সময়ের ভাবনা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা ও বাংলাদেশ

আহমেদ দীন রুমি

মরক্কোর রাবাতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আফ্রিকান সেন্ট্রাল ব্যাংকের সম্মেলন। হাজির ছিলেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বেশ জোরের সঙ্গেই জানালেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা (সিবিডিসি, central bank digital currency) এখন আর বিক্ষিপ্ত কোনো ধারণা নয়, বরং পরিণত হয়েছে বাস্তবতায়। শিগগিরই সিবিডিসি-ভিত্তিক বৈশ্বিক প্লাটফর্ম দাঁড় করানো হবে। জর্জিয়েভার ঘোষণার দুইদিন না পেরোতেই সিঙ্গাপুর জানিয়েছে ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালির সঙ্গে সম্পর্কের অগ্রগতির কথা। পরিস্থিতি আরো স্পষ্ট হয় আটলান্টিক কাউন্সিলের জরিপে। মার্কিন ব্লকচেইন বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান চেইনালাইসিস (Chainalysis) ২০২২ সালে তাদের বৈশ্বিক ক্রিপ্টো প্রচলন সূচকের তালিকায় বাংলাদেশকে ডিজিটাল মুদ্রা প্রচলনে সম্ভাবনাময় প্রথম ৩০টি দেশের কাতারে রেখেছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি ট্র্যাকার অনুসারে, বিশ্বের ১১টি দেশই এরই মধ্যে ডিজিটাল মুদ্রা পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করেছে। অন্তত ১৮টি দেশ পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রেখেছে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহারকে। চীন, ভারত, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে এ কাতারে। চলতি বছরেই ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও গ্রহণ করতে যাচ্ছে পাইলট প্রজেক্ট আকারে। তার মানে বৈশ্বিক মুদ্রা ব্যবস্থা বড় ধরনের বাঁক নিতে যাচ্ছে আগামীতে।

সিবিডিসি হলো কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক জারি করা আইনি দরপত্র। রাষ্ট্রের সাধারণ মুদ্রার মতোই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইস্যু করে রাখবে, তবে মুদ্রাটা হবে ডিজিটাল মাধ্যমে, যা ব্লকচেইন-ভিত্তিকও হতে পারে। সাধারণত বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় সরকারের স্বাক্ষরিত নোট বা কয়েন। সবই কিন্তু আইনি দরপত্র। সে দিক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রাও একটা আইনি দরপত্র, তবে তা নোট বা কয়েনের মতো দৃশ্যমান নয়। থাকবে ডিজিটাল দুনিয়ার লেনদেন প্রক্রিয়ায়। বিষয়টি বোঝার জন্য মুদ্রা ব্যবস্থার সনাতন রূপ দুটি সামনে আনা যাক। প্রথমটি, পণ্যকেই মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা। যেমন স্বর্ণ বা রৌপ্যের ব্যবহার। দ্বিতীয়টি, পণ্যের মানকে আদর্শ ধরে অন্য কিছুকে মুদ্রা সাব্যস্ত করা। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকের ভল্টে স্বর্ণ রেখে মুদ্রা হিসেবে বাজারে কাগজ ছেড়ে দেয়া। পদ্ধতিটি তুলনামূলকভাবে আধুনিক। এক্ষেত্রে পণ্যের বিপরীতে একটা লিখিত কাগজ সমমান নিয়ে ব্যবহৃত হয়। যদিও হাল আমলে কাগজ নিজেই পণ্যনিরপেক্ষ মুদ্রায় পরিণত হয়েছে।

উভয় মুদ্রাতেই মানুষের ভরসা গত ৫০ বছরে কিছুটা ফিকে হয়েছে। কয়েক দফা মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থার সাক্ষী হয়েছে দুনিয়া। তালাশ করেছে নতুন কোনো মুদ্রাভিত্তিক অর্থনীতির। ফলে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেছে ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা—১) পাবলিক লেজার মানি ও ২) প্রাইভেট লেজার মানি। পাবলিক লেজার মানি বা উন্মুক্ত খতিয়ান ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থার একটি উদাহরণ বিটকয়েন। বিটকয়েন হলো ব্লকচেইন-ভিত্তিক এমন এক বিকেন্দ্রীকৃত মুদ্রানীতি, যেখানে মুদ্রার গতিবিধি উন্মুক্ত; কিন্তু তা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়। অন্যদিকে প্রাইভেট লেজার মানি বা গোপন খতিয়ান ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত একটি মুদ্রা ব্যবস্থা, যেখানে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ব্যতীত অন্যদের কাছে মুদ্রার গতিবিধি গোপন থাকবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা নীতিমালায় এ পর্যবেক্ষণের দায়িত্বটা নেয় রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তি। অর্থাৎ সিবিডিসির কাঠামো কিছুটা বিটকয়েনের মতোই, কিন্তু তার নীতিনির্ধারক রয়েছে। নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ডেবিট ও ক্রেডিটের ওপর।

মানুষের যাপিত জীবন ক্রমেই ডিজিটাল হয়ে ওঠছে। তাই অনেকের মতে, ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি। ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থার কিছু সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, নোট বা কয়েন তৈরির খরচ বাঁচে। তৎক্ষণাৎ আর্থিক লেনদেনের সুবিধা, টাইম জোনের সমস্যা থেকে বাঁচা, বিনিময়সংক্রান্ত খরচ কমিয়ে আনার সুবিধা। বৈশ্বিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনাকে আরো বেশি অন্তর্ভুক্তীকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। বৈশ্বিক অর্থনীতি আরো বেশি মানুষ সংযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ হচ্ছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক। সিবিডিসি নীতি বাস্তবায়ন হলে প্রত্যাশিত অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করে দেবে। বিনিময় পদ্ধতিকে বানাবে আরো বেশি কার্যকর ও দ্রুত। দুই দেশের মধ্যকার বিনিময় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী দূরত্ব কমে। ফলে আগামীতে আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার বাড়বে। তবে ঝুঁকির সম্ভাবনাও কম নেই। বিশেষ করে তথ্য গোপনীয়তা ও আইনি সীমাবদ্ধতা। আছে সাইবার রিস্ক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনাগত ত্রুটিও। বিদেশী সিবিডিসিগুলোর সহজে বিনিময়যোগ্য হলে দেশীয় মুদ্রার বিপরীতে বিদেশী মুদ্রা ব্যবহারের ঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা থাকে। ফলে সিবিডিসি বাস্তবায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।

আটলান্টিক কাউন্সিলের সিবিডিসি ট্র্যাকারে বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে রিসার্চ পর্যায়ে। দেশের অর্থনীতি ও বাজার উদীয়মান পর্যায়ে। নগদ লেনদেনের পাশাপাশি এমএফএস, মোবাইল অ্যাপস ও অনলাইন লেনদেন সহজ করতে প্রচেষ্টা চলমান। সবই সিবিডিসি চালুর প্রস্তুতি পর্ব। সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এখানকার মুদ্রানীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কার্যপরিধি, নেতিবাচক প্রভাবের সম্ভাবনা, স্টেকহোল্ডারের ভূমিকা ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত ঝুঁকি বিষয়গুলো নিয়ে স্পষ্ট হওয়া জরুরি। কেবল সরকার নয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। দেশে সিবিডিসির সবচেয়ে বড় সুবিধাগুলোর একটি হয়ে উঠতে পারে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে। চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসে রেমিট্যান্স এসেছে যথাক্রমে ১৬৮ ও ১৬৯ কোটি ডলার। রেমিট্যান্স দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাত। সিবিডিসি রেমিট্যান্স-সংক্রান্ত খরচ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে পারে। প্রচলিত প্রক্রিয়ায় টাকা পাঠানোতে যে সময় লাগে, সেটিও কমে আসবে। সিবিডিসিতে গতি ৬৮ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব বর্তমানের তুলনায়।

সিবিডিসি প্রচলনের পূর্বে একটি দেশের অবকাঠামোগত উন্নতি প্রয়োজন। আর্থিক লেনদেনে প্রযুক্তির ব্যবহারে সম্ভাবনা ও ব্যয় সম্পর্কে ধারণা দরকার। ইন্টারনেট সংযোগ প্রসারিত হওয়ার কারণে পেমেন্ট সিস্টেম দেশে ক্রমে ভার্চুয়াল হয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। মানুষের শারীরিক উপস্থিতি ও সময়ের প্রয়োজন কমে যাচ্ছে। ডিজিটাল মুদ্রা ও ই-ওয়ালেটের ধারণা পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ধারণাতেও এনেছে পরিবর্তন। যেহেতু ডিজিটাল মুদ্রার নিজস্ব দাম থাকে, সেহেতু সাধারণ মানুষ ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহার করে অনলাইন কেনাকাটা করতে পারবেন। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সত্যায়িত মুদ্রা হওয়ার কারণে যেকোনো সময় ছাপার টাকার সঙ্গে বদল করে নেয়া যাবে। শুধু উত্তোলনের মুহূর্তে দাম কেমন রয়েছে, সেটা পরখ করে নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে থাকার কারণে ঝুঁকি থাকবে কম। আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও লেনদেনের হিসাব করতে সুবিধা হবে। তবে এখনো যথেষ্ট শূন্যতা আছে মানুষের মধ্যে সিবিডিসি-সংক্রান্ত ধারণা উৎপাদনে। একথা সত্য, সিবিডিসিতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুযোগ নেই, কেননা সিবিডিসিতে সব লেনদেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যবেক্ষণ করতে পারবে এবং অনেকে আশঙ্কা করছে। এর ফলে নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি আরো পাকাপোক্ত হবে। একনায়ক ও স্বৈরাচারী শাসক চাইলে অর্থ ব্যবস্থাকে নিজেদের মতো ম্যানিপুলেট করতেও পারে। ফলে মুদ্রা ব্যবস্থার আন্তর্জাতিকীকরণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক আশঙ্কাগুলোও মাথায় রাখা দরকার। যারা শুল্ক, মানি লন্ডারিং ও অন্যান্য অবৈধ বিষয় নিয়ে চিন্তিত, তাদের বিচারে সিবিডিসি ইতিবাচকই।

মুদ্রার কার্যক্ষমতা ও স্বচ্ছ বিনিময়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা জরুরি। দরকার আন্তঃদেশীয় বিনিময়ের জন্য কার্যকর ব্যবস্থাপনা। এ কারণেই আইএমএফ কাজ করছে বৈশ্বিক প্লাটফর্ম তৈরির পেছনে। আশা করা হচ্ছে, একটা সাধারণ বিনিময় পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি পরিকল্পনা। রয়েছে পরিচালনাগত কিছু ঝুঁকির আশঙ্কাও। একটা আদর্শ মুদ্রা হিসেবে সিবিডিসি প্লাটফর্মকে দাঁড় করানো গেলে অর্থনৈতিক শূন্যতা দূর করা যাবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুদ্রার স্থিতিশীলতা তৈরির জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। সিবিডিসির ব্যবহার ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিদ্যমান ঝুঁকি সংশোধন করবে। ঝুঁকি কমাবে ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানেরও। জর্জিয়েভা বেশ খোলাখুলিভাবেই বলেছেন, ‘‌ডিজিটাল মুদ্রার অনুমোদন তৈরিতে সবার একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। আলোচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে শূন্যতা তৈরি করবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে, যা পূরণ করবে ক্রিপ্টোকারেন্সি।’

আহমেদ দীন রুমি: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন