আলোকপাত

চলমান তাপপ্রবাহ ও নগর পরিবেশ: কারণ ও করণীয় বিশ্লেষণ

ড. মো. ইকবাল সরোয়ার

ছবি : বণিক বার্তা

দেশব্যাপী সব বয়সী মানুষের জীবনযাত্রা দুঃসহ করে তুলেছে সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহ। শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র সব পেশার ওপর চলমান এ তাপপ্রবাহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাপপ্রবাহ (হিট ওয়েভ) আবহাওয়া সংক্রান্ত একটি শব্দগুচ্ছ, যা দিয়ে বায়ুর অতিরিক্ত উষ্ণ অবস্থা বোঝায়। যদি কোনো স্থানে বাতাসের তাপমাত্রা দীর্ঘ সময় (তিন থেকে পাঁচদিন) অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং সেই সঙ্গে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যায় তাকে তাপপ্রবাহ বোঝায়। হেলেনিক ন্যাশনাল মেটিওরোজিক্যাল সার্ভিসের (গ্রিস) তথ্যানুসারে তাপপ্রবাহ হলো, ক্রমাগত তিনদিন সময়কাল ধরে তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার ওপরে থাকে এবং এ সময় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয় এবং সেখানে বাতাসের উপস্থিতি থাকে খুবই কম, উল্লিখিত পরিবর্তনগুলো একটি বৃহৎ এলাকার ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ করা যায় তবে তাকে তাপপ্রবাহ বলে। তাপপ্রবাহকে মূলত মৃদু তাপপ্রবাহ (৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৭.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস), মাঝারি তাপপ্রবাহ (৩৮ ডিগ্রি থেকে ৩৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস), তীব্র তাপপ্রবাহ (৪০ ডিগ্রি থেকে ৪১.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং অতি তীব্র তাপপ্রবাহ (৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঊর্ধ্বে) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। 

তাপপ্রবাহের কারণে মানুষের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, শ্রমিকের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, অবনতি হয় কৃষি উৎপাদনে, ব্যাহত হয় শিল্প প্রক্রিয়া, তাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিভিন্ন অবকাঠামো। তাপপ্রবাহকে চরম আবহাওয়াগত পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাপপ্রবাহ মানবস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং খরাপ্রবণ এলাকায় দাবানলের ঝুঁকি বাড়ে। চলমান প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে ২০২৪ সালে সমগ্র বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১১ জনের মৃত্যু হয়। 

২০২৪ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে বাংলাদেশের উত্তর অংশ দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ আকারে প্রবেশ করে এবং এপ্রিলের শেষে এটি সমগ্র দেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলমান তাপপ্রবাহে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ বিপদে পড়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের পশ্চিমাংশের ২১টি জেলা সবচেয়ে বেশি উষ্ণতার ঝুঁকিতে রয়েছে, মধ্যম অংশের ১৪টি জেলা মোটামুটি উষ্ণতার ঝুঁকিতে রয়েছে এবং অবশিষ্ট জেলাগুলোয় কিছুটা কম তাপপ্রবাহ বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এপ্রিলজুড়ে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিই দেশের ইতিহাসে নথিভুক্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে গত ৩০ এপ্রিল যশোরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং একই দিন চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ছিল ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের ইতিহাসে রাজধানী ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়েছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ১৯৬০ সালে আর ২০২৪ সালে ২৯ এপ্রিল ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ১৯৬১ সালের ১১ এপ্রিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়েছিল ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ৭৬ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে এবারের তাপপ্রবাহের স্থায়িত্ব ও বিস্তৃতি সবচেয়ে বেশি। 

মূলত প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কিছু কারণই এ অসহনীয় তাপপ্রবাহের জন্য দায়ী। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া ও জলবায়ুগত পরিবর্তন, উপমহাদেশীয় উচ্চ তাপবলয়, বৃষ্টিপাত হ্রাস এবং এল নিনোর সক্রিয়তা। তাপপ্রবাহের জন্য মানবসৃষ্ট কারণগুলো হলো—ব্যাপক হারে বন উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ব্যাপক হারে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, উন্মুক্ত স্থানের অভাব, পুকুর-জলাশয় ভরাট, জনঘনত্ব ইত্যাদি।

তাপপ্রবাহ আবহাওয়ার স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। এ সময় প্রতি বছরই কমবেশি তাপপ্রবাহ বিদ্যমান থাকে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এবারের চিত্রটি ভিন্ন প্রকৃতির। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের তাপমাত্রার সঙ্গে বর্তমান তাপমাত্রার তুলনা করলে দেখা যায়, গড়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে তাপপ্রবাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি বেড়ে চলেছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এপ্রিলে সূর্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অন্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে এবং আকাশ থাকে মেঘমুক্ত। মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে সূর্য বাংলাদেশের ওপর লম্বভাবে কিরণ দেয়, ফলে এখানে তাপ থাকে প্রখর। তাপ সাধারণত পরিবহন, পরিচলন ও বিকিরণ এ তিন পদ্ধতিতে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের বিশাল এলাকা সমভূমি হওয়ায় এখানে তাপ প্রবাহিত হয় পরিবহন পদ্ধতিতে, যার ফলে সরাসরি তাপ লাগার কারণে বিশাল এলাকাজুড়ে তাপমাত্রা বেশি হয়। গত ২৩ এপ্রিল বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ‘স্টেট অব দ্য ক্লাইমেট ইন এশিয়া’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, বিশ্বব্যাপী গড় উষ্ণতার চেয়ে দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে এশিয়ার দেশগুলো। ওই রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সালের গড় তাপমাত্রার চেয়ে শুধু ২০২৩ সালেই এশিয়ার উষ্ণতা বেড়েছে প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে। বর্তমান সময়ের তাপপ্রবাহের জন্য অনেকগুলো প্রাকৃতিক নিয়ামকের অন্যতম একটি নিয়ামক হলো এল নিনোর সক্রিয়তা। এল নিনো একটি জলবায়ুগত ধরন। এল নিনোর মাধ্যমে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের পানি উষ্ণ হয়ে পড়ে। উষ্ণ স্রোতের ফলে দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী শীতল সামুদ্রিক স্রোত বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং স্থলভাগের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এল নিনোর কারণে অনাবৃষ্টি ও খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বর্তমান এ তাপপ্রবাহ এল নিনোরই একটি প্রভাব। 

বনভূমি পৃথিবীর ফুসফুস। একটি দেশের প্রকৃত পরিবেশ বিরাজমান থাকার জন্য মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বৃক্ষরাজি পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে পরিবেশকে নির্মল ও শীতল রাখে। কিন্তু মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের ফলে ক্রমাগত বৃক্ষের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকায় বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প হ্রাস পেয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের রিপোর্টে বলা হয়, ২০০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ কমেছে ৬ লাখ ৭ হাজার ৬২০ একর। এ বিশাল বনভূমি বিদ্যমান থাকলে প্রায় ৭৫ মেগা টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানো যেত বলে ধারণা করা হয়। ওই সময়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে চট্টগ্রামে (৫৭ হাজার ৫৭০ একর)। বিশ্বব্যাপী বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। মূলত মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজনে যত্রতত্র নির্বিচারে যে বনভূমি ধ্বংস করছে তার এ প্রক্রিয়াকে বন উজাড় বলা হয়। অতিরিক্ত জনসংখ্যার এ বাংলাদেশে মানুষ বাসস্থান তৈরি করতে বৃক্ষ নিধন করে। এছাড়া অবৈধ দখল, সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ফার্ম হাউজ, দোকান, রিসোর্ট ইত্যাদি কাজে বন উজাড় করছে। ফলে এ দেশের পরিবেশ দিন দিন চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠছে এবং সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহ তারই উদাহরণ।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, সমন্বয়হীনতা, জলাশয় ও উন্মুক্তস্থান ভরাট, অতিরিক্ত যানবাহন ও জনঘনত্ব, অপরিকল্পিত স্থাপনা, সবুজের আচ্ছাদন হ্রাস, অত্যধিক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, ইট-কংক্রিটের অতিরিক্ত বসতি ইত্যাদি বাংলাদেশের প্রধান নগর এলাকাগুলোর অতিরিক্ত তাপমাত্রার জন্য দায়ী। নগর এলাকায় জনঘনত্ব ও আবাসিক স্থাপনার ঘনত্ব অধিক। এখানে অনেক মানুষের রান্নার প্রয়োজন হয়, যা ব্যাপক আকারে বায়ুদূষক গ্যাস উৎপন্নের পাশাপাশি শহর এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে। আবার অন্যদিকে নগর এলাকায় বসবাসকারী মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াতে যানবাহন হতে প্রচুর পারিমাণে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও ওজোন নির্গত হচ্ছে; তাছাড়া যানবাহনগুলো প্রধানত ডিজেল, পেট্রল ও সিএনজি ব্যবহার করে। যানবাহনগুলোর ইঞ্জিনে ত্রুটি, মানসম্মত জ্বালানি ব্যবহার না করা, ফিটনেসের অভাব ইত্যাদি কারণে নগর এলাকায় এসব যানবাহন তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে। যেমন গত ২০ বছরে রাজধানী ঢাকায় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সমুদ্র-নদী-পাহাড়ঘেরা নান্দনিক চট্টগ্রামে গত তিন দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃক্ষকর্তন, জলাশয় ভরাট বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তাপপ্রবাহ হার বাড়ার অন্যতম কারণ। দ্রুত হারে নগরায়ণের জন্য ৬০ বর্গমাইল আয়তনের চট্টগ্রাম শহরের ওপর ক্রমাগত আবাসনজনিত চাপ বাড়ছে। চসিকের হিসাবে নগরীতে হোল্ডিং (গৃহ) সংখ্যা হলো ১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৮টি। অন্যদিকে প্রতি বছর প্রায় ৫ শতাংশ হারে চট্টগ্রামের নগর জনসংখ্যা বাড়ছে। চট্টগ্রাম নগরের মোট আয়তনের প্রায় ৪৫ শতাংশ হলো বিল্ডআপ এরিয়া। অন্যদিকে নগর জনসংখ্যার আবাসনের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে আবাসন তৈরির অন্যতম উপাদান ইট প্রস্তুত করতে গিয়ে আগুন দিয়ে কাঠ-কয়লা পোড়াতে হয়, পুরনো ভবন ভাঙতে হয়, নতুন নির্মাণ ও ভবন নির্মাণসামগ্রীর রক্ষণাবেক্ষণ ও তাপমাত্রাকে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করছে; যা নগর এলাকার তৈরি করছে ‘‌আরবান হিট আইল্যান্ড’। এসব হিট আইল্যান্ডে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। আরবান হিট আইল্যান্ডে তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণ শহর এলাকার পিচঢালা সড়ক, কাচের আবরণের বিল্ডিং, অতিরিক্ত বিল্ডিং স্থাপনা, এসির ব্যবহার, অপ্রতুল জলাশয় ও যানবাহনের আধিক্য এছাড়া অল্প জায়গায় অধিক জনঘনত্ব, শিল্প-কারখানা ও মানুষের নানা কর্মকাণ্ড ইত্যাদি চট্টগ্রাম নগরীর উচ্চ তাপমাত্রার জন্য দায়ী। অন্যদিকে রুয়েটের এক গবেষণায দেখা যায়, রাজশাহীতে গত ২০ বছরে সবুজের আচ্ছাদন হ্রাস পেয়েছে ২৪ শতাংশ এবং জলাশয় হ্রাস পেয়েছে ১১ শতাংশ। এ নগরে সবুজের পরিমাণ হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে কংক্রিটের স্থাপনা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভূ-ত্বকের তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। চলমান এ তাপপ্রবাহ বাংলাদেশের শহরগুলোর জন্য ক্রমাগত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের নগরে বসবাসকারী ৩৫ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর সৃষ্টি করছে হুমকি। এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০৫০ সাল নাগাদ তাপপ্রবাহ বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩ দশমিক ৫ বিলিয়নের বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে এবং তাদের অধিকাংশ হবে শহরে বসবাসকারী অধিবাসী।

বাংলাদেশে নগর এলাকাগুলো এমনিতেই মৃত্যুকূপ। প্রতি বছরই বাংলাদেশের শহর এলাকাগুলোয় গার্ডার ধস, ড্রেনে পড়ে মৃত্যু, পাহাড় ধসে মৃত্যু, অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু ইত্যাদি অস্বাভাবিক হতাহত লেগেই আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এ দেশে নবতর সংযোজন হলো এ তাপপ্রবাহ। এখন থেকে প্রতি বছরই আমাদের সচেতন থাকতে হবে তাপপ্রবাহজনিত হতাহত থেকে পরিত্রাণ পেতে। তাপপ্রবাহজনিত ক্ষয়ক্ষতি গ্রাম-শহর উভয় এলাকায় ব্যাপক এবং এর আর্থিক, মানসিক, শারীরিক ও বৈষয়িক ক্ষতি মারাত্মক। তাপপ্রবাহজনিত এ প্রাকৃতিক পরিস্থিতি সহজে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন একটি কাজ। এ পরিস্থিতি ভবিষ্যতে মারাত্মক ক্ষতির কারণ না হতে পারে। যেমন সঠিক পরিমাণে পানি সরবরাহ ও সেচ নিশ্চিত করতে হবে; খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে অধিক উষ্ণতা সহনশীল বীজ উদ্ভাবন জরুরি; শহর এলাকায় পর্যাপ্ত পার্ক ও খেলার মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে; পরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে হবে; পুকুর, জলাশয় রক্ষার পাশাপাশি জনঘনত্ব সমন্বয় একান্ত জরুরি; সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পে উদ্যোগ বৃদ্ধি প্রয়োজন, পর্যাপ্ত ও সঠিক বৃক্ষের পরিমাণ বাড়াতে হবে ও যথাযথ পরিচর্যা করতে হবে; শহর এলাকার বিল্ডিংয়ে ছাদবাগানে উৎসাহিত ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিত; কাচের স্থাপনা নিরুৎসাহিত করে বাড়ির ছাদ সাদা রঙ করা যেতে পারে; শহরাঞ্চলে নির্দিষ্ট দূরত্বে স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে; যত্রতত্র আবর্জনা পোড়ানো বন্ধ করতে হবে; ব্যক্তিগতভাবে যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হয়ে শহর এলাকার সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে হবে।

ড. মো. ইকবাল সরোয়ার: অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন