উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে

. এফ এইচ আনসারী বর্তমানে এসিআই এগ্রোলিংক লিমিটেড, এসিআই মোটরস লিমিটেড প্রিমিয়াফ্লেক্স প্লাস্টিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে রয়েছেন। কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের কৃষি খাতের বিভিন্ন দিক আসন্ন বাজেট নিয়ে সম্প্রতি তিনি বণিক বার্তা সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত বিপ্লব

দেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় শক্তি কৃষি। দেশের ভবিষ্যৎ কৃষি ব্যবস্থা কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন?

আমাদের দেশে কৃষি যেভাবে এগোচ্ছে তাতে ভবিষ্যৎ অবশ্যই ভালো। করোনার পর থেকে অনেক তরুণ জনশক্তি গ্রামে গিয়ে কৃষি উদ্যোক্তা হচ্ছেন। কেউ ফার্মিং করছেন। কৃষির সঙ্গে আমাদের দেশের অনেক জনশক্তি যুক্ত রয়েছে। সরকারও অনেক সাপোর্ট দিচ্ছে। অনেক বড় কোম্পানি যারা আগে কৃষিতে বিনিয়োগ করত না তারাও এখন কৃষি খাতে বিনিয়োগ করছে। বিদেশী কোম্পানিগুলোও দেশীয় কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিনিয়োগ করছে। সর্বোপরি কৃষির একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আবার দেশে অভ্যন্তরীণ মার্কেট অনেক বড় বৈচিত্র্যপূর্ণ। আগে আমরা যা উৎপাদন করতাম তা শুধু ভাত বা সবজি হিসেবে খেতাম। কিন্তু এখন নানাভাবে সেগুলো মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। এছাড়া অনেক দেশ আছে যেখানে আমাদের দেশের কৃষিপণ্য রফতানির একটি বড় সুযোগ রয়েছে। তার পরও যদি আমরা ইউরোপের কথা বলি সেখানের অনেক বড় কোম্পানি যৌথভাবে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তারা সেগুলো দেশের মার্কেটে যেমন দিচ্ছে, তেমনি রফতানিও করছে। একারণে আমি বলব কৃষির ক্ষেত্রে একটি বিরাট সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে আমাদের জিডিপিতে বড় ধরনের অবদান রাখবে।

কৃষি প্রাণিসম্পদ খাতে কন্টাক্ট ফার্মিং বাড়ছে। ভবিষ্যতে কি আরো বাড়বে? এতে কৃষকের ক্ষতির শঙ্কা আছে কি?

কন্টাক্ট ফার্মিং যেমন বাড়ছে, তেমনি কৃষি উদ্যোক্তাও বাড়ছে। কৃষি উদ্যোক্তারা কিন্তু খুব বেশি নিজেদের মালিকানায় নেই। ফলে জমি ভাড়া করে কৃষককে সঙ্গে নিয়ে তাদের কাজ করতে হয়। সুশিক্ষিত মানুষ যখন কন্টাক্ট ফার্মিংয়ে যাচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে সর্বোপরি উৎপাদন বেড়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে কৃষকও তার দাম পাচ্ছে। কৃষকের প্রযুক্তিগত সহায়তার পাশাপাশি লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে না। অর্থাৎ কন্টাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে আমাদের কৃষিতে একটি বড় পরিবর্তন হচ্ছে।

বিভিন্ন শস্য, গবাদিপশু, মাছ পোলট্রির উৎপাদনশীলতা অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের কম। এক্ষেত্রে করণীয় কী?

আমরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বলে থাকি শীর্ষে রয়েছি। কিন্তু এর কোনো মূল্য নেই। ভিয়েতনাম এক হেক্টর জমিতে ধান করে ছয়-সাত টন, চীন ছয়-সাত টন করে এক্ষেত্রে যদি আমরা বলতে পারি আমরাও ছয়-সাত টন করি তখন বলতে পারব আমরা কৃষিতে এগিয়েছি। আমাদের এখন উৎপাদনশীলতা হেক্টরপ্রতি চার টন। আমাদের এক কেজি মাছ উৎপাদন করতে দেড় থেকে পৌনে দুই কেজি খাদ্য খাওয়াতে হয়। যেখানে থাইল্যান্ড ভিয়েতনামে . বা . কেজি খাবার খাওয়ালেই হয়। তাদের মতো উৎপাদনশীলতা বাড়ানো গেলে খরচ অনেক কমে যাবে। আমাদের দেশের গাভীগুলো থেকে গড়ে দৈনিক পাঁচ-ছয় লিটার দুধ পাওয়া যায়। এটাকে যদি ৩০-৪০ লিটারে আমরা নিতে পারি তখন আমাদের কৃষক লাভবান হবে। সর্বোপরি উৎপাদনশীলতা অনেক বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের দেশে জমি অনেক কম। একারণে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। এজন্য প্রযুক্তি লাগবে জাত উন্নয়নের জন্য। ভালো জাতও আনতে হবে। এর সঙ্গে অনুশীলন বাড়াতে হবে। অর্থাৎ পুরো চেইন ভালোভাবে মেইনটেইন করতে হবে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে? সংকট কোথায়?

আমাদের দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে অনেক এগিয়েছে। জমিতে এখন প্রায় ৯০ ভাগেই ট্রাক্টর ব্যবহার হচ্ছে। সেচের আওতায় এসেছে প্রায় ৯৫ ভাগ। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা অনেক দুর্বল। যেমন মাত্র শতাংশ জমিতে যন্ত্রের মাধ্যমে ধান লাগানো হয়। আবার - শতাংশ জমিতে মেশিনের মাধ্যমে ধান কর্তন করা হয়। আমাদের দেশের যারা কৃষক রয়েছেন তাদের মেশিনের ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এক হেক্টর জমিতে ম্যানুয়ালি চারা লাগাতে প্রায় ১৪-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু যন্ত্রের মাধ্যমে ধান লাগালে কারো যদি নিজস্ব মেশিন থাকে তাহলে খরচ হবে হাজার টাকা। আর যে ভাড়া করে লাগাবে তার খরচ হবে হাজার টাকা। তাহলে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে এখানে প্রায় দুই-আড়াই টাকা উৎপাদন খরচ কমে যাচ্ছে। আবার ম্যানুয়ালি ধান কর্তন করতে প্রতি হেক্টর জমিতে খরচ হয় ২৮-২৯ হাজার টাকা। কিন্তু মেশিন দিয়ে ধান কর্তন করা হলে খরচ হবে ১৪ হাজার টাকা। নিজস্ব মেশিন থাকলে - হাজার টাকা খরচ হবে। এখানেও প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে - টাকা কমানো সম্ভব। এখন শুধু আমরা ধানে ফোকাস করছি। অন্য ক্ষেত্রেও ফোকাস বাড়াতে হবে। বাজেট বাড়িয়ে দিয়ে যান্ত্রিকীকরণের কনসেপ্টকে আরো বিস্তৃত করতে হবে। এখন ৩২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এটাকে যদি হাজার কোটি টাকা করে গরু, মাছ পোলট্রিতেও গুরুত্ব দেয়া হয় তাহলে সব ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাবে। উৎপাদন খরচ কমে যাবে। ভোক্তাও অনেক কম দামে কিনতে পারবে। আবার যে উৎপাদন করবে তারও অনেক লাভ হবে। সবচেয়ে সংকট তৈরি হচ্ছে এখনই শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে সংকট আরো বাড়াবে। আবার মেশিন দিয়ে ধান কাটলে শতাংশ ধান নষ্ট হয়। অন্যদিকে শ্রমিকের মাধ্যমে ধান কাটা হলে সেখানে প্রায় ১৩ শতাংশ পর্যন্ত ধান লস হয়। একারণে যান্ত্রিকীকরণ করা হলে একদিকে খরচ কমবে, অন্যদিকে প্রডাকশন লস কম হবে। এতে উৎপাদন খরচও কমে যাবে।

দেশে কৃষি যন্ত্রাংশ অনেকটা আমদানিনির্ভর। এক্ষেত্রে দেশীয় সক্ষমতা অর্জনে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

আমাদের দেশে অনেক যন্ত্রাংশ উৎপাদন হচ্ছে ছোট পরিসরে। শুধু কম্বাইন্ড হারভেস্টারের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। এটা খুব সেনসিটিভ একটি মেশিন। ইমিডিয়েটলি এটা দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ আমাদের মার্কেট এখনো অনেক ছোট। বড় পরিসরে হলে তখন উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হবে। ট্রাক্টরের ক্ষেত্রে হাজার ৫০০ ট্রাক্টর আমদানি হয়। এটা খুব অল্প। একারণে পরিসর বড় না হলে কারখানা করা সম্ভব নয়। কিন্তু ছোট যন্ত্রের জন্য অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে। স্থানীয়ভাবে কৃষি যন্ত্র উৎপাদনের একটি বড় মার্কেট তৈরি হচ্ছে। আমি মনে করি দেশীয়ভাবে উৎপাদন করা গেলে অনেক লাভ হবে।

কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াকরণ দেশের অর্থনীতির জন্য কতটা সম্ভাবনাময় বলে আপনি মনে করেন?

কৃষি প্রক্রিয়াকরণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যা কিছু আমাদের দেশে উৎপাদন করি তা আমরা তাজা রান্না করে খাই। কিন্তু এগুলো যদি প্রক্রিয়াকরণ করি তাহলে অপচয় অনেক কম হতো। প্রক্রিয়াকরণের বাজার যদি বড় হয় তাহলে এটা দেশের বাইরেও রফতানি করার সুযোগ তৈরি হবে। দেশের বাইরে অনেক পণ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে রফতানি হয়। কিন্তু তা অল্প পরিসরে। আমাদের মেইনস্ট্রিম বাজারগুলো ধরতে হবে। আমি মনে করি সরকার যদি পোস্ট হারভেস্টে নজর দিতে পারে তাহলে সিস্টেমটা গড়ে উঠবে। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে যাওয়া পর্যন্ত যে ভ্যালু চেইন সেটা কিন্তু বাংলাদেশে সমুন্নত হয়নি। ৫০ বছরে বাংলাদেশ ফোকাস করেছে উৎপাদন বাড়ানোর। উৎপাদন বেড়েছে। এখন ফোকাস করতে হবে প্রক্রিয়াকরণে। এতে বাজারে দামও স্থিতিশীল থাকবে। সিঙ্গাপুরে খাদ্য উৎপাদন না করেও তারা ভ্যালু চেইনে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। ভোক্তাও লাভবান হচ্ছে। আমদানিকারকরাও লাভবান হচ্ছে। আমাদের দেশেও এদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

কৃষিপণ্য উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য এবারের বাজেটে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

সারের দাম বেড়েছে। ডিজেলের দাম বেড়েছে। এক্ষেত্রে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। আবার কৃষিতে যেহেতু যান্ত্রিকীকরণের প্রভাব রয়েছে এক্ষেত্রে এখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিবছর ৫০০-৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থেকে যদি দ্বিগুণ করা হয় তাহলে দ্রুত কৃষির অগ্রগতি সম্ভব হবে। আবার উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য উদ্ভাবনে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেসরকারি খাতকে ইনসেনটিভ দিয়ে এসব কাজে যুক্ত করা হয়। যার ফলে ভারতও প্রচুর বীজ নিজেরা উৎপাদন করে রফতানি করে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক বীজ আমদানি করতে হয়। সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করতে হবে। এজন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশে কম্পোজিট ফুড ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনা কতটুকু? খাতের উন্নয়নে সরকারের কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?

বাংলাদেশে কম্পোজিট ফুড ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনা অনেক। আমাদের সন্তানরা এখন ট্র্যাডিশনাল খাদ্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়। তারা অন্যান্য খাবারও খাচ্ছে। কারণে সরকারিভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি বিদেশী যেসব কোম্পানি আমাদের দেশে আসছে তাদেরও সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে খাতে উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন