বিহারি তরুণরাও এখন বিদেশে কাজের স্বপ্ন দেখে

মো. সাইফুল ইসলাম ও আনিকা মাহজাবিন

বিহারি তরুণরা এখন দেশের মূলধারার অন্তর্ভুক্ত হতে চান। মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প থেকে গতকাল ছবিটি তুলেছেন তাওহীদুজ্জামান তপু

হাইকোর্টে ২০০৮ সালের ঘোষিত এক রায় বিহারিদের বাংলাদেশে ভোটার হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। নাজুক এ জনগোষ্ঠীটির সামনে বাংলাদেশে ভোটার হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিনের ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ পরিচয় কাটিয়ে দেশের মূলধারার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথও প্রশস্ত হয়। বিশেষ করে বিহারি তরুণদের এ ইচ্ছা আরো প্রবল হয়ে দেখা দেয়। বিহারি ক্যাম্পের ঘিঞ্জি জীবনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশী হিসেবে বিদেশে কাজ নিয়ে যেতেও আগ্রহী হয়ে ওঠেন তাদের অনেকে। 

যদিও এখনো তাদের এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে রয়েছে বৈধপথে পাসপোর্ট করতে না পারা। মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনআইডি পেয়ে ভোটার হওয়ার সুযোগ পেলেও একজন নাগরিকের পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছেন না তারা। এমনকি বৈধভাবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট করারও সুবিধা নেই বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের।

ক্যাম্পের বাসিন্দা আমির (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমরা ক্যাম্পের ঠিকানা দেখিয়ে আবেদন করলে পাসপোর্ট পাই না। আবেদনের সঙ্গে বিদ্যুৎ বা অন্যান্য পরিষেবার বিল প্রদর্শনেরও সুযোগ নেই আমাদের। এজন্য আমাদের ইচ্ছা থাকলেও বৈধ পথে পাসপোর্ট আর পাওয়া হয় না। কেউ কেউ ঠিকানা বদলে পাসপোর্ট করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সেক্ষেত্রেও বিপদ হলো এর জন্য দালাল বা অননুমোদিত কোনো মাধ্যমের শরণাপন্ন হতে হয়। তারা টাকাও দাবি করে অনেক।’ 

বিহারিরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জরাজীর্ণ ঘিঞ্জি ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করছে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে। পুরনো প্রজন্ম অতীতে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও বর্তমানের বিহারি ক্যাম্পের তরুণ-যুবকরা নিজেদের বাংলাদেশী বলেই মনে করেন। দেশের মূলধারার অংশ হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশ করেছেন তারা। কিন্তু এখনো পূর্ণ নাগরিকত্ব হিসেবে বৈধপথে পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার পাননি দেশের বিভিন্ন বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দারা। 

এ বিষয়ে চেষ্টা করেও পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষ বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কারো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র বণিক বার্তাকে বলেছে, স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানে গিয়ে থেকে যাওয়া অনেক বাংলাদেশী এখনো সেখানকার নাগরিকত্ব পায়নি। সেখানে তারা বাংলাদেশের বিহারিদের চেয়েও মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের জন্য সেখানকার নাগরিকত্ব আদায় করে নেয়ার কৌশল হিসেবেও হয়তো বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের পাসপোর্ট সুবিধা আটকে থাকতে পারে।

বাংলাদেশে বিহারির সংখ্যা কত এ বিষয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১১৬টি ক্যাম্পে দেড় থেকে তিন লাখ বিহারির বসবাস। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাকিস্তান কী করছে সেদিকে তাকানোর দরকার নেই। যেহেতু আমরা এনআইডি দেয়ার মহত্ত্ব ও ঔদার্য দেখিয়েছি, পাসপোর্টেও পারি। তবে এখন তাড়াহুড়ার কথা আমি বলব না । পাসপোর্ট দেয়ার জন্য যাচাই-বাছাই হোক। প্রক্রিয়াটি চলমান থাকুক। তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন ঝুলে না থাকে সে বিষয়টি দেখতে হবে।’

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রচুর অবাঙালি মুসলিম বাসিন্দা বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। বিহার রাজ্য থেকে আগতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের সবাইকে মোটাদাগে বিহারি বলে অভিহিত করা হয়। উর্দুভাষী হওয়ায় সে সময় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের এক ধরনের নৈকট্য তৈরি হয়। এ বিষয়টিই তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাঙালিদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সে সময় তাদের বড় একটি অংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। স্বাধীনতার পর হাইকোর্টের এক রায়ে তাদের বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ দেয়া হলেও তখন তা খুব কম সংখ্যকই কাজে লাগায়। অধিকাংশেরই ইচ্ছা ছিল পাকিস্তানে চলে যাওয়ার। যদিও ইসলামাবাদে জেনারেল জিয়াউল হকের সরকার ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের পাকিস্তানি নাগরিকত্বের অযোগ্য বলে ঘোষণা করে। পুরোপুরি রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে বিহারিরা। বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় এক পর্যায়ে কিছু বিহারিকে পাকিস্তানে পাঠানো সম্ভব হলেও তা বেশিদিন চালু রাখা যায়নি। 

বিহারিদের বৈধভাবে পাসপোর্ট দেয়ার সুযোগ তৈরি না হওয়ার পেছনে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ের ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন বাংলাদেশে বসবাস করায় বিহারিদের প্রায় ৯০ শতাংশই এখন বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করছে। এদেশেই তাদের বড় একটি অংশ জন্ম নিয়েছে ও বেড়ে উঠেছে। সেজন্য তেমন পার্থক্য এখন নেই। সে বিবেচনায়ই মূলত তাদেরকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার ও তার আগেও যারা শাসনব্যবস্থায় ছিল সবাই বিহারিদের উদারভাবে দেখেছে। কিন্তু এ বিষয়টি আমরা পাকিস্তানে থাকা বাঙালিদের বেলায় দেখছি না। বরং এখনো তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। আর বিহারিরা পাসপোর্ট নিতে না পারার পেছনে ভূরাজনৈতিক কারণ কাজ করছে বলেই আমার মনে হচ্ছে। কেননা এ পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেউ যদি আফগানিস্তান বা অন্য কোনো দেশে গিয়ে অবৈধ কাজে জড়িয়ে যায়, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই এখন পাসপোর্ট দেয়া না হলেও পরে আরো কিছু সময় গেলে তাদেরকে পাসপোর্ট দেয়া হবে বলে আমার ধারণা।’

বিহারিদের তরুণ প্রজন্মের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা নিজেদের পুরোপুরি বাংলাদেশী মনে করেন। যদিও বাঙালিদের সঙ্গে বিহারিদের দীর্ঘদিনের দূরত্ব তাদের জীবনমান ও পেশাগত উন্নয়নের পথে এখনো অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। আবার জেনেভা ক্যাম্পে তাদের বসবাসের পরিবেশও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। নাগরিক অনেক সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। ক্যাম্পের সীমিত এলাকায় জনসংখ্যা যত বেড়েছে, সেখানকার পরিবেশেরও তত অবনতি হয়েছে। নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন সুবিধা অপ্রতুল। শিক্ষাদীক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগও অপ্রতুল। বর্তমানে এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন তারা। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বিদেশে কাজ করার সুযোগ পেলে তারা একদিকে যেমন নিজেদের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ পাবেন, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখতে পারবেন। 

মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, এ সমস্যার সমাধান এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিহারিদের এনআইডি কার্ড দেয়া হলেও তাদের পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছে না। এটি রাজনৈতিক বিষয়। এর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে। দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এদেশে তারা বসবাস করছে। এ সমস্যার সমাধান দরকার।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন