সময়ের ভাবনা

স্বস্তির বৃষ্টিতে এডিসের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি কেমন

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

ছবি : বণিক বার্তা

অনেক দিন অনাবৃষ্টি আর প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে মানুষের জীবন চরম অবস্থার মধ্যে ছিল। হিট স্ট্রোকে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। বেড়ে ছিল তাপজনিত কারণে রোগের প্রভাব। এ অবস্থায় সবার মনে একটাই কামনা ছিল শান্তির বৃষ্টির। অনেক জায়গায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এস্তেস্কার নামাজও আদায় করে বৃষ্টির জন্য দোয়া ভিক্ষা করেছেন। অবশেষে শান্তির বৃষ্টিতে মানুষের মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফিরে এসেছে। প্রচণ্ড দাবদাহে মানুষের হাঁসফাঁস উঠলেও একটি বিষয়ে স্বস্তি ছিল আর তা হলো মশার উৎপাত ছিল না। যেসব বাসায় মশারি ছাড়া ঘুমানো অতি দুষ্কর ছিল, সেসব বাসাতেও খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে মশারি ছাড়া ঘুমানো গেছে স্বস্তির সঙ্গে। 

গত কয়েক দিনে স্বস্তির বৃষ্টি নামার সঙ্গে সঙ্গে মশার উৎপাতও বেড়ে যাচ্ছে। এ তাপদাহের পর মশার যেসব ডিমের ডেসিকেশন রেজিস্ট্যান্স অনেক বেশি সেসব ডিমই সারভাইব করতে পেরেছে। তাই এ অধিক সজীবনী শক্তিসম্পন্ন ডিম ফুটে যেসব লার্ভা উৎপাদন হবে তারা অধিক শক্তিশালী ও আক্রমণাত্মক হবে। এমনিতেই ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা দুই নতুন রেকর্ড করেছে ২০২৩ সালে। ২০২৩ সালকে ডেঙ্গুর আতঙ্কের বছর বললে এতুটুকু ভুল বলা হবে। কিন্তু সেই রেকর্ডও ভেঙে ২০২৪ সালে যে ভয়াবহতা লক্ষ করা যাচ্ছে তা সত্যিই আতঙ্কের। ২০২৩ সালের এই দিনে অর্থাৎ ৮ মে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১২৩ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১১ জন। আর ২০২৪ সালের ৮ মে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৩৬০ ও মৃত্যুর সংখ্যা ২৮। এর ওপর এই মাঝে মাঝে প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণ মশাকে আরো শক্তিশালী ও বেপরোয়া করে তুলছে। কার্ভ দেখে মনে হচ্ছে প্রকৃতি এবং মানুষের সৃষ্টি সব ফ্যাক্টরই যেন মশার বংশবিস্তার ও রোগ ছড়ানোর পক্ষেই যাচ্ছে। কোনো দিক থেকেই যেন মানুষের অনুকূলে কিছুই নেই। নতুন বৃষ্টি মানবজীবনে স্বস্তি আনলেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে, মশার প্রজনন স্থল বাড়াতে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। একইভাবে খানা-খন্দ ও পানির স্বাভাবিক নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে আমরা সব শ্রেণীপেশার মানুষই তৈরি করছি মশকীর অভয়ারণ্য। পরিবেশের যেকোনো চরম অবস্থাই মশাপ্রতিরোধী হয়ে ওঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তাই এ প্রতিরোধী হয়ে ওঠার তীব্রতা ও আধিক্য পরিমাপ করে তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই হবে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা। 

মশা যত শক্তিশালীই হোক তা দমন করা তখনই সম্ভব যখন পদ্ধতিগুলো বিচ্ছিন্ন না হয়ে হবে সমন্বিত। জনস্বাস্থ্যের জন্য নির্ধারিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) যথাযথভাবে অর্জন করতে চাইলে অবশ্যই শক্তিশালী পরিকল্পনা ও তার সমন্বয় অত্যাবশ্যক। শহরের জন্য যেমন গাইড লাইন দরকার। একইভাবে গ্রামের জন্য প্রয়োজন গাইড লাইনের সঙ্গে জনসচেতনতা ও সম্পৃক্ততা। মশা অতি ক্ষুদ্র পতঙ্গ হয়েও যদি এত বেশি বুদ্ধিমান ও কৌশলী হয়ে শক্তি অর্জন করতে পারে তাহলে আমরা মানুষ কেন নিজেদের এত বুদ্ধি থাকতে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে তাদের সাহায্য করব। 

পানির ব্যবস্থাপনা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই পারে মশার প্রজননস্থল নির্মূল করতে। একদিকে বৃষ্টি পেয়ে স্বস্তির অন্তরালে কি বিলীন হয়ে যাবে প্রাপ্ত সুখটুকু? শুনেছি পানির আরের নাম জীবন। পানি ছাড়া যেমন কোনো জীবই চলতে পারে না, পারে না বাঁচতে। আবার এ পানিই বন্যার সময় জীবের জীবননাশের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিলীন হয়ে যায় অগণিত বাড়িঘর, গবাদিপশুসহ শত শত হেক্টর জমির ফসল। তাই পানি ব্যবস্থাপনা অবশ্যই হতে হয় সুপরিকল্পিত। শহরে যখন বৃষ্টি হয় তখন তা যদি সঠিকভাবে নিষ্কাশিত না হয় তবে সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতা, এ জলাবদ্ধতা হতেই মশা সম্পর্কিত সব সমস্যার উৎপত্তি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন খাল বা লেকে নিষ্কাশনে বাধাপ্রাপ্ত জমাটবদ্ধ পানি। এ পানিতে পার্শ্ববর্তী বাড়িঘর থেকে ফেলা ময়লা-আবর্জনা পচে তৈরি হচ্ছে এক কিম্ভূতকিমাকার অবস্থা ও উদ্ভট গন্ধের। এ অবস্থা জনজীবন অবশ্যই কোনো আরামদায়ক অনুভূতির উদ্রেক করে না, করে এক অসহনীয় পরিস্থিতির। এ চরমভাবে দূষিত জলাবদ্ধ পানি কিউলেক্স মশার উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যা থেকে উৎপন্ন মশা ও মাছি জনজীবনে দুর্ভোগ ও রোগজীবাণু ছড়িয়ে চলছে। তাই তো স্বস্তির বৃষ্টি শান্তির আবেশ তৈরির সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্ক আর ভয়াবহতাই বয়ে আনে। 

কিন্তু আমরাও বাঙালি। যেকোনো প্রতিকূলতা আমরা মোকাবেলা করতে সক্ষম। ১৯৭৪ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি যুবলীগের জাতীয় কংগ্রেসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘‌বাংলায় সম্পদ আছে, বাংলার সম্পদ বাংলার মানুষ’। এ মানবসম্পদ অবশ্যই সঠিকভাবে সচেতন ও সম্পৃক্ত হয়ে অশনিসংকেতপূর্ণ ডেঙ্গুর ভয়াল থাবা হতে রক্ষা পেতে জাতীয় স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান অনুযায়ী দায়িত্ব বণ্টন করে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলে কখনই স্বস্তিদায়ক বৃষ্টির জল অশ্রুজলে রূপান্তরিত হতে পারে না। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত দেশ হলো ব্রাজিল। সেই দেশের ডেঙ্গুতে প্রাণহানির শতকরা হারও আমাদের দেশের ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হারের চেয়ে কম। তাই জলাবদ্ধ পানির পরিসর কমিয়ে এডিসের ঘনত্ব কমানোর সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সহজলভ্যতা ও সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সব শ্রেণীপেশার মানুষের সম্পৃক্ততার সঙ্গে সঙ্গে কীটতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা ও কর্মপরিধি এবং গবেষণার সুযোগ-সুবিধা ও অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে না পারলে এ নাজুক পরিস্থিতির উত্তরণ মিলবে না। 

তাই এখন সময় এসেছে সমন্বিতভাবে কাজ করার। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে যদি কাজ করা হয় তবে অবশ্যই স্বস্তির বৃষ্টির পানি আশীর্বাদ হিসেবে পরিণত হবে। কখনই মশার প্রজনন ক্ষেত্র বাড়ানোর কাজে ব্যবহার হবে না, হবে উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের সমৃদ্ধির কারণ। ব্যবহৃত হবে বিশুদ্ধ পানির উৎস হিসেবে। অর্জন হবে এসডিজির বিধিত গোল। 

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন