কোনোখানেই সুশাসন কাজ করছে না

ড. এম এম আকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, আইএমএফের ঋণ ও শর্ত, অর্থ পাচার, ব্যাংক খাতে সুশাসন, আসন্ন বাজেট, দ্রব্যমূল্যের বাজারে অস্থিরতা ও বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের উন্নয়ন প্রসঙ্গে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৌফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশে তো নানামাত্রিক উন্নতি হচ্ছে, তার পরও আইএমএফের ঋণ কেন নিতে হলো? 

উন্নয়ন হচ্ছে কি হচ্ছে না—এটা নিয়েও তো মতভেদ আছে। আমি বলব যে উন্নয়নকে যদি সংকীর্ণভাবে অর্থাৎ ন্যূনতম বৈশিষ্ট্যটুকু দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয় তাহলে প্রবৃদ্ধির হার হতে হবে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। তাকে অর্থনীতিবিদরা সংকীর্ণ উন্নতি বলবেন। সেই দিক থেকে নিছক মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি যদি দেখি, তাহলে নিঃসন্দেহে প্রায় দুই দশক ধরে গড় মাথাপিছু আয় ক্রমাগত ৪ থেকে ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে (প্রবৃদ্ধির হার ৫ থেকে ৭ শতাংশ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সাধারণভাবে ২ শতাংশ ধরলে)। অতএব সংকীর্ণ অর্থে উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু বৈদেশিক সাহায্য ও বিনিয়োগ কম হলে মোট বিনিয়োগও কম হতো এবং প্রবৃদ্ধিও কম হতো (যদি ক্যাপিটাল-আউটপুট রেশিও স্থির ধরি)। তখন উন্নয়নও কম হতো (যদি জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার একই থাকত)। অন্যান্য বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এ ধরনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে বেশি, তবে চীন বা পূর্ব এশিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদির তুলনায় তুলনীয় সময়ে কম।

দেহের আকার বাড়লেই স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে—এটা যেমন বলা যায় না তেমনি গড় মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি হলেই উন্নয়ন হচ্ছে এটা বলা যায় না। এর সঙ্গে আরো কয়েকটি আদর্শ মাপকাঠি বিচার করে সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

একটা বিষয় হচ্ছে প্রবৃদ্ধিটা কি বাইরের পরিবেশ, প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে হয়েছে? এ প্রবৃদ্ধি কি নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান বাড়িয়েছে? এর ফলে সামাজিক বৈষম্য, হিংসা বা দ্বন্দ্ব কি কমেছে? সাধারণ মানুষের জীবনে সুখ বা সন্তুষ্টি কি বেড়েছে? নাকি এসব হচ্ছে না অথবা হলেও তা বেশির ভাগ উপরের ১০ শতাংশ এলিট বা ক্ষমতাবানদের জন্যই হচ্ছে?

আমার মতে, এখানে মূলগতভাবে অধিকাংশ জনগণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে শহরে ও গ্রামেও পরিবেশ, প্রতিবেশ ও সামাজিক সহমর্মিতার অবনতি হয়েছে। সমাজে সাধারণভাবে হিংসা বেড়েছে এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পদ অল্প কিছু লোকের জন্য বিশালভাবে ও দৃষ্টিকটুভাবে বেড়েছে। সুতরাং, উন্নয়ন বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠের যে ভারসাম্যপূর্ণ অগ্রগতি বোঝায় সেটি হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) পরিচালক সম্প্রতি বলেছেন, চরম দারিদ্র্য বা দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ছে। এটা বেশ ইন্টারেস্টিং কথা, দারিদ্র্য আয়ের নিচের লোক যারা ছিল তাদের আয় বাড়ছে, সুতরাং কেউ কেউ দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসছে। কিন্তু উপরের দিকে যারা আছে, তাদের উপার্জন এত বেশি বাড়ছে যে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত লোকের সঙ্গে ধনী লোকের বৈষম্য বেড়েই চলেছে, এ বৈষম্য এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। আরেকটি পর্যবেক্ষণ হচ্ছে অনেক নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারও নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ উঠেছেন—সেটাও অবশ্য বিনায়ক সেন বলেছেন। সব মিলিয়ে কী হলো তাহলে? দারিদ্র্য করোনার সময় অনেক বেড়ে (সানেমের মতে ৪০ শতাংশ) গিয়েছিল, এখন তা আবার কমে পূর্বাবস্থার চেয়ে ২ শতাংশ পয়েন্ট (২০ শতাংশ [খানা জরিপ ২০১৬] থেকে ১৮ শতাংশ [খানা জরিপ-২০২২]) নেমেছে বলে বিবিএসের খানা জরিপ দাবি করছে। কিন্তু আবার একই জরিপ অনুযায়ী আয়বৈষম্যের জিনি সহগ বেড়েছে, শহরে তা শূন্য দশমিক ৫৫ হয়ে গেছে। এটা বিপজ্জনক বলে বিনায়ক সেন মনে করেন।

আইএমএফের এতগুলো শর্ত মেনে সরকার কেন ঋণ নিল?

সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে খুব অল্প। ৪ দশমিক ৫ বিলিয়নের মতো ডলার, এটা না নিলে সরকারের চলত না—আমি তা মনে করি না। কিন্তু সরকার মনে করছে এটি যদি নেয়, তাহলে পরবর্তী সময় বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আরো পাবে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছ থেকে পাবে। সেই চেষ্টাই সরকার এখন চালাচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে হঠাৎ করে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানির যে সংকট হয়েছে, ফান্ডের অভাব হয়েছে, এ অবস্থায় তথাকথিত বিদেশী ‘সাহায্য’ (আসলে কনসেশনাল ঋণ!) বা বিদেশী ডলার হলো সংকট এড়ানোর একটা সহজ উপায়। যখন আমরা ডলার সংকটে পড়ি, তখন আমরা তিনটি জিনিস করতে পারি। একটি হলো ডলার নিয়ে দুর্নীতি কমানো, ডলার অপচয় কমানো, ডলারের আয় বাড়ানো অথবা আরো বিপ্লবী পদক্ষেপ হতে পারে ডলারের বদলে অন্য কারেন্সি ব্যবহার করা। সহজে যেটা করতে পারি তা হলো, ডলার ঋণ নিয়ে সংকট আপাতত পার হয়ে গেলাম, পরে যখন ঋণ শোধ করার সময় আসবে তখন আমরা বিপদে পড়লে পড়ব। কিন্তু সে সময় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় নাও থাকতে পারে, অথবা থাকতেও পারে। সরকার কী ধরনের সময় দিগন্তের কথা চিন্তা করছে তার ওপর বিষয়টা নির্ভরশীল। সব পথই সরকারের সামনে খোলা ছিল বলে আমি মনে করি।

এখন আইএমএফের শর্ত মেনে নিয়েই সরকার ঋণ নিচ্ছে। যদিও সরকার বলছে, আমরা সারে কিছুটা ভর্তুকি দিচ্ছি তা কমাব না। অন্যান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যের ক্ষেত্রেও ভর্তুকি দিচ্ছি। সেগুলোও এ মুহূর্তে হয়তো নির্বাচনের আগে কমাবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের যে ক্রয়ক্ষমতা তাতে এটুকু ভর্তুকির পরও দাম সহনীয় মাত্রায় নামছে না, মূল্যস্ফীতি হয়েই চলছে। বিশেষত নিত্যপ্রয়োজনীয় আমদানি দ্রব্যগুলোর ক্ষেত্রে তা প্রকট। এসব ক্ষেত্রে তাই ভর্তুকি বাড়ানো বা অব্যাহত রাখা বা সিন্ডিকেট দমন ছাড়া সরকার জনপ্রিয় থাকতে পারবে না, আশু নির্বাচন সামনে রেখে ‘‌শ্যাম রাখি না কুল রাখি’—এটাই হবে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ। 

আইএমএফের সব শর্ত ‍কিন্তু খারাপ নয়। একটি শর্ত হচ্ছে, প্রতি বছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পয়েন্টে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করতে হবে। আমিও মনে করি, আমাদের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও ৯ শতাংশ যা দক্ষিণ এশিয়ায় নিম্নতম (তবে পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান সাহেব ব্লুমবার্গের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করেন যে বাংলাদেশের এ অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ!)। কিন্তু মূল প্রশ্ন, আইএমএফের শর্ত পূরণ কি সম্ভব? অনেক কিছু নির্ভর করবে এটা সরকার কীভাবে করবে তার ওপর। জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে ও ভর্তুকি প্রত্যাহারের বোঝা বাড়িয়ে দিয়ে করবেন নাকি ধনীদের বাড়তি আয় কমিয়ে করবেন—সেটা সরকারের শ্রেণীগত পক্ষপাতিত্বের ওপর নির্ভর করবে। 

দিন শেষে আইএমএফ কিন্তু এত কিছু দেখবে না। যেটা দেখবে, কিস্তি ও সুদ শোধ হলো কিনা? যেখান থেকেই হোক, কর আদায় করে সরকার সেটা করতে পারছে কিনা। আবার আমরা মনে করি, সরকার যদি ধনিক শ্রেণীর কাছ থেকে কর আদায় করতে পারত অথবা টাকা পাচার কমানো যেত অথবা তথাকথিত সিস্টেম লস বা দুর্নীতি যদি কমানো যেত, মেগা প্রকল্পে অতি ব্যয় কমানো যেত, খেলাপি ঋণের অংশবিশেষও আদায় করতে পারত, তাহলে হয়তো আইএমএফের ঋণটাই নিতে হতো না, প্রতিকূল শর্তও মানতে হতো না। এটি ছিল দেশপ্রেমিক সরকারের সঠিক রাস্তা। উল্টোদিকে যদি সরকার ধনীদের কাছ থেকে কর নিতে অপারগ হয় এবং গরিবদের কাছে যে টাকা যাচ্ছে, সেটি যদি ডেলিভারি পাইপের ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে যেতে থাকে, যথাস্থানে না পৌঁছায় তাহলে সংকট থেকে সহজে সরকার মুক্তি পাবে না, আবার আইএমএফের ঋণের বোঝাও বাড়বে এবং দুটো মিলিয়ে পরবর্তী সময়ে একটা অসহনীয় অবস্থা তৈরি হবে। আইএমএফও মাঝপথে ঋণের ফাঁসটাকে ধীরে ধীরে শক্ত করতে থাকবে। 

দেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ে প্রায়ই গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। সরকারের অনেকে এ বিষয়ে কথা বলেন, তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন? 

সরকার তো একটা রাজনৈতিক ক্ষমতা। এ ক্ষমতা বিভিন্ন শ্রেণীর একটি কোয়ালিশন। এখন সংসদে ব্যবসায়ীদের কোয়ালিশন আধিপত্য বিস্তার করে আছে। সরকার জানে আগামী নির্বাচনে যদি জিততে হয়, তাহলে কোটি কোটি টাকা নির্বাচনী ব্যয় লাগবে। এ টাকা সেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই পাওয়া যাবে। সরকার মনোনয়নও তাদের দিচ্ছে, যাদের কোটি টাকা খরচ করার বা জোগাড় করার ক্ষমতা আছে। তার মানে সরকার কিন্তু কোটিপতিদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। আমরা বলি, পর্দার অন্তরালে কোটিপতিদের ক্লাবই এখন রুলিং ক্লাস। তাহলে রুলিং ক্লাসের ডালের ওপর পাখি বসে আছে। পাখি সে ডাল কাটবে কীভাবে? এটাই হচ্ছে সরকারের উভয় সংকট। সরকার যেটা করতে পারে, ডালের কিছু শাখা-প্রশাখা অন্তত কাটতে পারে। এবং জলজ্যান্ত খারাপ অপরাধ যেগুলো প্রমাণিত, সেগুলোর কিছু শাস্তি দিতে পারে। সরকার কিন্তু এখন আর সেগুলোও দিতে পারছে না। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে, বরং কঠোর ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি না হলেও মৌলবাদী আদর্শে বিশ্বাস করে অর্থাৎ ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েম করতে চায়, এ রকম লোকদের সঙ্গে সরকার কোয়ালিশন করা শুরু করেছে। আকারে-ইঙ্গিতে মদিনা সনদের কথাও এক-দুবার বলেছে। সরকার ভাবছে এতে তার রাজনৈতিক শক্তি বা জনভিত্তি কিছুটা হলেও বাড়বে। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে সন্দিহান।

অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চাল, চিনি, সয়াবিন তেলের মতো বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশি। এমনটি হওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?

নিশ্চয়ই অন্যান্য দেশে যতটুকু প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা কাজ করে এ দেশের বাজার ব্যবস্থা ততটুকু প্রতিযোগিতামূলক নয়। এর মাঝে অনেক ফাঁক আছে। যেমন মধ্যস্বত্বভোগীরা আছে, সিন্ডিকেট আছে, আমদানি লবি আছে। যারা হোলসেল আমদানি করে, তারা যদি ধরে রাখে বা সঠিক সময়ে আমদানি না করে, আমি এগুলো প্রাইভেট সেক্টরের ক্ষেত্রে বলছি। তাহলে সে আমদানি লবি খাতুনগঞ্জের হোলসেলার, মাঝখানের মধ্যস্বত্বভোগী সরবরাহকারী, অবৈধ চাঁদাবাজরা কৃত্রিমভাবে মূল্য বাড়িয়ে রাখতে পারে। ফলে অস্বাভাবিক মুনাফার সৃষ্টি হয় ও অনেকে তার ভাগ পায়। আমরা এটাকে বলি মনোপলি বাজারের প্রভাব। বাজারে যদি এসব অস্বাভাবিক মুনাফাভোগী শ্রেণীর আধিপত্য থাকে, তাদের মধ্যে যদি একটা লিংকেজ ও কো-অর্ডিনেশন থাকে, তাহলে ভোক্তা সে মার্কেটে অসহায়। সুতরাং, তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়, ইচ্ছামতো দাম কমায়। এক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব ছিল, এগুলোকে ভেঙে দেয়া। আবার ভেঙে দিতে গেলে দেখা যাবে যে এরা জিনিসপত্রগুলো গুদামে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠিয়ে দেবে। তখন বাজার থেকে একদম জিনিসই উধাও হয়ে যাবে। এ ডিলেমা ফেস করার ক্ষেত্রে সরকারের আরেকটি কাজ করা উচিত ছিল। এক-তৃতীয়াংশ পণ্য গুদামে রেখে দেয়া দরকার ছিল। এবং দাম কম থাকলে ছাড়বে না, কিনবে। আর দাম যখন বেশি থাকবে, তখন বিক্রি করবে। তাহলে দামটা ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ না করে সরকারই নিয়ন্ত্রণ করত। এখন ওপেন মার্কেট সেলস চালু আছে, তবে তা পর্যাপ্ত ও সর্বত্র নয়। একটা হতে পারে টার্গেটেড রেশন। এটাও চালু আছে কিন্তু তা কাদের জন্য এবং কতটুকু তা স্বচ্ছ নয়।

দেশের ব্যাংক খাতের সুশাসন ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? 

সুশাসন ও শৃঙ্খলা তো আগে ব্যাংকের মালিক-পরিচালকদের মধ্যে আনতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে মালিকসহ যারা আছেন, তারা যদি সুশাসক না হন তাহলে ব্যাংকে কখনো সুশাসন ফিরে আসবে না। আইন করে যদি দুঃশাসকদের সরানো না যায় বা সরানোর ব্যবস্থা না থাকে, তাহলেও সুশাসন টেকসই হবে না। এখন ব্যাংকিং আইনে ব্যাংকের বোর্ডের অধিকাংশ মালিকানা ব্যক্তিগত মালিকদের ও তাদের আত্মীয়দের কাছে চলে গেছে। ব্যক্তিগত মালিকরা শুধু ব্যাংক চালান না, ব্যাংক থেকে তারা আপামর মানুষের যে আমানত সংগ্রহ করেন, সেটাকে নিয়মমতো ফেরত দেয়ার বদলে তারা এটির ভক্ষক হয়ে গেছেন। সুতরাং মালিকদের বা বোর্ডকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমানতকারীদের স্বার্থ বিপন্ন হবে। আগে একটা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন একজন বোর্ড মেম্বার থাকতেন। যিনি ওখানে থাকতেন, নিয়মকানুন না মানা হলে বোর্ডকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতেন। যেহেতু ব্যাংক একটা ফান্ড বাংলাদেশ ব্যাংকে জিম্মি হিসেবে রেখে দেয়, সেটাকে ভিত্তি করে তারা একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখন নিজের স্বাধীনতা বজায় রেখে নিয়মনিষ্ঠভাবে ব্যাংকগুলো চালাতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে আগে যে স্বাধীন প্রশাসন ছিল, সেটি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে গেছে বলে শোনা যায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের লোকরা এখন সেসব পদে চলে আসছেন, যেখান থেকে রাজনীতির জন্য ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করা মোটেও কঠিন নয়। মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ মানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ তথা সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণ। সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে যখন অর্থনীতি পরিচালিত হয়, তখন সেটিকে আমরা বলি ক্রনি ক্যাপিটালিজম বা স্বজন তোষণমূলক পুঁজিবাদ। আমাদের এখানে পুঁজিবাদের যে বাজার অর্থনীতির নিয়ম, সেটা কাজ করছে না। আবার যেখানে সরকারি হস্তক্ষেপ নেই সেখানে সুস্থ প্রতিযোগিতা নেই। সেখানে তখন আবার সরকারি প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ কাজ করছে না। আর সরকারি-বেসরকারি দুই খাতেই স্বজন তোষণমূলক নীতি দিয়ে চালানো হচ্ছে। সুতরাং কোনোখানেই সুশাসন কাজ করছে না। তার মানে তিনটি জায়গাতেই একই সঙ্গে সংস্কার ছাড়া সুশাসন হবে না। এর শুরুটা হতে হবে রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে। এবং রাজনৈতিক সংস্কারের শুরুটা হতে হবে সংসদে জনগণের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে। তার মানে, আল্টিমেটলি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে যেখানে টাকা, পেশিশক্তি, অর্থ এবং প্রশাসনের কারসাজি থাকবে না এবং ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’। এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে পারি এবং মানুষ যদি আর ভোট বিক্রি না করে এবং তাদের পছন্দসই ব্যক্তিকে ভোট দেয়, তাহলে সে এমপিদের মাধ্যমে জনকল্যাণের আশা করা যায়, বস্তুত এটি সামগ্রিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ব্যাপার। 

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের এ সময়ে আসন্ন বাজেট নিয়ে আপনার প্রত্যাশা।

প্রথমত, বাজেট তো বড় হবেই, কিন্তু বড়-ছোট নিয়ে আগে বিতর্ক হতো, এখন বড় বাজেট হবে তা সবাই ধরেই নিয়েছে। কিন্তু বড় বাজেটটা কি অধিক বিদেশী সাহায্যনির্ভর হবে, নাকি স্থানীয় সম্পদ সংগ্রহ করে হবে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বাজেট যত বিদেশী সাহায্য নির্ভর তত সরকার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আর বিদেশ থেকে না নিয়ে যদি স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তাহলে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর ঋণ এবং ফান্ড কমে যাবে। বেসরকারি খাত ও সরকারের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে। অনেক সময় আমরা বলি ক্রাউডিং অ্যাফেক্ট হবে। তার মানে, স্থানীয় রিসোর্স বাড়াতে হবে। স্থানীয় রিসোর্স বাড়াতে হলে করের হার বাড়িয়ে হবে না, আয়কর যেসব জায়গা থেকে আরো সংগ্রহ করা উচিত কিন্তু করা যাচ্ছে না। যেমন অতিউচ্চ ধনীদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য টার্গেট করে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। আর যদি ভ্যাটের মাধ্যমে বাড়াতে চায়, তাহলে ভ্যাট বাড়ালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং মুদ্রাস্ফীতি আরো বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং এ জটিল সমীকরণ এ বাজেটে মেলাতে হবে। যাতে দেশীয় সম্পদের পরিমাণ আপেক্ষিকভাবে ‍বৃদ্ধি পায়, অথচ অপরোক্ষ সাধারণের ওপর ট্যাক্স বৃদ্ধি না পায়, বিদেশী ঋণের চেয়ে স্থানীয় ঋণ গুরুত্বপূর্ণ হয় এবং স্থানীয় ঋণ যখন সরকার নেবে, তখন যেন ক্রাউডিং অ্যাফেক্ট না হয়, অন্তত ছোট, মাঝারি ও মাইক্রো এন্টারপ্রাইজগুলোর ঋণ ফান্ড যাতে থাকে এসব দেখতে হবে। বৃহৎ প্রকল্পগুলোর জন্য সরকারকে হয়তো টাকা নিতেই হবে, কিন্তু তখন এটাও দেখতে হবে মেগা প্রকল্পের ব্যয় যেন ১ টাকারটা ৩ টাকা না হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় অগ্রাধিকার দিয়ে বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের উন্নয়নকে আপনি কীভাবে দেখেন?

বাংলাদেশের চরম দারিদ্র এবং নিচের দিকের লোক একসময় ৫০ বা ৭০ শতাংশ ছিল। সেটা কমে গেছে, কিন্তু সেটা কমলেও যেকোনো বিপদ হলে যে সেটা বেড়ে যায়, সেটা কভিডের সময়ে আমরা দেখেছি, ৪০ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার বিআইডিএসের গবেষণা বলছে কমেছে কিন্তু এটা ১৮-২০ শতাংশ হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। তবে আমি যেসব নীতির কথা বললাম, সেগুলো যদি গ্রহণ করা না যায়। সে রিফর্মগুলো না হয়, তাহলে এ দারিদ্র্যের হার হয়তো কমবে কিন্তু বেশি কমবে না। আমরা তো দারিদ্র্যশূন্য, ক্ষুধাশূন্য বাংলাদেশ চাই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা যেটা বলা হয়, সেটি যদি চাই, তাহলে আমাদের সে সংস্কারগুলো করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা আমাদের এ ৫০ বছরের প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, কিন্তু বিরতিহীনভাবে ক্রমাগত বৈষম্য বেড়েছে। শুরুতে যে আয়বৈষম্য ছিল, এখন তার চেয়ে তা অনেক বেড়েছে। এ বৈষম্য বেড়েছে ন্যায়পরায়ণতা লঙ্ঘন করে। এমন হতে পারে যে একজন লোক বিল গেটসের মতো খুব বেশি গুণী, যে হয়তো একটি নতুন থিউরি আবিষ্কার করেছে, কম্পিউটার সফটওয়্যার আবিষ্কার করেছে। সে তার আবিষ্কারের জন্য অনেক টাকা আয় করেছে, আরেকজন লোক অত গুণী না, অত পরিশ্রমী না। সুতরাং আয় করতে পারেনি। সে রকম পরিশ্রমের ভিত্তিতে ধনী হলেও একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখানে লুটপাট, সিন্ডিকেট এবং বিদেশে অর্থ পাচার করে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে অল্প কিছু লোক ধনী হচ্ছে। এদের পুঁজির একটি বড় অংশ দেশের ভেতরে কোনো উৎপাদনশীল কাজে লাগছে না। তাহলে এই যে অনুৎপাদনশীল ধনী এবং তারা যে রকেটের গতিতে ধনী হচ্ছে আর উৎপাদনশীল দরিদ্র শ্রেণী, তারা যে শামুকের গতিতে আয় বাড়াচ্ছে। এটাই হলো বাংলাদেশের উন্নয়নের সীমাবদ্ধতার মেজর ডায়াগনসিস। সুতরাং আমাদের যেটা করতে হবে গরিবদের আয়ের উন্নতি রকেটের গতিতে করতে হবে। আর ধনীদের আয়ের উন্নতি শামুকের গতিতে করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন