আলোকপাত

করপোরেট পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্তকরণের গুরুত্ব

ড. সামসুল আলম, ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া

কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে নারী সদস্যের অন্তর্ভুক্তি এবং পর্ষদের বৈচিত্র্য সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। বিনিয়োগকারী, কর্মচারী এবং গ্রাহকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ঐকমত্য তৈরি হয়েছে যে বৈচিত্র্যময় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্ষদ এখন কেবল সমতা এবং ন্যায্যতার বিষয়ই নয়, বরং এটি কোম্পানির সাফল্য এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকরণও বটে। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে নারী-পুরুষের সমন্বয় এবং সমতা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন কোম্পানিগুলোর এটিকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত তার অনেকগুলো যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে।৷

প্রথমত, পর্ষদে বৈচিত্র্যময় দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ সদস্য থাকলে পর্ষদ কোম্পানিকে ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে পরিচালিত করতে পারে; কারণ বহুমাত্রিক মতামত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব বিকল্পকে সামনে নিয়ে আসে যা ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, পর্ষদের একটি সিদ্ধান্ত নারী ও পুরুষের ওপর সম্ভাব্য কী প্রভাব ফেলতে পারে তা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি করতে পারবে পুরুষ ও নারী পরিচালকের সমন্বয়ে গঠিত একটি পর্ষদ। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় বৈচিত্র্যময় পর্ষদ ভারসাম্যপূর্ণ এবং ন্যায্য ফলাফলসহ সৃজনশীল এবং কার্যকর সমাধানের দিকে কোম্পানিকে পরিচালিত করবে—এ কথা গবেষণার ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব কোম্পানির পর্ষদে নারীর উপস্থিতি বেশি সেসব কোম্পানির আর্থিক ফলাফল অপেক্ষাকৃত ভালো। পর্ষদে নারী সদস্যের উপস্থিতি বিভিন্ন পরিসরের কর্মচারীদের আকৃষ্ট করতে এবং ধরে রাখতে সাহায্য করে, যা কোম্পানির উদ্ভাবনী এবং উৎপাদন ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। এছাড়া বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে খ্যাতি এবং বিশ্বাস হলো সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গঠিত পর্ষদ কোম্পানির ব্র্যান্ডের মূল্য বৃদ্ধি করাসহ বাজারে খ্যাতি বজায় রাখতে এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আস্থা তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে নারীর অংশগ্রহণ বেশি অথবা যেসব কোম্পানি পর্ষদে নারীর উপস্থিতি সমর্থন করে সেসব কোম্পানি তাদের কর্মচারী, গ্রাহক এবং বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়। পরিচালনা পর্ষদে নারীর উপস্থিতি কোম্পানিকে সমাজের প্রতি আরো দায়িত্বশীল হতে প্রভাবিত করে, যা নতুন নতুন গ্রাহককে কোম্পানির প্রতি আকৃষ্ট করা এবং বিদ্যমান গ্রাহককে ধরে রাখতে সাহায্য করে।

অধিকন্তু পরিচালনা পর্ষদে নারীর উপস্থিতি ন্যায্যতা এবং সমতার একটি বিষয়ও বটে। নারীরা বিশ্ব জনসংখ্যার অর্ধেক, কিন্তু কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদসহ নেতৃত্বের পদে তাদের উপস্থিতি ও প্রতিনিধিত্ব এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে কম। নারী প্রতিনিধিত্বের এ অভাব শুধু নারী-পুরুষের বৈষম্যকেই স্থায়ী করে না, বরং কোম্পানির সাফল্যে অবদান রাখতে নারীর দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা ব্যবহার করার সুযোগকেও অস্বীকার করে। বোর্ডে নারীদের সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা গেলে নারী-পুরুষের সমতা অর্জন এবং ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায্য সমাজ গঠনে দেশ ও সমাজ অনেকদূর এগিয়ে যাবে। অধিকন্তু নারী-পুরুষের বৈচিত্র্যময় একটি পর্ষদ সব কর্মচারীর জন্য একটি সহায়ক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করে, যা বৈষম্য কমাতে এবং সামগ্রিক কর্মচারীর সন্তুষ্টি ও মনোবল উন্নত করতে সাহায্য করে।

দ্বিতীয়ত, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে পরিচালনা পর্ষদে নারীর অন্তর্ভুক্তি শুধু ন্যায্যতা এবং ন্যায়বিচার অর্জনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং কোম্পানিগুলোর দায়িত্বশীল এবং টেকসইভাবে কাজ করার জন্যও তা সমানভাবে কার্যকরী। পর্ষদে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ কোম্পানির মধ্যে অন্তর্ভুক্তি এবং সম্মানের সংস্কৃতিকে উন্নীত করে। বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী এবং নানা ব্যাকগ্রাউন্ডের সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি পর্ষদ সহজেই যুগ যুগ ধরে করপোরেট আবহে টিকে থাকা অনেক অনুমিত শর্তকে চ্যালেঞ্জ করার মতো মনোবল রাখে। এতে করে কোম্পানিগুলো জটিল সমস্যার ওপর নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে তা সমাধানে জুতসই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। 

অন্যদিকে শেয়ারহোল্ডারদের সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর তাদের স্টেকহোল্ডার যেমন কর্মচারী, কাস্টমার, সরকার, পাওনাদার, তথা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের স্বার্থে কাজ করার দায়িত্ব রয়েছে। পরিচালনা পর্ষদের নারীর অংশগ্রহণ এটা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে যে কোম্পানির সিদ্ধান্তগুলো শুধু কোনো একটি একক গোষ্ঠীর স্বার্থে নয়, বরং সব স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ মাথায় রেখে নেয়া হয়।৷ যেসব কোম্পানি তাদের পর্ষদে নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে তারা কেবল সমাজের জন্য সঠিক কাজটিই করছে না, বরং অন্যান্য কোম্পানির জন্য অনুসরণ করার মতো উদাহরণ তৈরি করেছে, যা নৈতিক ও দায়িত্বশীল ব্যবসা প্রসারণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। 

তৃতীয়ত, কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় রাষ্ট্রের নানা সম্পদ ব্যবহার করে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিক দেশের জনগণ, সেহেতু সমাজের প্রতি কোম্পানির কিছু দায়বদ্ধতা থেকেই যায়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সবুজ পৃথিবী গঠনে কোম্পানিগুলোর সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ কমানোর পাশাপাশি এরই মধ্যে সঞ্চিত কার্বনের স্টক কমানোর জন্যও বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। গবেষণায় দেখা যায় যে যেসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে নারীর অংশগ্রহণ বেশি, সেসব কোম্পানি পরিবেশের প্রতি অধিক সংবেদনশীল। পরিবেশ রক্ষায় তারা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি আবিষ্কার এবং ব্যবহার বেশি করে। অধিকন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি হ্রাস এবং তা থেকে উদ্ভূত ব্যবসায়িক সুযোগগুলো বেশি করে কাজে লাগাতে পারে যদি পর্ষদে নারী সদস্যের উপস্থিতি বেশি থাকে।

নারীর অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়ে কোম্পানিগুলো যাতে সুফল ভোগ করতে পারে তার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে নারীর অংশগ্রহণ একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় উন্নীত করার লক্ষ্যে দেশে দেশে বহু আইন রয়েছে। যেসব দেশে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আইন প্রণয়ন হয়নি সেসব দেশে কোম্পানিগুলোকে তাদের পর্ষদে নারী-পুরুষের অনুপাতের পরিসংখ্যান প্রকাশ এবং পর্ষদে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর নিমিত্তে কী ধরনের পদক্ষেপ এরই মধ্যে গ্রহণ করেছে বা ভবিষ্যতে করবে তার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা 

প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ইউরোপের কোম্পানিগুলো নারীর ক্ষমতায়ন এবং পর্ষদে নারী-পুরুষের সমতা আনয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন ২০১২ সালে গৃহীত ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ডাইরেক্টিভ অব জেন্ডার ব্যাল্যান্স অন করপোরেট বোর্ড’ সম্পর্কিত ইইউ একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করেছিল যাতে ২০২০ সালের মধ্যে কোম্পানির পর্ষদে ন্যূনতম ৪০ শতাংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ করা হয়েছিল। যদিও নির্দেশটি বাধ্যতামূলক ছিল না, কিন্তু এটি কোম্পানির পর্ষদে নারী সদস্যের অন্তর্ভুক্তিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। ফ্রান্স ও নরওয়েও একই রকম নীতি গ্রহণ করেছিল।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে আলোচনা এবং বিতর্ক অনেক দিন থেকেই চলছে। যদিও এ নিয়ে এমন কোনো ফেডারেল আইন নেই, কিছু কিছু রাজ্যে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের গঠন নিয়ে নানা নিয়ম-কানুন বাস্তবায়ন করেছে। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো কোম্পানির নেতৃত্বে এবং পর্ষদে নারীর উপস্থিতি বৃদ্ধি করা। যেমন ‘৩০% ক্লাব’ হলো বিশ্বব্যাপী একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যাদের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈচিত্র্যের প্রসার। এ লক্ষ্যে সংগঠনটি নেতৃত্বের পদে আগ্রহী নারীদের জন্য পরামর্শ, নেটওয়ার্কিং সুযোগ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করপোরেট বোর্ডে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধিতে এখন পর্যন্ত সফল হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের করপোরেট পরিচালনা পর্ষদে নারীর অন্তর্ভুক্তি একটি প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টরে নারীর ক্ষমতায়ন এবং সমতার প্রচার এবং প্রসারে অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নেহাতই কম। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ নারী সদস্যের অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট আইন বা প্রবিধান নেই, তবে পর্ষদে নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত এবং উন্নীত করার লক্ষ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, নেটওয়ার্কিং এবং নেতৃত্বের পদে আগ্রহী মহিলাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এ লক্ষ্য অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ উইমেন ইন লিডারশিপ (বিডব্লিউআইএল) প্রোগ্রাম, যা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এবং বাংলাদেশ উইমেনস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিডব্লিউসিসিআই) যৌথ উদ্যোগে গঠিত। 

গত কয়েক দশকে করপোরেট সেক্টরের নেতৃত্বে এবং পরিচালনা পর্ষদে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও এখনো এমন সব চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেগুলোর অবশ্যই জুতসই সমাধান করতে হবে। নেতৃত্বের পদে যোগ্য নারীর অভাব একটি বড় সমস্যা যার সমাধান জরুরি। তাই ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের ভূমিকায় নারীর অংশগ্রহণের প্রতি নজর দিতে হবে এবং সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সব ধরনের সহায়তা প্রদান করতে হবে। বাংলাদেশে ২০১৮ সালের করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড অনুযায়ী তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে ন্যূনতম ২০ শতাংশ স্বতন্ত্র সদস্য নিয়োগের প্রবিধান রয়েছে। সেই সঙ্গে ন্যূনতম নারী সদস্যের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের উদ্যোগে নানা কর্মসূচি নেতৃত্বের পদে নারীদের সফল হওয়ার জন্য যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। সেসব উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে কোম্পানির নেতৃত্ব এবং পরিচালনা পর্ষদে নারীর উপস্থিতি বাড়ানো গেলে কোম্পানি তথা অর্থনীতির অগ্রগতির দিকে দেশ এগিয়ে যাবে অনেকদূর। 


ড. সামসুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক

শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইউকে 

ড. মোহাম্মদ দুলাল মিয়া: সহযোগী অধ্যাপক

নিজওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ওমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন