অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা

যথাযথ নিয়ম মেনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাচাই করতে হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে

ছবি : বণিক বার্তা

করোনা মহামারী মোকাবেলায় যেসব টিকা অবদান রেখেছে তার মধ্যে বিখ্যাত ওষুধ ও টিকা প্রস্তুতকারী কোম্পানি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরীকৃত টিকা অন্যতম। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রস্তুতকৃত টিকাটি ইউরোপে ‘ভ্যাক্সজেভরিয়া’ নামে পরিচিত। একই টিকা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘কোভিশিল্ড’ নামে উৎপাদন করা হয়। বিশ্বে প্রথম করোনার এ টিকা মানবদেহে প্রয়োগ করা হয় ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। অন্যান্য করোনা টিকার তুলনায় এটি অনেক সস্তা এবং সংরক্ষণ করা সহজ হওয়ায় এটাকে বিশ্বের জন্য ভ্যাকসিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল ২০২০ সালের নভেম্বরে। ওই বছরই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছাড়পত্র পাওয়ার পর এক বছরে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩০০ কোটি করোনা টিকার ডোজ ব্যবহার করা হয় পৃথিবীজুড়ে। এসব টিকার ডোজ প্রাণ বাঁচিয়েছে বিশ্বের ৬৫ লাখেরও বেশি মানুষের। কিন্তু সম্প্রতি ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট অ্যাস্ট্রাজেনেকা বৈশ্বিকভাবে নিজেদের সব করোনা টিকা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের এক বিবৃতি থেকে জানা যায়, এ টিকার বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ ও বিতর্ক তৈরি হওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশেও এ টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। বণিক বার্তার প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাচাইয়ের জন্য এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে এ উদ্যোগ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। যদিও এখানে প্রশ্নের অবকাশ রয়ে যায়—পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাচাইয়ের কাজটি যথাযথ ক্লিনিক্যাল সার্ভের মাধ্যমে করা হবে কিনা। 

অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশকিছু অভিযোগ উঠেছে। গত বছর এক ব্যক্তি যুক্তরাজ্যের ভোক্তা সুরক্ষা আইনের অধীনে এ টিকা নেয়ার পর মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার অভিযোগে মামলা করেন। এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের কাছে জমা দেয়া নথিতে প্রথমবারের মতো অ্যাস্ট্রাজেনেকা স্বীকার করে যে, তাদের করোনা টিকা খুবই বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

এ টিকা গ্রহণের ফলে থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিনড্রোম (টিটিএস) নামে একটি বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) মতে, টিটিএস এমন একটি বিরল শারীরিক সমস্যা, যা রক্তে প্লাটিলেট কমিয়ে দেয়। প্লাটিলেট রক্তকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। টিটিএসের ফলে মস্তিষ্ক বা অন্ত্রে, কখনো কখনো পা বা ফুসফুসেও রক্ত জমাট বাঁধায়। টিটিএসের উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে গুরুতর মাথাব্যথা, পেটব্যথা, পায়ে ফোলাভাব, শ্বাসকষ্ট ও খিঁচুনির মতো সমস্যা।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকার প্রয়োগ শুরু হলে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশেও পরীক্ষামূলকভাবে এর প্রয়োগ শুরু করে সরকার। ট্রায়ালের ১০ দিন পরই গণপরিসরে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। দেশে মোট প্রয়োগকৃত ডোজের ১৫ শতাংশের বেশিই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, দেশে কোভিশিল্ড টিকাগ্রহীতাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত গুরুতর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। 

কভিড ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণে ক্লিনিক্যাল সার্ভের প্রয়োজনীয়তা আছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা অন্য কোনো ওষুধ ও টিকাসংক্রান্ত সমস্যা শনাক্তকরণ, মূল্যায়ন, পর্যবেক্ষণ, প্রতিরোধ সম্পর্কিত বিজ্ঞান ও কার্যক্রমকে ফার্মাকোভিজিল্যান্স বলা হয়। জানা যায়, ফার্মাকোভিজিল্যান্স পরিচালনার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের কাজটি করা হবে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এরই মধ্যে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জানতে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। করোনার টিকাগ্রহীতাদের তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। দ্বৈচয়নের ভিত্তিতে টিকাগ্রহীতাদের কল করা হবে। টিকাগ্রহীতারা কোনো সমস্যা বোধ করে কিনা সে বিষয়ক তথ্য জেলা-উপজেলা, শহর-গ্রাম বিভিন্ন অঞ্চলে কলের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে। পরবর্তী সময়ে সমস্যা থাকলে তা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিনা তা যাচাই করবে বিশেষজ্ঞ দল। গ্রহীতার মেডিকেল ইতিহাসও দেখা হবে। এ কাজটি হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য ব্যবস্থাপনা শাখা (এমআইএস), পরিকল্পনা ও গবেষণা শাখা, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সমন্বয়ে। যাচাইয়ের ফলাফল প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ প্রক্রিয়া অনেকটা জরিপের মতো।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাচাইয়ের প্রক্রিয়াটির নাম অ্যাডভার্স ইভেন্ট ফলোয়িং ইমিউনাইজেশন (এইএফআই)। এক্ষেত্রে নজরদারি দুভাবে করা হয়ে থাকে—এক. পরোক্ষ বা নিষ্ক্রিয় নজরদারি এবং দুই. প্রত্যক্ষ বা সক্রিয় নজরদারি। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ওষুধের কারণে হয়েছে বলে সন্দেহ করলে তা নির্দিষ্ট ফরম পূরণের মাধ্যমে ঔষধ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সেলকে অবহিত করতে পারেন যে কেউ, যাকে নিষ্ক্রিয় বা পরোক্ষ নজরদারি বলা হয়। পক্ষান্তরে, সক্রিয় বা প্রত্যক্ষ নজরদারির জন্য নমুনা কাঠামো অনুসরণের মাধ্যমে সন্দেহজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে গবেষণা করা হয়। তাছাড়া কোনো সুনির্দিষ্ট সমস্যা চিহ্নিত করে সবাইকে জানানোর জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে। করোনার জরুরি অবস্থায় অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেয়া হয়েছিল। যদিও এ টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই বিরল, দীর্ঘমেয়াদে কোনো ঝুঁকি তৈরি হতে পারে কিনা তা যাচাই করা দরকার। 

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে ২০২১ সালের মার্চেই ইউরোপে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে রক্ত জমাটকে কেন্দ্র করে। ওই সময় জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, বুলগেরিয়া, আইসল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা প্রয়োগ স্থগিত করে। কিন্তু আমাদের ওই উদ্বেগ আমলে নেয়া হয়নি। বর্তমানে আমলে নেয়া হলেও কতটুকু কার্যকর হবে তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। কেননা দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রচলিত সুবিধা দিয়ে পাশ্ব‍র্প্রতিক্রিয়া চিহ্নিত ও নিশ্চিত করার সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

তবে টিকার সন্দেহজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে এবং স্বাস্থ্য খাতের প্রতি মানুষের আস্থা রক্ষার জন্য সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করা দরকার। দেশে টিকা অনুমোদন ও প্রয়োগের বিষয়ে সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করে থাকে টিকাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি (নাইট্যাগ)। এ কমিটিকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রতিকূল প্রভাবের প্রকৃত স্বরূপ বের করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের দিকনির্দেশনা দিতে হবে। ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে যথাযথ নিয়ম মেনে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। নয়তো স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়বে, নিম্ন আয়ের মানুষ আরো অর্থনৈতিক দুর্দশার সম্মুখীন হবে। যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন