। বর্তমানে ২৬টি কূপ থেকে এ গ্যাস ফিল্ডের গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। বৃহৎ এ গ্যাস ফিল্ডটি পরিচালনা করছে মার্কিন জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠান শেভরন।

শেভরনের হাতে বিবিয়ানা ছাড়াও দেশের আরো দুটি গ্যাস ফিল্ড রয়েছে। মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাস ফিল্ড। এরই মধ্যে জালালাবাদের মজুদ ফুরিয়ে আসায় বর্তমানে গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া মৌলভীবাজার গ্যাস ফিল্ডে বর্তমানে ৮১ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ রয়েছে। যেখান থেকে দৈনিক গড়ে ১৩২ এমএমসিএফের মতো গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে।

দেশে গ্যাস উৎপাদনে পেট্রোবাংলার তালিকায় মোট ২২টি গ্যাস ফিল্ড রয়েছে। এর মধ্যে চারটি গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন নেই বললেই চলে। স্থানীয় এসব গ্যাস ফিল্ড ও আমদানীকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) মিলিয়ে দৈনিক মোট ৩ হাজার এমএমসিএফ গ্যাসের সরবরাহ হচ্ছে। গত কয়েকদিনে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় উৎপাদন ৪০০-৫০০ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। যদিও বর্তমানে সরবরাহের তুলনায় গ্যাসের দৈনিক ঘাটতি রয়েছে ১ হাজার ৪০০ এমএমসিএফের মতো। এ পরিস্থিতিতে বিবিয়ানার উৎপাদন হঠাৎ কমে গেলে আগামীতে পরিস্থিতি কী হতে পারে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার গ্যাস উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। এ গ্যাস ফিল্ডের মজুদও এখন কমে গেছে। এ ফিল্ডের উৎপাদন আকস্মিকভাবে কমে গেলে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের জোগান কীভাবে হবে সেটি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ ও সংশয় রয়েছে। এত বড় গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন কমে গেলে এর বিপরীতে জোগান কীভাবে হবে সেটি নিয়ে পেট্রোবাংলা কিংবা জ্বালানি বিভাগের তেমন কোনো পরিকল্পনা দেখছি না। গ্যাস গ্রিড থেকে বৃহৎ একটি গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদনে বিঘ্নতা সৃষ্টি হলে তা শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে বড় প্রভাব ফেলবে।’

একই কথা বলেন আরেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিবিয়ানা গ্যাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ফিল্ড। এখানকার মজুদ এখন কমে এসেছে। যে হারে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে, তাতে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে এ ফিল্ডের গ্যাস শেষ হয়ে যাবে। তবে এটি নির্ভর করছে পেট্রোবাংলা বিবিয়ানা ফিল্ড থেকে কতটুকু গ্যাস নেবে তার ওপর।’

তবে বিবিয়ানাসহ অন্যান্য ফিল্ডের মজুদ গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে পেট্রোবাংলা। কীভাবে জোগান বাড়ানো যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে সংস্থাটি। পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বৃহৎ কূপের উৎপাদন কমে গেলে সেই বিষয়ে পেট্রোবাংলার প্রস্তুতি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সময়ে এলএনজি সরবরাহ যেমন বাড়বে, তেমনি স্থানীয় গ্যাসের উত্তোলনও বাড়বে। পেট্রোবাংলা ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এসব কূপ থেকে গ্যাস আসবে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।’

এদিকে দেশে মজুদকৃত গ্যাসে ১০ বছর চলবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গত ১৫ জুন জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী জানান, নতুন আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র ইলিশার মজুদসহ দেশে বর্তমানে গ্যাসের প্রাথমিক মজুদ ৪০ দশমিক ৪৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট এবং উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ ২৮ দশমিক ৭৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ২০২২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৯৪  ট্রিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলন করা হয়েছে। ৮ দশমিক ৮২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট মজুদ অবশিষ্ট রয়েছে। দৈনিক গড়ে ২ হাজার ২০০ এমএমসিএফ গ্যাস উৎপাদন বিবেচনায় মজুদ থাকা গ্যাসে ১০ বছর চলবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন