সীতাকুণ্ড-মিরসরাই শিল্প জোন

অপরিকল্পিত শিল্পায়নেই কি ঝুঁকি বাড়ছে?

সুজিত সাহা ও দেবব্রত রায়, চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত শনিবার বিস্ফোরণ ঘটে একটি অক্সিজেন প্লান্টে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই পর্যন্ত পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের সন্দ্বীপ চ্যানেল, পূর্বে সীতাকুণ্ডের পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ ভূমি। এক সময় পূর্ব অংশ ছিল সরকারি খাতের ভারী শিল্প-কারখানার অন্যতম অঞ্চল। পাটকল, সুতা কারখানা, গাড়ি সংযোজন মেরামত কারখানা, টেক্সটাইল মিল, কেমিক্যাল কারখানা থেকে শুরু করে শতাধিক শিল্প-কারখানায় গড়ে উঠেছিল জনপদ। নৌপথের সঙ্গে মহাসড়ক রেলপথের সরাসরি সুবিধা থাকায় বন্দরনগরী চট্টগ্রাম রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করেছে। ঠিক কারণে পাকিস্তান আমল থেকেই সীতাকুণ্ড-মিরসরাই জোনে অধিকসংখ্যক শিল্প-কারখানা স্থাপন শুরু হয়।

সরকারি শিল্প-কারখানার জন্য গড়ে তোলা অঞ্চলটি এখন পুরোপুরি পাল্টে গেছে। মহাসড়কের এক পাশে জাহাজ ভাঙা শিল্প অপর পাশে বেসরকারি খাতের ভারী শিল্প-কারখানার নতুন শিল্প জোনে পরিণত হয়েছে। তবে সরকারি কোনো সংস্থার নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি না থাকায় প্রতিনিয়ত এখানে ঘটছে দুর্ঘটনা। বিস্ফোরণ ঝুঁকির কেমিক্যাল উৎপাদন পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই কারখানা স্থাপনের কারণে অঞ্চলটি শিল্প দুর্ঘটনার চরম ঝুঁকিপ্রবণ জোনে পরিণত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন জটিলতায় একে একে বন্ধ হতে থাকে সীতাকুণ্ড এলাকার সরকারি শিল্প-কারখানাগুলো। কিছু কারখানা এখনো চালু থাকলেও তা চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মূলত এরশাদ সরকারের আমলেই এখানকার সরকারি অনেক কারখানাকে বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ায় নেয়া শুরু হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালে চালু থাকা বেশকিছু পাটকল গোল্ডেন হ্যান্ডশেক শর্তে বন্ধ হয়। পাশাপাশি সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকা অন্যান্য টেক্সটাইল মিল, সুতার মিল এবং কেমিক্যাল কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকৌশল করপোরেশনের আওতায় থাকা গাড়ি সংযোজন কারখানা প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ অনেকটা নামকাওয়াস্তে চলছে। সরকারি খাতের এসব উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা বন্ধের বিপরীতে পাশাপাশি বেড়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। মূলত নব্বইয়ের দশকের শুরুতে অঞ্চলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ভারী শিল্প-কারখানা স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিম অংশের সমুদ্রতীরে গড়ে ওঠা জাহাজ ভাঙা শিল্প নব্বইয়ের দশকে আরো বিস্তৃতি পায়। শিল্পকে কেন্দ্র করে অঞ্চলে ভাঙারি ব্যবসাও প্রসার লাভ করে। জাহাজের পোড়া তেল, টায়ার পোড়ানো প্রক্রিয়াজাত কারখানা, পুরনো মোবিলের ব্যবসা, ছোট-মাঝারি রি-রোলিং মিল, খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী কারখানা জোনকে অলিখিতভাবে শ্রমঘন শিল্প এলাকায় পরিণত করেছে। দুই দশক ধরে সীতাকুণ্ড মিরসরাই উপজেলায় কারখানা স্থাপনে প্রতিযোগিতায় নামে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত নির্মাণকারী চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প গ্রুপগুলোও। সরকারি একাধিক সংস্থার নিয়ম অনুমোদন নিয়ে কারখানা স্থাপন করলেও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ভিন্ন একাধিক খাতের কারখানা স্থাপনের যে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ দরকার, তার কিছুই এখানে নেই। যে কারণে গেল কয়েক বছর ধরে অঞ্চলটিতে দুর্ঘটনার পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। নয় মাস আগে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ কেমিক্যাল বিস্ফোরণে ৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। আহত হন শতাধিক শ্রমিক। সর্বশেষ শনিবার একই উপজেলার কদমরসুল এলাকার সীমা অক্সিজেন কোম্পানি লিমিটেডের বিস্ফোরণে সাতজন প্রাণ হারিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরো ২৫ জন। বিস্ফোরণ এতটাই ভয়ংকর ছিল যে উড়ে যাওয়া লোহার আঘাতে দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে থাকা এক ব্যবসায়ী মৃত্যুবরণ করেন। বিস্ফোরণে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিল্প জোনে এক সময় আরআর টেক্সটাইল মিলস, ভালিকা উলেন মিলস, জলিল টেক্সটাইল মিলস, ঈগল স্টার টেক্সটাইল মিলস, ক্যারোলিন সিল্ক মিলস, ন্যাশনাল কটন মিলস, গুল আহমেদ জুট মিলস, হাফিজ জুট মিলস, এমএম জুট মিলস, আরআর জুট মিলস, বাগদাদ-ঢাকা কার্পেট মিলস, গালফ্রা হাবিব মিলস, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ, চিটাগং কেমিক্যাল কমপ্লেক্সসহ আরো বেশকিছু সরকারি ভারী শিল্প-কারখানা ছিল। এসব কারখানার অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অনেকেই সেখানে কারখানা কিনে ভারী শিল্প গড়ে তুলেছেন।

সীতাকুণ্ড-মিরসরাই শিল্প জোনে এরই মধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত নির্মাণসামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, জিপিএইচ গ্রুপ, কেএসআরএম গ্রুপ, সীমা গ্রুপ, কেডিএস গ্রুপ, পিএইচপি ফ্যামিলি, মোস্তফা গ্রুপ, কনফিডেন্স সিমেন্ট গ্রুপের প্রত্যেকেই একাধিক ভারী শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছে। এছাড়া অন্তত ৫০টিরও অধিক সেমি অটোমেটিক কিংবা সনাতনী রি-রোলিং মিল স্থাপনের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে কারখানা। তিনটি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) ছাড়াও লিনডে বাংলাদেশ লিমিটেড, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড (সাবেক গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লাইন বাংলাদেশ লিমিটেড) এবং বেশকিছু বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কারখানা রয়েছে অঞ্চলে। রয়েছে সিপি বাংলাদেশ লিমিটেড, নাহার এগ্রোসহ আরো অন্তত অর্ধশতাধিক কারখানা। এরই মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বাকি জমির অধিকাংশই কোনো না কোনো শিল্প গ্রুপ কিংবা ব্যবসায়ী কিনে কারখানা স্থাপনের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। ফলে এলাকা ভারী শিল্পের জন্য যেভাবে প্রস্তুত হচ্ছে, বিপরীতে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা তদারকির কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। যে কারণে বার বার ঘটছে বড় দুর্ঘটনা।

শিল্প জোনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠার বিষয়টিতে একমত পোষণ করে দ্য চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (সিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, এক সময় সীতাকুণ্ড জোন সরকারি খাতের শিল্প-কারখানার অন্যতম অঞ্চল ছিল। ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতের অধীনে শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সরকারের তদারকিতে নেই। ইপিজেড, বিসিকের মতো শিল্পনগরী যেভাবে তদারকি করা হয়, সীতাকুণ্ড-মিরসরাই শিল্প জোনের শিল্প খাতের কোনো কমপ্লায়েন্স প্রতিপালন হয় না। সরকারিভাবে এখুনি বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে বলে মনে করেন তিনি।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) অধীনে চট্টগ্রামে চারটি শিল্পনগরী, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) অধীনে দুটি ইপিজেড, একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে মিরসরাইয়ে একটি বিসিক শিল্পনগরী ছাড়াও একই উপজেলায় নির্মাণাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদন চালু হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরের অভ্যন্তরে নাসিরাবাদ ভারী শিল্প এলাকা, মোহরা ভারী শিল্প এলাকা কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকা রয়েছে। এসব শিল্প এলাকা সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থার অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সর্ববৃহৎ সীতাকুণ্ড শিল্প জোনে দেখা যায় উল্টো চিত্র। দেখার কেউ নেই, তাই নিয়ন্ত্রণও নেই। সেজন্য এলাকায় যেকোনোভাবে ছোট বা মাঝারি শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা সহজ কাজ। অপরদিকে পাহাড়ের সন্নিকটে এসব শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে প্রাকৃতিক ছড়া-খাল যেমন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নজরদারির দায়িত্বে কার্যত কেউ না থাকায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকির আশঙ্কায় দিনযাপন করছেন স্থানীয় শ্রমিক খাতসংশ্লিষ্টরা।

কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের উপ-মহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, সীতাকুণ্ড এলাকার শিল্প-কারখানাগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করা হয়। সরকারি লাইসেন্স নবায়নের বিষয়ে তত্পরতা চালানোও হয়েছে। এর পরও কিছু প্রতিষ্ঠান অনিয়মের মাধ্যমে কারখানা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। আগামীতে এলাকায় আমাদের পরিদর্শন কার্যক্রম আরো জোরদার করা হবে।

জানা গেছে, সমুদ্র-তীরবর্তী এলাকায় এক সময় ১৮০টির বেশি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড ছিল। বর্তমানে দেশী-বিদেশী অর্থনীতিক সংকটে শতাধিক শিপব্রেকিং ইয়ার্ড বন্ধ রয়েছে। এসব ইয়ার্ড শিল্প জোনের কর্মরত শ্রমিকরা চট্টগ্রাম শহরের পরিবর্তে ওই এলাকায় বসবাস করেন। স্থানীয়দের পাশাপাশি অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যাও এখানে লক্ষাধিক। অপরিকল্পিত শিল্প-কারখানায় সয়লাব এবং ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশের অঞ্চলটি তদারকির অভাবে বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

জানতে চাইলে বিস্ফোরক পরিদপ্তর চট্টগ্রামের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক এসএম সাখাওয়াত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, অক্সিজেন উৎপাদনকারী শিল্প-কারখানাগুলো এমনিতে ঝুঁকিপূর্ণ। সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু না থাকলে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সীমা অক্সিজেন লিমিটেডও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অনুমোদন নিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। ঠিক কোন কারণে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেটি তদন্তের মাধ্যমে জানা যাবে। এক্ষেত্রে ভারী শিল্প জোন হিসেবে সীতাকুণ্ড-মিরসরাই অঞ্চলটির শিল্প দুর্ঘটনার পরিমাণ কমাতে তদারকি বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন