অভিমত

জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় রোগ প্রতিরোধের গুরুত্ব

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

পরিবর্তশীল বিশ্বে দিন দিন রোগের বোঝা বেড়ে চলেছে। সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব কাটাতে না কাটাতেই বিশ্ব অসংক্রামক রোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের আধিক্য বেড়েছে। আর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি সংক্রামক রোগগুলো। রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হলেও তাতে সরকারের উদাসীনতা রয়েছে। ফলে চিকিৎসা সেবার ওপর চাপ পড়ছে বেশি। আর এতে ব্যক্তির খরচও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যয় কমিয়েছে সরকার। অন্যদিকে ব্যয় বাড়িয়েছে বেসরকারি খাত। দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হলে রোগ প্রতিরোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ (ডব্লিউএইচও) বিভিন্ন সংস্থা। 

রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বলতে আমরা বুঝি অসুস্থ হওয়ার আগেই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছে—অসুস্থতা, রোগ প্রতিরোধ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা প্রতিরোধে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার সঙ্গে কাউন্সেলিংও জড়িত। বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন। গবেষণা সংস্থাটি বলছে, প্রাপ্তবয়স্করা সময়ে সময়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কাছে গিয়ে তাদের সুস্থতা পরীক্ষা করবেন। এতে রোগের স্ক্রিনিং বা রোগ শনাক্তের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা হবে। সাধারণত শতভাগ রোগ শুরুতে শনাক্ত বা রোগ সৃষ্টির আগে সমস্যা চিহ্নিত হলে প্রতিরোধ সম্ভব। কেউ অসুস্থতা বোধ না করলেও নিয়মিত পরীক্ষার কথা বলা হয়। কেননা এতে ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যগত সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো জীবনাচারের শুদ্ধতা। পরিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের সঙ্গে রোগ প্রতিরোধের বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত। এসব বিষয় ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু গত কয়েক বছরে রোগ প্রতিরোধ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যয় কমিয়েছে সরকার। যদিও বেসরকারি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। 

এ বছরের জানুয়ারিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ১৯৯৭-২০২০’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রকাশনায় দেখা যায়, রোগ প্রতিরোধের ব্যয়ের চিত্র ক্রমান্বয়ে কমিয়েছে সরকার। ওই প্রকাশনায় মূলত ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরের স্বাস্থ্য খাতে খরচ দেখানো হয়েছে। 

সরকারি প্রতিষ্ঠানটির তথ্যানুযায়ী, দেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ২০১৮ সালে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। এরপর ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৯০৩ কোটি, ২০২০ সালে ৫ হাজার ৮৩৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে ২০১৮ সালে সরকারি খাতে ব্যয় হয়েছে ৫৩ শতাংশ ও বেসরকারি খাত ব্যয় করেছে ৪৭ শতাংশ, যা টাকার হিসেবে সরকারি খাতে ৩ হাজার ১৫২ কোটি ৫০ লাখ আর বেসরকারি খাতে ২ হাজার ৭৬৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এরপর ২০১৯ সালে সরকারি খাতে ব্যয় কমে ৫০ শতাংশ হলেও বেসরকারি খাতে বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ। একইভাবে ২০২০ সালে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সরকারি ব্যয় কমে ৪৭ শতাংশ হলেও বেসরকারি খাতে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। 

যদিও একসময় রোগ প্রতিরোধে সরকারের ব্যয় বেশি ছিল। তবে বর্তমানে নগরের পরিসর বেড়েছে। আগের চেয়ে রোগে আক্রান্তের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিতেই হবে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় ব্যয় বাড়িয়েছে। এখানে বেসরকারি খাত বলতে সরকারি ব্যবস্থাপনার বাইরে যে দেশীয় ও অন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, দাতা সংস্থা, অঞ্চলভিত্তিক দাতব্য সংস্থা, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। করোনাকালে সচেতনতা, মাস্ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যক্রম। বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন—এইডস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ এবং টিকাদান কার্যক্রমও এখানে অন্তর্ভুক্ত। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গত কয়েক বছরে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় খরচ করেছে। যদিও করোনার টিকাদান কার্যক্রমে সরকারের ব্যয় যুক্ত করার পর প্রতিরোধ খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তবে এর বাইরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গুরুত্ব পাচ্ছে কি?

আমরা যদি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের দেয়া তথ্যে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য খাতের খরচ বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই ২০২০ সালে দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের সর্বোচ্চ অংশ গেছে চিকিৎসা পণ্য (বিশেষায়িত সেবার জন্য নয়) ক্রয়ের ক্ষেত্রে। এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৪৭ শতাংশ। চিকিৎসা সেবায় ব্যয় হয়েছে ২৮ শতাংশ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় ব্যয় হয়েছে ৪, সরকারি ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যয় হয়েছে ২ দশমিক ৩, প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ৮, আনুষঙ্গিক সেবায় (বিশেষায়িত নয়) ৮ শতাংশ এবং বাকি ব্যয় হয়েছে পুনর্বাসন, দীর্ঘমেয়াদি সেবা, অবকাঠামোগত উন্নয়নে। 

দেশে রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি, জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষিত। ফলে আমরা বুঝে না বুঝে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে গুরুত্ব কম দিচ্ছি। রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আসলে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তা দেখার বিষয়। হয়তো আলাদাভাবে কিছু কর্মসূচি নেয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসাসেবার মধ্যেও প্রতিরোধী সেবা রয়েছে। সাধারণত প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে সরকার বাস্তবায়ন করে। যেমন ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, এইচআইভিসহ নানা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়। বেসরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন করলেও সরকারি মাধ্যমে অর্থ আসে। আর্থিক ব্যবস্থা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ গুরুত্ব কম পাচ্ছে। জনগণ বা সরকারের মধ্যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে সচেতনতা কম। স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রত্যেক কর্মসূচিতেই অল্পবিস্তর প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য কার্যক্রম রাখা হয়। জীবনাচার ও প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য শিক্ষার বিষয়গুলোও প্রতিরোধী ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তবে এসব প্রতিরোধী কার্যক্রম অনেক হলেও তা যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। প্রতিরোধী ব্যবস্থার জন্য শুধু খরচ দেখালেই চলবে না, মানুষের স্বাস্থ্যগত আচরণ, ভাবনায় কোনো পরিবর্তন হলো কিনা তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। 

এদিকে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উপস্থাপন করেছে খোদ সরকারের ওই প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বিভিন্ন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণায় বিষয়টি দেখা যায়। দেশে জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে সরকারি ব্যয়ের অবদান দিনে দিনে কমছে। এর বিপরীতে বাড়ছে ব্যক্তিগত ব্যয় বা আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার। চিকিৎসাসেবায় ২০১৫ সালে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার ছিল ৬৭ শতাংশ। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ শতাংশে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় কমে ২০২০ সালে ২৩ শতাংশে নেমেছে। এর আগে ২০১৮ ও ১৯ সালে এ হার ছিল যথাক্রমে ২৮ ও ২৬ শতাংশ। আবার ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয়ের অবদান ছিল যথাক্রমে ৬৪ ও ৬৬ শতাংশ। উন্নত বিশ্বের কোনো কোনো দেশে ব্যক্তির এই খরচ ১৩-১৫ শতাংশ। ব্যক্তির নিজস্ব খরচ কম রাখার বিষয়টি ভালো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্ণয়ক।

নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে স্বাস্থ্যসেবায় অর্থায়নের সিংহভাগ রোগীর নিজের পকেট থেকে আসে। স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে রোগী নিজের পকেট থেকে যে অর্থ ব্যয় করে, তাকে বাড়তি খরচ বা আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার বলা হয় বলে সংজ্ঞা দিয়েছে ডব্লিউএইচও গ্লোবাল হেলথ এক্সপেন্ডিচার। 

প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সরকারের যথাযথ নজরের অভাবে ব্যক্তি পর্যায়ে খরচ বেড়েছে এমন ধারণা ঠিক। তবে প্রতিরোধ ব্যবস্থার বাইরে সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়ে গেছে। সরকার চিকিৎসা সেবায় খরচ করছে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় খরচ বৃদ্ধি করলে চিকিৎসাসেবায় ব্যয় কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। বাংলাদেশে প্রতিরোধী ব্যবস্থা বা জনস্বাস্থ্যবিষয়ক ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। দীর্ঘ বছর ধরে এ ব্যবস্থাপনা উপেক্ষিত রয়েছে। 

রোগ কম হওয়া ও চিকিৎসা ব্যবস্থা ওপর চাপ কমানোর জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ। রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় কিউরেটিভ কেয়ার ব্যবস্থাপনায়। আর যাতে রোগ কম হয়, মানুষ সচেতন থাকে এসব ব্যবস্থাপনা করা হয় প্রিভেনটিভ কেয়ার ব্যবস্থায়। প্রতিরোধমূলক সেবা বা প্রিভেনটিভ কেয়ার হলো জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রম। এতে জনগোষ্ঠীকে যুক্ত করা হয়। যাতে তারা সচেতন থাকে ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনাচারে অভ্যস্ত হয়। এতে রোগ তুলনামূলক কম হলেও শুরুতেই চিকিৎসার আওতায় আনা যায়। তৃণমূলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাদে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক ব্যবস্থাপনা দেশে কম গুরুত্ব পেয়েছে। প্রতিরোধী ব্যবস্থায় সরকার ব্যয় বাড়ালে চিকিৎসা ব্যয় কমে যাবে। এতে জনসাধারণের ওপর খরচের চাপ কমবে। বেসরকারি দাতা বা উন্নয়ন সংস্থার প্রতিরোধী কার্যক্রম বাদে চিকিৎসাসেবা দেয়ার সুযোগ নেই। ফলে তারা শুধু প্রতিরোধী সেবা দেয়। স্বাস্থ্য বিষয়টি যে শুধু হাসপাতালে এমন চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে প্রতিরোধী ব্যবস্থা গুরুত্ব পাবে না এবং রোগ বৃদ্ধি পাবে। 

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন