পর্যালোচনা

অনানুষ্ঠানিক খাতের জীবন-জীবিকার সমস্যা ও তার সমাধান

ড. এটিএম নুরুল আমিন

অনানুষ্ঠানিক খাতের বিশালতার কারণ বিশ্লেষণে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব যতটা দেখা যায় তটটা দেখা যায় না আয় ও সম্পদের অসমতার বিষয়টা। কিন্তু অসমতা যে একটি মৌলিক কারণ তা ধারণা ও ব্যাখ্যা করা যায় এ বিষয়ে একটি ছোট এনেকডোটের মাধ্যমে। আমি একবার এক তরুণ শিক্ষিত ছেলের চাকরির জন্য আমার এক ডাক্তার মামার কাছে নিয়ে যাই। তিনি আমাকে ও ওই ছেলেটিকে বলে উঠলেন, ঢাকা শহরে টাকা উড়ে যে যেখান দিয়ে পারে ধরে! এই যে অসংখ্য মানুষ ঢাকার মতো মহানগরে এসে কিছু করে জীবিকা নির্বাহ করছে তারা দেখছে, এখানে নাগরিকদের হাতে টাকা আছে। রিকশা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে ২০-৩০-৫০ টাকা দিতে একজন নাগরিকের পক্ষে, সে ছাত্র-ছাত্রী হোক বা অফিস কর্মচারী হোক, খুব অসুবিধা হয় না। কিন্তু একজন রিকশাচালকের জন্য এ ধরনের ট্রিপ দিয়ে রোজগার বড় অর্জন। এই যে ঘরে ঘরে গৃহকর্মী ও অনেক নাগরিকের গাড়িচালক—এটাও বিভিন্ন আয়ের নাগরিকদের নগর বলেই তো! এরপর আছে সম্পদশালী ও উপার্জনকারীদের বিভিন্ন সেবা ও কাজের জন্য ব্যয়ের সক্ষমতা। এ ধরনের হাজারো উদাহরণ পাওয়া যাবে যা ইঙ্গিত করে প্রাচুর্য আছে বলেই তা থেকে কিছু পাওয়ার জন্য সেবা প্রদানে উদগ্রীব মানুষের ভিড়। এসব বিবেচনায় একজন গবেষকের (হেনরি রেম্পেল) অভিমত, অনানুষ্ঠানিক খাতের মাধ্যমে শহরে-নগরে পুঞ্জীভূত আয় ও সম্পদের বিতরণ হয়। বলা বাহুল্য, এ অভিমত অনানুষ্ঠানিক খাত নিয়ে আশাবাদের কথা। কিন্তু এ আশাবাদের ভিত্তি তো অসমতা। ওই যে প্রিকেরিয়াটদের উদ্ভব তার পেছনেও আয় ও সম্পদের পুঞ্জীভবন। লাতিন আমেরিকায় ‘মার্জিনালস’ বা বেআইনি ‘অকুপায়ারস’-বাস্তবতাও শহরে-নগরে পুঞ্জীভূত আয় ও সম্পদের কারণেই। 

‘হকার নিয়ে ইঁদুর-বেড়াল খেলা’ জাতীয় পত্রিকার শিরোনামে খবরের সারাংশ হলো, পুলিশ বা ভ্রাম্যমাণ আদালত আসছে শুনেই রাস্তায় বসা দোকানপাট বিক্রেতাদের পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়া আর এ উপদ্রব শেষ হলেই আবার ফিরে আসা যা চলে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। এটা ঘটে চলেছে এলাকার মাস্তান ও পুলিশকে নিয়মিত একটা চাঁদা দেয়ার পরও। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক আহমদ শরীফের একটি উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘‌জীবন-জীবিকার নিরুপদ্রব নিরাপত্তাই সব ভালোর উৎস ও ভিত্তি’। রাষ্ট্রের বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের চলতি ধারায় বেকারত্ব নিরোধ হয় না বলেই জীবন-জীবিকার জন্য শ্রমশক্তির বিশাল অংশ গ্রাম ও নগরে, বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো মহানগরে, নিজেদের উদ্ভাবনী দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আয়ের একটা উপায় বের করে। কিন্তু এ ধরনের কাজের আয় দিয়ে যে বাঁচা তা যে আয়ুষ্কালই কমিয়ে দেয় তাই নয়, তা করে তোলে নিজ সন্তানদের জন্য অন্ধকার ভবিষ্যৎ। এখানে উল্লেখ্য, গ্রামের দরিদ্ররা ছেলে-মেয়েদের যতটুকু পড়ালেখা করাতে পারেন শহর-নগরের দরিদ্র পিতা-মাতা ততটা পারেন না। 

এসব কারণেই অনানুষ্ঠানিক খাত যেনতেনভাবে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য ঢাকার পথ হয়ে আছে মাত্র। তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা আমাদের করে যেতে হবে। এ বিবেচনায় বেকারত্ব ও অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মানুষগুলোর জন্য যা যা করা সম্ভব তা করা মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির বিবেচনায় জরুরি। 

প্রথমেই বেকারত্বের বিষয়। শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের, মধ্যে বেকারত্ব দেখে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজের জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারছে না। এ ধরনের অভিমত শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনকে খাটো করে। ব্যবসা-বাণিজ্যে মুনাফা অর্জনে সহায়তা বা পারদর্শী হওয়াই শিক্ষার মৌলিক বা একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় মানের শিক্ষার মূল বা প্রাথমিক উদ্দেশ্য ও কাজ হলো মানবিক গুণে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে-প্রকৌশলে, সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-পরিবেশ-বিশ্বায়ন সম্পর্কিত জ্ঞানভাণ্ডারে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেয়া। এ পরিচিতি সাধারণ জ্ঞানের মতো যা আজকের দুনিয়ার সব নাগরিকের জন্য প্রয়োজন। শিক্ষার পরবর্তী ধাপ হলো পেশাগত শিক্ষা যার জন্য রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা শিক্ষা ও এ-সম্পর্কিত পেশাদারি অভিজ্ঞতা অর্জনের ব্যবস্থা। শিক্ষকতার জন্য রয়েছে টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। পুঁজিবাদী মুক্ত অর্থনীতিতে প্রতিনিয়ত যে ভাঙা-গড়া বা পরিবর্তন হয় তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে-বিদেশে উৎপাদন-ক্রয়-বিক্রয়-আমদানি-রফতানি এবং এসব করার জন্য যে নতুন নতুন কারিগরি কৌশল ব্যবহার করতে হয় তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে সামঞ্জস্য বা বিন্যস্ত করা নিত্যনৈমিত্তিক কাজ যা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজও নয়, সম্ভবও নয়, বোধ হয় কাম্যও নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা শেষে নিয়োজিত কর্মচারী বা জনশক্তিকে নিজ নিজ কর্মস্থলে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে নতুনভাবে প্রস্তুত করার জন্য কর্মকালীন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণই সর্বোৎকৃষ্ট, যথোপযুক্ত ও কার্যকর পন্থা। এ ব্যবস্থা যে প্রচলিত নেই তাও নয়। প্রয়োজন এ কাজে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও প্রশিক্ষণের প্রোগ্রাম ও প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি। 

শিক্ষিত ও মোটামুটি সচ্ছল বেকারদের থেকে দরিদ্রদের বেকারত্ব গুণগতভাবে ও পরিমাণগতভাবে ভিন্ন। এরই মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, একজন দরিদ্রের পক্ষে তিনদিনের বেশি বেকার থাকা সম্ভব নয়। তাই আয়ের জন্য তাদের কোনো না কোনো কাজ বের বা সৃষ্টি করতে হয়। আরো বড় বাস্তবতা, এ অবস্থাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি বিশালসংখ্যক মানুষের জন্য এবং তা হয়ে উঠেছে দীর্ঘস্থায়ী। এ পরিপ্রেক্ষিতেই হয়তো আইএলও অনানুষ্ঠানিক খাতকে আনুষ্ঠানিকীকরণের (ফর্মালাইজেশন) পরামর্শ দেয়। কিন্তু বাস্তবতা যেখানে আনুষ্ঠানিক খাতের উৎপাদন বা ব্যবসা-বাণিজ্যকে অনানুষ্ঠানিকীকরণ (আউটওয়ার্ক বা সাবকন্ট্রাকটিংয়ের মতো পদ্ধতির মাধ্যমে) চলছে সেখানে অনানুষ্ঠানিক খাতকে আনুষ্ঠানিকীকরণ খুব একটা বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নয়। কাজেই প্রথমে যা করা দরকার তা হলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য আনুষ্ঠানিক খাতের যথাযথ ভূমিকা নিশ্চিত করা। এর জন্য যা যা করা দরকার তার কিছু উদাহরণ: এক. আনুষ্ঠানিক খাতের (সরকারি ও বেসরকারি উভয়ের ক্ষেত্রে) নিয়োগ বা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান ও তা বাস্তবায়নের জন্য যা যা করা দরকার তা করা; দুই. আনুষ্ঠানিক খাতের নিয়োগে ও নিয়োজিত শ্রমশক্তির বেনিফিট প্যাকেজ শ্রম আইনের বেনিফিট নিয়মাধীনে হওয়া নিশ্চিত করা; তিন. আউটওয়ার্ক বা সাবকন্ট্রাকটিং পদ্ধতি অবলম্বন করে আনুষ্ঠানিক খাতের নিয়োগ, উৎপাদন ব্যবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতি অনুশীলন করাকে বন্ধ বা অনুৎসাহিত করা; তিন. আনুষ্ঠানিক খাতের নিয়োগে কর্মচারী ও শ্রমিক বিভাজনের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাত প্রসারের প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সাবকন্ট্রাকটিং পদ্ধতি আনুষ্ঠানিক খাতের কাজের চাহিদা ও দক্ষতা বৃদ্ধির ও উন্নতির সহায়কও হতে পারে। কিন্তু তা তখনই হবে যখন এ পদ্ধতির একমাত্র উদ্দেশ্য খরচ কমিয়ে মুনাফা বৃদ্ধি নয়। এখানেই আসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামাজিক উদ্যোগ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, পুঁজিবাদকে মানবিক করার জন্য যা এক সময় জন মেনার্ড কেইনস করেছিলেন চাকরি বৃদ্ধির জন্য। 

যেহেতু এরই মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভর করে শ্রমশক্তির একটি বিশাল অংশ জীবিকা নির্বাহ করছে, অতএব আনুষ্ঠানিক খাতকেন্দ্রিক কাজে যুক্ত হতে হবে অনানুষ্ঠানিক খাতকেন্দ্রিক নীতি গ্রহণ ও করণীয় কাজগুলো করা। এ কাজগুলো হলো—এক. অনানুষ্ঠানিক খাতের সব কাজকর্মে নিয়োজিত শ্রমশক্তির জন্য আইডি কার্ড প্রদান; দুই. অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজকর্মে নিয়োজিত শ্রমশক্তির সামাজিক নিরাপত্তার জন্য, নিজেদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে, দুর্ঘটনা-স্বাস্থ্য-সন্তানদের শিক্ষার জন্য তহবিল সৃষ্টি যা করার জন্য ওয়ার্ড লেভেলে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। ওয়ার্ড কমিশনার নিজ নিজ এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিকদের ও অন্যান্য বিত্তশালীদের আর্থিক সহায়তা সংগ্রহে নেতৃত্ব দিতে পারেন। তার কাজে সহায়তার জন্য তিনি এলাকার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সংযুক্ত করতে পারেন। এখানে উল্লেখ্য, থাইল্যান্ডে আনুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিকদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতকে সহায়তা প্রদানে আগ্রহ দেখা যায়। এর কারণ হতে পারে—তারা জানেন যে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রম-সেবা ও ব্যবসা-বাণিজ্য থাকার ফলে তাদের কাজকর্মে, ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তারে আনে নানা ধরনের সুবিধা যা ব্যয় হ্রাস এবং মুনাফা বাড়াতে সহায়ক হয়। 

প্রস্তাবিত পদক্ষেপের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাতকে আনুষ্ঠানিকীকরণের আইএলওর পরামর্শ কার্যকর করার পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হতে পারে এবং এর ফলে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক খাতের দ্বৈধতা বা ব্যবধান কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। সবচেয়ে জরুরি কাজ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির বাসস্থান ও নাগরিকসেবা। এ বিষয়ে করণীয় কাজগুলো হলো—এক. অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নাগরিকদের বর্তমান বাসস্থানগুলোয় খরচমূল্যে পানি, টয়লেট, ড্রেনেজ এবং পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য সংগ্রহসেবা নিশ্চিতকরণ। উল্লেখ্য, বিনা বা স্বল্প মূল্যে দরিদ্রদের সেবা প্রদান করতে গেলে তারা কার্যত সেবা পায় না বা বেআইনি পন্থায় বেশি দামে কিনতে বাধ্য হয়। যা করা দরকার তা হলো আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা। আয় বাড়লে এ মৌলিক প্রয়োজনগুলোর জন্য ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। দুই. বস্তির বাসস্থানের পরিবর্তে কর্মস্থলের সন্নিকটে ভাড়া-বাসা নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ। তিন. কর্মস্থলের আশপাশে মহিলা ও পুরুষদের জন্য পানি ও টয়লেট সুবিধার ব্যবস্থা। ৮-১০ (কারো কারো জন্য ১২ ঘণ্টা) ঘণ্টা বাসস্থানের বাইরে কাজ করা এ মানুষগুলোর পানি ও টয়লেটের প্রয়োজন কীভাবে মেটানো হয় তা নগর কর্তৃপক্ষ দেখেও জানেন না বলেই মনে হয়। চার. এ খাতের কর্মজীরীদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে দারিদ্র্য ও অনানুষ্ঠানিক খাতের পেশা হস্তান্তর (রিকশাচালকের ছেলে রিকশাচালক, মুচির ছেলে মুচি, গৃহকর্মীর মেয়ে গৃহকর্মী, বর্জ্য সংগ্রাহকের ছেলে বর্জ্য সংগ্রাহক) প্রক্রিয়া বন্ধ করা জরুরি। পাঁচ, এ খাতের যেকোনো কাজে ১৫ বছরের কম বয়সী ছেলেদের শিক্ষা ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুশ্রম বন্ধ করা জরুরি। 

বিস্ময়ের ব্যাপার, বেসরকারি এতিমখানা বা মাদ্রাসাগুলো পারে ছোট ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিতে কিন্তু পারে না সরকার বা নগর কর্তৃপক্ষ। এ কাজগুলো কার্যকর করা সম্ভব স্থানীয়ভাবে। অতএব ওয়ার্ড কমিশনারদের এ ধরনের দায়িত্ব দিতে ও নিতে হবে। খুঁটিয়ে দেখলে উপলব্ধি করার কথা যে অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবস্থাপনা ওয়ার্ড পর্যায়ে হওয়া প্রয়োজন এবং এটা করতে হলে ওয়ার্ডকে নগর পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নে সরাসরি যুক্ত হতে ও করতে হবে। আর একটি কাজ, সব কাজের অনেকটা পূর্বশর্ত যা হলো অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা জীবিকা নির্বাহী শ্রমজীবীদের নিজেদের সংগঠিত করা। বিভিন্ন কাজ বা পেশা অনুসারে এ সংগঠন হতে পারে। প্রথম কাজ, এলাকাভিত্তিক তালিকা তৈরি করা। এ কাজে আইএলওর দায়িত্ব রয়েছে। এলাকাভিত্তিক তালিকা করার জন্য স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের সহায়তা দিতে পারে আইএলও। যুক্ত করতে হবে নগর কর্তৃপক্ষ, ওয়ার্ড কমিশনার ও সংগঠিত ও সংগঠন করার ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের অভিজ্ঞতা।

অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মহিলা শ্রমজীবীদের প্রধান পেশাগুলোর কিছু তথ্য এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে। পেশার ওই নামগুলো থেকেই ধারণা করা যায়, এ খাতেও মহিলারা নিম্নস্তরের কাজগুলোয় কর্মরত। এ বাস্তবতা যে কত ব্যাপক তা এ লেখকের ২০১৩ সালের একটি কাজে পরিলক্ষিত হয়। শ্রমশক্তির নয়টি সূচক বা মানদণ্ড দিয়ে পুরুষ-মহিলা তুলনায় প্রতিটিতে মহিলাদের অবস্থান পুরুষদের থেকে প্রতিকূলে। এ সূচকগুলো হলো বেকার, আংশিক বেকারত্ব, শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ, নগর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ, দারিদ্র্য, অবৈতনিক পারিবারিক শ্রম, আনুষ্ঠানিক সেক্টরের চাকরি, সেবাশ্রম। মহিলার কাজ এবং তা যদি হয় শিশুসন্তান নিয়ে মায়ের কাজ অনানুষ্ঠানিক খাতে—ফুটপাতে বা নির্মাণ সাইটে—তা শিশুর ও মায়ের স্বাস্থ্য বা সুস্থতার জন্য কী হতে পারে তা দেখেও বা জেনেও আমরা বিচলিত হই না। এখানে এসে আমার আর কোনো আইডিয়া নেই কী করা দরকার। সেদিনই মাত্র ফুটপাতে দেখলাম, এক শিশু একটি প্লাস্টিক ব্যাগের ভেতরে হাত দিয়ে খাওয়া খুঁজছে। একটু পরে ধারেই দেখলাম ওই শিশুর মায়ের কোলে আর একটি শিশু ও পাশেই একজন পুরুষ মানুষ—নিশ্চয়ই পিতা। শীতের সন্ধ্যায় দেখা ফুটপাতের দৃশ্য। রাতে থাকার স্থান কোথায় তা জানতে চাইনি। এ ধরনের বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে মহিলাদের বিষয় এলে কোনো সমাধানের চিন্তা উবে যায়! তবু ধারণা করি, একটু আগেই শিশুশ্রম নিয়ে যে দিকনির্দেশনা করা হয়েছে সে রকম কিছু করা প্রয়োজন। বড় প্রশ্ন কে করবে? এ লেখায় কিছু ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। আমার বড় আশা ওয়ার্ড কমিশনারদের নিয়ে। মেয়রদেরও জানাই আজকের ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো প্রথমে ছিলেন একটি ছোট শহরের মেয়র। তার অন্যান্য কাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় হয়ে দৃশ্যমান হলো অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজ। অনেকেই সাধুবাদ দিলেন। কিন্তু অনেকে মনে করলেন ছোট শহর! করুক না জাকার্তায়। হলেন জাকার্তার মেয়র/গভর্নর। জাকার্তায়ও সফল। নগর পিতার সফলতার পটভূমিতে এলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ইন্দোনেশীয়রা তাদের ভোটের অধিকার কাজে লাগিয়ে পুরস্কৃত করলেন জোকো উইডোডোকে। 

আমাদের দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সরকারি সহায়তা আনুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই যে লাখ লাখ নয়, কয়েক কোটি মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে ক্ষুদ্র ব্যবসা, মেরামত, নির্মাণ, পরিবহন ও বিভিন্ন ধরনের জিনিস তৈরিতে (মেটাল প্রডাক্ট, আসবাব) উদ্যোক্তা, শ্রমিক ও শিক্ষানবিশ (অ্যাপ্রেন্টিস) হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে যা সম্পূর্ণভাবে সরকারি সহায়তার বাইরে। এ নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। সহায়তা প্রয়োজন পুঁজি বিকাশে, দক্ষতা বৃদ্ধিতে, মার্কেটিংয়ে ও বাসস্থানের জন্য। এর কোনোটিই বিনামূল্যে দেয়ার বিষয় নয়, যা দরকার তা হলো একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা। এটা করা হলে অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে। 

ড. এটিএম নুরুল আমিন: ইমেরিটাস প্রফেসর

এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, ব্যাংকক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন