ভাষার মাস

বিশ্বায়নের অপব্যাখ্যা ও বিদেশী ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা

ড. এবিএম রেজাউল করিম ফকির

বাংলাদেশের ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রথম শ্রেণী থেকে ত্রয়োদশ শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সাক্ষরতা শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রথম শ্রেণী থেকে উচ্চতম শ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে ঐচ্ছিক শিক্ষা কার্যক্রম—এ দ্বিবিধ শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে গঠিত। এ শিক্ষা ব্যবস্থা সর্বাত্মক এবং দেশব্যাপী বিস্তৃত। বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে ইংরেজি ভাষা হলো দেশীয় বিদেশী ভাষা। এ শিক্ষা ব্যবস্থা যে আদর্শের ছুতো ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার অন্যতম হলো ‘বিশ্বায়ন’। অথচ বিশ্বায়নকে যদি ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে নিয়ে কোনো ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে সেখানে শুধু ইংরেজিসহ অন্যান্য বিদেশী ভাষাও শিক্ষা ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেশে এখন একটি ইংরেজিনির্ভর একক বিদেশী ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলে এর কুফল দেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। 

এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০-৩০ বছরের মধ্যে দেশের প্রায় ৫০ লাখ লোকের প্রথম ভাষা হবে ইংরেজি, যাদের কাছে বাংলা হবে দ্বিতীয় ভাষা। তাদের অধিকাংশের ইংরেজি জ্ঞান হয়তো বেসরকারি বাণিজ্যিক দপ্তরের ৮-১০ রকমের দলিলপত্র বোঝার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু এ শ্রেণীটি আগামী বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। যাদের প্রথম ভাষা বাংলা, তারা এ দেশে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। বাঙালি জাতির জন্য বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। কেননা ইংরেজি ভাষাভাষীরা দেশের জাতীয় মূলনীতিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এ দেশেরই অর্থে দেশে তাদের মতো করে একটি সংস্কৃতি ও জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে নেবে। বলা যায়, ২০-৩০ বছর পর এ জনগোষ্ঠী দেশে একটি শাখা জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। স্মর্তব্য, এ পরিমাণ জনগোষ্ঠী অনেক দেশেই নেই।

স্বদেশে এই যে (প্রথম ভাষা ইংরেজিসম্পন্ন) শাখা জাতি গঠিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার অন্তরালে রয়েছে ‘‌বিশ্বায়ন’ ধারণাটির অপব্যাখ্যা। কয়েক দশক ধরে শিক্ষাবিদরা বিশ্বায়ন ধারণাটিকে অপব্যাখ্যা দিয়ে দেশে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থা ও দাপ্তরিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ওকালতি করে যাচ্ছে। কিন্তু আদতে বিশ্বায়ন কোনোক্রমেই সর্বাত্মক ও একক ইংরেজি ভাষানীতিকে সমর্থন করে না। বিষয়টি বোঝানোর জন্য নিচে এ সম্পর্কে একটি পর্যালোচনা তুলে ধরা হলো। বিশ্বায়ন হলো বিশ্বব্যাপী একটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়া যার উপযোগিতায় অংশগ্রহণকৃত বিশ্বের দেশ বা অঞ্চলগুলো তাদের নিজ নিজ জ্ঞান, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, দ্রব্য, পণ্য ও পুঁজি ইত্যাদি বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পর লাভবান হতে পারে এবং সার্বিকভাবে বিশ্বজগৎ লাভবান হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বায়ন কেবলই বুলিসর্বস্ব আদর্শে পরিণত হয়েছে। এতে অংশগ্রহণকারী অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বা অঞ্চলগুলো লাভের পরিবর্তে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো একচেটিয়াভাবে এ প্রক্রিয়া থেকে লাভবান হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো অবিরত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। যে কারণে বিশ্বায়ন আদর্শটি বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এ জাতীয় আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে অবির্ভূত হয়েছে। সেজন্য বিশ্বায়ন আদর্শের ভিত্তিতে একটি বিদেশী ভাষা (ইংরেজি ভাষাসমেত) ভাষানীতি এমনভাবে প্রণয়ন করা প্রয়োজন যে তা যেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এ জাতীয় চার মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। 

বস্তুত ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে ‘‌বিশ্বায়ন’ কোনো ক্রমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদবিরোধী কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না। কিন্তু দেশে বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থা ও ইংরেজি মাধ্যমের দাপ্তরিক ব্যবস্থার যে তোড়জোড় চলছে, তা বাঙালি জাতীয়তাবাদবিরোধী চিন্তাধারাপ্রসূত কর্মকাণ্ড বিশেষ। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্বায়নের নিরিখে দেশে কোনো বিদেশী ভাষা মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থা ও দাপ্তরিক ব্যবস্থা চালু করা হলে সেখানে প্রথমে প্রাধান্য পাবে বাংলা ভাষা, আর সেখানে এককভাবে বিদেশী ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব থাকবে না। বরং সব বিদেশী ভাষা সমান গুরুত্ব পাবে। বিদেশী ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থাও 

হবে সেই আদলে। কিন্তু এ দেশের কোনো ভাষানীতি নেই, সেজন্য বিদেশী ভাষা শিক্ষানীতিও নেই। সেই সুযোগে ইংরেজিবিদরা দেশ ও জাতিকে ভুলভাল বুঝিয়ে দেশে একটি শাখা জাতি সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু করেছে।

ওই উদ্যোগ রুখতে ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে বিশ্বায়নকে যথাযথ ব্যাখ্যা সাপেক্ষে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে দেখা গেছে যে বিশ্বায়ন ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে বিদেশী ভাষা ও বিদেশবিদ্যার চর্চা সহায়ক ভাষানীতিকে সমর্থন করে। এ হিসাবে বিশ্বায়ন আদর্শ বিদেশবিদ্যা বিষয়ক অধ্যয়ন এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিদেশী ভাষা শিক্ষানীতিকে সমর্থন করে। এটি এমন একটি বিদেশ ভাষা ও বিদেশবিদ্যা শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমর্থন করে, যেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব দেশ বা অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে বা যোগাযোগের প্রয়োজন রয়েছে সেসব দেশের আঞ্চলিক অধ্যয়ন (অর্থাৎ ইংরেজি আঞ্চলিক অধ্যয়ন) ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিদেশী ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমকে সমর্থন করে। এ আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে সমাজ-ভাষা বৈজ্ঞানিক কোনো আদর্শ বর্তমান বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমর্থন করে না। বরং এটি একটি ঐচ্ছিক বিদেশী ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমর্থন করে। সে অর্থে এটি বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে একক বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমর্থন করে না। 

উল্লেখিত উপায়ে বিশ্বায়নের আলোকে প্রণীত একটি ভাষানীতির নিরিখে একটি বিদেশী ভাষা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে দেশের ভাষা পরিস্থিতিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করা সম্ভব হবে। কাজেই বিশ্বায়নের অনাকাঙ্ক্ষিত কুফল থেকে রক্ষা পেতে হলে বিশ্বায়নের মূল বাণীকে আমলে নিয়ে তার আলোকে বিদেশী ভাষানীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থায় বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সব বিদেশী ভাষার পঠন-পাঠন ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার হবে। একই সঙ্গে দেশে বাংলিশ সৃজন ও বাংলিশ শাখা জাতি সৃজনের প্রক্রিয়া রোধ হবে।


ড. এবিএম রেজাউল করিম ফকির: অধ্যাপক ও পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব অভ্যাগত অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন