টাকা ব্যাংকেই রাখুন, তবে বুঝেশুনে

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাংক খাতের অবস্থানকে কীভাবে দেখেন?

ব্যাংক বা আর্থিক খাতকে বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা উচিত। যেকোনো দেশের অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে সংগতি রেখে আর্থিক খাতও ব্যাপক প্রসার হয়। এক্ষেত্রে অর্থনীতির আকারের চেয়ে আর্থিক খাতের আকার হয় অনেক বড়। উদাহরণ হিসেবে যদি আমরা পুরো বিশ্বের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব ব্যাংক খাতের আকার পৃথিবীর জিডিপির ১৬০ থেকে ১৭০ শতাংশ। এটা শুধুই ব্যাংক খাতের আকার। বিশ্বের বন্ড মার্কেটকে ব্যাংক খাতের বাইরের হিসাবে ধরা হয়। বর্তমানে বন্ড মার্কেটের আকার হবে পৃথিবীর মোট জিডিপির ১২০ থেকে ১৩০ শতাংশ। আর বৈশ্বিক পুঁজিবাজারের আকার হবে ৯২ থেকে ৯৫ শতাংশ। এছাড়া আছে বীমা খাত। তাহলে আমরা দেখছি, পৃথিবীর আর্থিক খাত মোট জিডিপির ৪০০ শতাংশের বেশি বা জিডিপির চার গুণ। উন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রে রেশিও অনেক বেশি হলেও উন্নয়নশীল দেশে কিছুটা কম।

তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, জিডিপির তুলনায় আর্থিক খাত ৪০০ শতাংশের জায়গায় ১০৪-১০৫ শতাংশের মতো। আর্থিক খাতের চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানব্যাংক, বন্ড মার্কেট, স্টক মার্কেট ইন্স্যুরেন্স খাত মিলিয়ে এটি। এর মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাংক খাত সবচেয়ে বড়। বর্তমানে দেশে ব্যাংক খাতের আকার জিডিপির ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশের মতো। তবে আকার খুব বেশি বড় কিছু না। এটিকে খুব ছোটই বলতে হবে। ভারতের ব্যাংক খাতের আকার জিডিপির ৯২-৯৩ শতাংশের মতো। সে হিসেবে আমরা খুবই ছোট। যদিও ব্যাংক খাত আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত। প্রকৃত অর্থে ব্যাংক খাত তার সম্ভাবনার জায়গায় যেতে পারেনি। এমনকি প্রত্যাশার ধারেকাছেও নেই।

তার পরও বিস্তৃতি সক্ষমতার আলোকে ব্যাংক খাত কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে?

ব্যাংক খাতের অনেক জায়গায় আমরা দুর্বলতা দেখছি। তবে একটা ইতিবাচক বিষয় হলো প্রযুক্তিগত দিক থেকে ব্যাংক খাত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে। এখন আমরা ঘরে বসেই ব্যাংকিং কার্যক্রম করতে পারি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাতে কতগুলো নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ হয়েছে। যেমন আমরা শুধু শাখা নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল নই। বাংলাদেশ ব্যাংক উপশাখা পদ্ধতি চালু করেছে। ব্যাংকগুলো এখন শাখার চেয়ে উপশাখা বেশি করছে। এজেন্ট ব্যাংকিং চালু হয়েছে, এটিও আমাদের ব্যাংক খাতের ভালো দিক। এজেন্ট ব্যাংকিং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংক সেবা পৌঁছাতে চায়। উপশাখা এজেন্ট ব্যাংকিং এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে দেশের ব্যাংকগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী অবদান রাখতে পারেনি। সেটিরই প্রতিফলন হচ্ছে আমাদের ব্যাংক খাত জিডিপির তুলনায় অনেক ছোট। ব্যাংকের তুলনায় স্বল্প সময়ে আমাদের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) সেবা বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

মানুষ নিজের পিতা-মাতার কাছে টাকা না রেখে ব্যাংকে রাখে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রতি আস্থাই মুখ্য। গ্রাহকদের সে আস্থায় চিড় ধরল কেন?

আমাদের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলার অভাব আইন প্রয়োগে ব্যত্যয় ঘটেছে। এটি ক্রমাগতভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে। ব্যাংকের প্রতি মানুষের অনাস্থার মূল হলো এটি। ব্যাংক খাতে সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ হয়নি। ফলে অনেকেই ব্যাংককে নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যবহার করেছে। পরিচালনা পর্ষদ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পারস্পরিক যোগসাজশে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এখানে এমন অনেক ঋণ দেয়া হচ্ছে, যেগুলো দেয়ার কোনো প্রশ্নই ছিল না। জালিয়াতির কারণে একের পর এক কেলেঙ্কারির সংবাদ আসছে। কোনো ছোটখাটো কেলেঙ্কারি নয়, বরং বড় বড় স্ক্যাম হচ্ছে। উদ্বেগের সঙ্গে আমরা দেখছি, ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে শতাংশে নেমে এসেছে। আমানতের এত কম প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি। এটি ব্যাংক থেকে মানুষের দূরে সরে যাওয়ার নিদর্শন।

ব্যাংক থেকে দূরে সরে মানুষ যাবে কোথায়? এক্ষেত্রে সঞ্চয়ের বিকল্প উৎস কী?

বাংলাদেশের মানুষের ব্যাংক থেকে দূরে সরে যাওয়ার জায়গাও নেই। কারণ আমাদের শক্তিশালী কোনো পুঁজিবাজার গড়ে ওঠেনি। সঞ্চয় বা বিনিয়োগের বিকল্প উৎস নেই বললেই চলে। কারণে মানুষ টাকা নিয়ে ঘুরেফিরে ব্যাংকেই ফিরবে। তবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন মানুষ ভালো ব্যাংক আর মন্দ ব্যাংক খুঁজছে। দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে ভালো ব্যাংকে নিয়ে আসছে। দেশে সব ব্যাংক সমান নয়। সবাই এক সমান হবে, আমি সেটিও বলছি না। তবে সব ব্যাংকেরই ন্যূনতম একটি মানদণ্ড থাকা দরকার। কিন্তু দুঃখজনক সংবাদ হলো অনেক ব্যাংকেই করপোরেট সুশাসন নেই। ব্যাংকের পর্ষদ ব্যবস্থাপনায় যারা আছেন, তারা নিজের স্বার্থে ব্যাংককে ব্যবহার করছেন। এতে ব্যাংকের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ছে। দুর্বল হয়ে যাওয়া ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা থাকে না। দেশের অনেক ব্যাংকেই এখন ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একই পরিবার অনেকগুলো ব্যাংকের মালিক হয়ে বসে আছে। এটি ব্যাংকিং আইনেরও পরিপন্থী। যদিও পরিবারতন্ত্র দিন দিন আরো  শক্তিশালী হচ্ছে।

ভালো ব্যাংক আর মন্দ ব্যাংক চিহ্নিত করার দায়িত্ব কার? সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবে কোনটি মন্দ ব্যাংক?

গ্রাহকের পক্ষে কোন ব্যাংক ভালো, কোনটি খারাপ সেটা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। আবার চিহ্নিত করা উচিতও না। এটি করতে গেলে হয়তো গ্রাহকের নামে মানহানি মামলা হয়ে যেতে পারে। এছাড়া অন্য সমস্যা তো আছেই। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের পক্ষ থেকে এটি ঠিক করে দেয়া উচিত। মন্দ ব্যাংকগুলোকে ভালো হওয়ার চাপ প্রয়োগ করা দরকার। প্রয়োজনে ধরনের ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দেয়ার দায়িত্বও বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের। এছাড়া দুর্বল ব্যাংক একীভূত করা, পর্ষদকে বিলুপ্ত করা বা পরিচালকদের সরিয়ে ফেলার দায়িত্ব হচ্ছে নিয়ন্ত্রকদের। এখন নিয়ন্ত্রকরা যদি এটা না করে তাহলে আমার টাকা রাখার জন্য তো আমাকেই ভাবতে হবে। অর্থাৎ পুলিশ যদি আমাকে নিরাপত্তা না দেয়, তাহলে আমার নিরাপত্তা বিধান তো আমাকেই করতে হবে।

ব্যাংক খাতে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা কেমন দেখছেন?

দেশের ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই ঘুরে দাঁড়ানো দরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা আমরা দেখিনি। ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের জন্য একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। ওই টাস্কফোর্স দলমতের ঊর্ধ্বে ওঠে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করবে। প্রয়োজনে ধরনের টাস্কফোর্সে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে থেকে ১০ বছর মেয়াদি নকশা হতে পারে। যেসব ব্যাংক দুর্বল তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনে বর্তমান মালিক পরিচালকদের সরিয়ে বা সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে হলেও ওইসব দুর্বল ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে। অন্যথায় অর্থনীতির যাবতীয় অর্জন চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে।

অর্থনীতিবিদ একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে আমানতকারীদের প্রতি আপনার বার্তা কী?

আমানতকারীদের আমি বলব, সব ব্যাংক সমান মানের নয়। ব্যাংক যখন সমস্যায় পড়ে, তখন ব্যক্তিকেও সমস্যায় পড়তে হয়। তাই আমানতকারীদের দায়িত্ব হবে বুঝেশুনে যেসব ব্যাংক শক্তিশালী এবং ব্যবস্থাপনা পর্ষদ উন্নতমানের সেখানে আমানত রাখুন। সরকারকে বলব, আপনারা নজরদারি বাড়ান। জনস্বার্থের কথা চিন্তা করে নিরাপদ ব্যাংক খাত গড়ে তুলুন। চূড়ান্তভাবে যেটা বলব, ঘরে টাকা রাখা যাবে না, ঘরে টাকা রাখা উচিত নয়। আপনার টাকা ব্যাংকেই রাখুন। বুঝেশুনে টাকা রাখুন, এতে আপনি নিরাপদ থাকবেন। আপনার টাকাও সুরক্ষিত থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন