তিন প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত গবেষণা

নিষেধাজ্ঞায় সাগরে মাছ আহরণ বাড়লেও কমেছে উৎপাদন হার

ফেরদৌস সিদ্দিকী, রাজশাহী

সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন বাড়াতে ২০১৫ সাল থেকে বঙ্গোপসাগরে মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে সরকার। মাছের সুষ্ঠু প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্যই প্রতি বছর ২০ মে-২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এর ফলে গত কয়েক বছর সাগরে মাছ আহরণ বাড়লেও কমেছে উৎপাদন হার। সেই সঙ্গে মাছের প্রজাতির গুণগতমানও কমেছে। এক গবেষণায় তথ্য উঠে এসেছে। পিআইইউ-বিএআরসি এনএটিপি- প্রকল্পের আওতায় সম্প্রতি গবেষণাটি করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের একদল গবেষক। শের--বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলও (বিএআরসি) এর সঙ্গে যুক্ত ছিল।

মাছের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করে জেলেদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করাই ছিল গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। এছাড়া সাগরে মাছ আহরণের নিষেধাজ্ঞার সময়কাল নির্ধারণ, মৎস্য সম্পদের জন্য হুমকি এবং মানবসৃষ্ট জলবায়ুগত কারণ চিহ্নিত করতেও গবেষণাটি করা কয়। বিষয়ে মুখ্য গবেষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক . ইয়ামিন হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে পাওয়া মাছের প্রজাতির নির্ভরযোগ্য কোনো তালিকা নেই। সেই সঙ্গে প্রজাতিভিত্তিক মজুদ, নার্সারি প্রজনন ক্ষেত্রের অবস্থান এবং প্রতিটি জেনেটিক মজুদ সম্পর্কে গবেষণার ঘাটতি রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচনায় সাগরে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক মাছের মজুদ মূল্যায়নেই মূলত গবেষণা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।

উপকূলের জেলেরা বলছেন, গত আট বছর ধরে সাগরে মাছ ধরার ক্ষেত্রে সরকারের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেছেন তারা। কিন্তু একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা না থাকায় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। ফলে সেই অর্থে সরকারের উদ্যোগের সুফল মিলছে না। দুই দেশের নিষেধাজ্ঞা সমন্বয় হলে উপকূলের জেলেদের দুঃখ ঘুচবে বলে জানান তারা।

জানা গেছে, মিয়ানমারে নিষেধাজ্ঞা শুরু হয় বাংলাদেশের সঙ্গেই। শেষ হয় অবশ্য আরো দিনদশেক পর। তবে নিষেধাজ্ঞায় প্রায় ৫৫ দিনের ব্যবধান ভারতের সঙ্গে। প্রতিবেশী দেশটির পূর্ব উপকূলে মৎস্য আহরণে এপ্রিল নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ মে। সমন্বয়হীনতার সুযোগে ভারতীয় জেলেরা অনেক সময়ই বাংলাদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে অবাধে। ফলে নিষেধাজ্ঞা শেষে সমুদ্রে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত মাছ পান না এদেশের জেলেরা।

খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম কক্সবাজার অঞ্চলের বঙ্গোপসাগরে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। ওই সময় গবেষকরা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ৭৪০টি সামুদ্রিক মাছের প্রজাতি তালিকাভুক্ত করেন। এর মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ১৫টি মাছের মাসিক নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, ১৫টি প্রজাতির মধ্যে পোয়া, তুলার ডান্ডি, লইট্টা টুস ফ্যাসার সুষম আহরণ হয়েছে। তবে অতিরিক্ত আহরণ হয়েছে কোরাল বা ভেটকি, তপসে রাসের। এছাড়া টুনা, ফ্যাসা, রূপচাঁদা, ডম্বুরা, ঢেলা, ওলুয়া, কাউয়া লাল পোয়া আহরণ হয় অনেক কম পরিমাণে। এদিকে দেশে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞার সময়কাল ২০ মে-২৩ জুলাই। অথচ গুরুত্বপূর্ণ ১৫ প্রজাতির মাছের শীর্ষ প্রজনন মৌসুম এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত। প্রজননের সময়কাল বছরে প্রায় ছয় মাস। তাই সরকারের নিষেধাজ্ঞার সময়কাল সংশোধন প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষকরা।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক (পুষ্টি) . রফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমায় মাছের প্রজাতি প্রায় একই। প্রজনন মৌসুমও প্রায় একই সময় শুরু হয়। ভারত আগে নিষেধাজ্ঞা শুরু করে শেষ করে ৩১ মে। কিন্তু বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা শুরু হয় ২০ মে। কাজেই দুই দেশে নিষেধাজ্ঞা একই সময়ে হওয়া জরুরি। এতে দুই দেশেরই লাভ। গবেষণার ফল তারা সুপারিশ আকারে মৎস্য অধিদপ্তরকে দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয় বাংলাদেশের। দেশের সমুদ্রসীমায় নতুন করে যুক্ত হয় লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ফলে নিষেধাজ্ঞাসহ নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নে সাগরে বেড়েছে মাছের আহরণ। গবেষকরা যদিও বলছেন, নিষেধাজ্ঞার ফলে সাগরে মাছ আহরণ বাড়লেও কমেছে উৎপাদন হার। সেই সঙ্গে মাছের প্রজাতির গুণগতমানও কমেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয় এবং অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের ফল এটি। তাই প্রজাতি বিলুপ্তির আগেই সুরক্ষার উদ্যোগ নেয়া জরুরি। একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞার সময়কাল সংশোধনের সুপারিশ করেছেন তারা।

মৎস্য অধিদপ্তরের সামুদ্রিক দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ হয়েছে লাখ ৩৪ হাজার ৫৯৪ টন। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে লাখ হাজার ৮৭১ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে লাখ ৮৯ হাজার ১০৪, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লাখ ৫৯ হাজার ৯১১, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লাখ ৫৪ হাজার ৬৮৭, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে লাখ ৩৭ হাজার ৪৭৬, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লাখ ২৬ হাজার ৫২৮, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লাখ ৯৯ হাজার ৮৪৬, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লাখ ৯৫ হাজার ৩৮৫, ২০০৯-১০ অর্থবছরে লাখ ১৭ হাজার ২৮১ টন সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণ হয়েছিল। অর্থাৎ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা বাড়লেও সে হারে বাড়েনি মৎস্য আহরণ।

গভীর সমুদ্র থেকে মাছ আহরণের পর আশপাশের জেলেরা সেগুলো বরগুনার পাথরঘাটায় বিএফডিসি আড়তে তোলেন। সেখানকার আড়তদার সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর জোমাদ্দার জানান, ভারতের নিষেধাজ্ঞা কেটে যাওয়ার পরও ৫৫ দিন বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা জারি থাকে। তাতে বাংলাদেশী জেলেরা সাগরে নামতে না পারলেও ভারতীয়রা এদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যায়। তারা বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারের সব মহলকেই জানিয়েছেন। বিভিন্ন সময় নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামও হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দুই দেশের নিষেধাজ্ঞাকাল সমন্বয় হলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন জেলেরা। তাছাড়া মাছের উৎপাদন হারও তখন বাড়বে বলে মনে করেন মৎস্য ব্যবসায়ী।

সাগরে মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞার সময়কাল এগিয়ে আনার পরিকল্পনা করছেন নীতিনির্ধারকরা। আগামী মৌসুম থেকেই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নিষেধাজ্ঞা শুরু হতে পারে। এতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে ব্যবধান কমে আসবে। গবেষকদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতেই এমন সিদ্ধান্ত বলে আভাস দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। আর সেটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশও কমে আসবে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মাহবুবুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গবেষকরা আমাদের কাছে সুপারিশ পাঠিয়েছেন। গত বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। নিয়ে জেলেসহ অংশীজনের সঙ্গে আমাদের বসতে হবে। তাতে মাস দুয়েক সময় লাগতে পারে। এরই মধ্যে এবারের নিষেধাজ্ঞার সময়কাল শুরু হয়েছে। আশা করা যায়, আগামী মৌসুমে বিষয়টি সমন্বয় হয়ে যাবে।

মহাপরিচালক আরো বলেন, ‘সমুদ্র একটিই, অথচ মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা ভারত আমাদের আগে শুরু করে। শেষও হয় আগে। মিয়ানমারের সঙ্গেও পার্থক্য রয়েছে আমাদের। বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজ করছে। আগামী বৈঠকে বিষয়টি তুলব। তারা আমাদের প্রস্তাব নিলে যৌথভাবে কাজ করা যাবে। তবে মিয়ানমারের সঙ্গে নানা কারণে আমাদের যোগাযোগ সীমিত। তবু আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন