বিদ্যুতে উৎপাদক বিক্রেতা ভোক্তা সবাই এখন ভুক্তভোগী

আবু তাহের

বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর (আইপিপি) ওপর। বাড়তি দামের পাশাপাশি বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে গিয়ে বাড়ছে বিপিডিবির লোকসান দায়ের পরিমাণ। লোকসানকে সামনে এনে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং তহবিল সংকটে এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা অর্থও পরিশোধ করতে পারছে না সংস্থাটি। যদিও বিদ্যুতের দাম বারবার সমন্বয় হওয়ায় আবাসিক, শিল্পসহ বিদ্যুতের সব শ্রেণীর ভোক্তার অর্থনৈতিক চাপ বেড়েছে।

আইপিপিগুলোর দাবি, বিপিডিবি তাদের পাওনা পরিশোধ করছে না সাত মাস ধরে। এরই মধ্যে সংস্থাটির কাছে আইপিপিগুলোর পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকায়। বিপুল অংকের পাওনা বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন নগদ অর্থের সংকটে পড়েছে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালন রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখা যাচ্ছে না। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সরকার নির্ধারিত মূল্য ব্যাংকের নির্ধারিত বাজারভিত্তিক মূল্যের মধ্যেও বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে এইচএফওভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি।

বিপিডিবির কাছে আইপিপিগুলোর বিপুল পরিমাণ পাওনা হয়েছে মূলত ক্যাপাসিটি চার্জ এবং বিদ্যুৎ ক্রয় জ্বালানি আমদানির খরচ বাবদ। নিয়ম অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল ইস্যুর ৩০ দিনের মধ্যেই বিপিডিবির কাছ থেকে পাওনা অর্থ পেয়ে যাওয়ার কথা। যদিও আগে বিল পরিশোধ করতে বিপিডিবির সময় লেগে যেত ৬০-৭০ দিন। কিন্তু এখন তা ছয় মাস ছাড়িয়ে প্রায় সাত মাসে ঠেকেছে। নগদ অর্থের সংকটের মুখে আইপিপি উদ্যোক্তারা এখন পাওনা আদায়ে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বুধবার বিষয়টি নিয়ে দেখা করেন বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) প্রতিনিধিরা। সেখানে তারা বিপিডিবির কাছে পাওনা অর্থ পরিশোধের দাবি জানিয়েছেন। বিষয়ে তাদের অনুরোধ ছিল, পুরোটা না পারলেও বিপিডিবি যাতে অন্তত বকেয়ার অর্ধেক অর্থ পরিশোধ করে দেয়।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিআইপিপিএ প্রেসিডেন্ট ফয়সাল করিম খান বণিক বার্তাকে বলেন, প্রায় সাত মাস ধরে আমাদের বিল আটকে আছে। অর্থ সংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল কিনতে পারছি না। তাই আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বকেয়া অর্থের অর্ধেক হলেও যাতে ছাড় করা হয় সে বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছি। তিনি বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন।

আইপিপি উদ্যোক্তা কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম বণিক বার্তাকে বলেন, বকেয়া বিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তিনি বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। বিষয়টি সমাধানেরও আশ্বাস দিয়েছেন। আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য বিষয়টি দ্রুত সমাধা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

একসময় উৎপাদন সক্ষমতার ঘাটতিকে দেখা হতো দেশের বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে। ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে গত এক-দেড় দশকে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায় নেমেছে একের পর এক আইপিপি। স্থানীয় বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র। যদিও সে অনুযায়ী বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো যায়নি। অবহেলিত থেকে গেছে সঞ্চালন ব্যবস্থায় বিনিয়োগও। আবার -সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিও এখন পর্যন্ত খুব একটা সন্তোষজনক নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন দীর্ঘদিন ধরেই আটকে আছে কেবল উৎপাদন সক্ষমতায়। সঞ্চালন ব্যবস্থা গ্রাহক পর্যায়ে চাহিদা তৈরির মতো জরুরি বিষয়গুলো অবহেলিতই থেকে গেছে। ফলে বিদ্যুতের সক্ষমতা বাড়লেও সে অনুযায়ী চাহিদা তৈরি হয়নি। এতে জাতীয় অর্থনীতিতে যেভাবে প্রয়োজন ছিল, সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি খাতটি। উল্টো সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে এর বড় একটি অংশকে বসিয়ে রেখে গুনতে হয়েছে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ। ফলে বিপিডিবিকে লোকসানের বৃত্ত থেকে কখনই বের করে আনা যায়নি। যদিও লোকসান জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে বারবার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। গোটা বিষয়টিই এখন বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তা ভোক্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই বড় চাপের কারণ হয়ে উঠেছে। সরকারের বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি নিয়েও চলতে পারছে না বিপিডিবি।

চলতি মাসের শুরুর দিকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি-সংক্রান্ত সর্বশেষ গণশুনানিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) বিপিডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, পাইকারিতে বিদ্যুতের বিল বাড়ানোর পরেও বিপুল পরিমাণ আর্থিক ঘাটতিতে রয়েছে সংস্থাটি। সরকারের দেয়া ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির পরেও বছর শেষে বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয় বাবদ ৪০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতিতে থাকবে বিপিডিবি।

বিদ্যুৎ জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দেশে বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন সক্ষমতার এক পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। সে তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল প্রায় ১৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়াবে বলে জানান তিনি।

ডলার সংকটে আমদানি করা যাচ্ছে না জ্বালানি। অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন এখন বন্ধ। এমনকি মেগা প্রজেক্ট হিসেবে নির্মিত একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও একই পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে কম। দৈনিক চাহিদা সীমাবদ্ধ থাকে সাড়ে হাজার মেগাওয়াটে। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন এটুকুও সরবরাহ করতে পারছে না। শীতকালেও লোডশেডিংয়ে পড়তে হচ্ছে গ্রাহকদের।

ভোগান্তি থাকলেও এখন আবাসিক থেকে শুরু করে সব খাতের ভোক্তাদের বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করতে হবে আগের চেয়ে বেশি। গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে নয়বার। সময় পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ  গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ানো হয়। একই সময় খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় দশমিক শতাংশ, যা ওই বছরের মার্চে কার্যকর হয়। এরপর গত ডিসেম্বরে আরেক দফা বাড়ানো হয় পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম।

সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি সরকারের এক নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের -সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপনে আবাসিক গ্রাহক পর্যায়ে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে টাকা ৯৪ পয়সা, শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম টাকা ১৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে টাকা ৪০ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের টাকা ৭২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে টাকা পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের টাকা থেকে টাকা ৩০ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য টাকা ৩৪ পয়সা থেকে টাকা ৬৬ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য টাকা ৯৪ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৪৫ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১১ টাকা ৪৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা পয়সা করার ঘোষণা দেয়া হয়।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুেসবা এখন মানুষের মৌলিক অধিকারের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ উচ্চমূল্যের কারণে সেই পণ্যটি যদি সাধারণ ভোক্তা কিনতে না পারে, তাহলে তো হলো না। কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে হলে, ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা থাকলে তা নিয়ে যথাযথ সমীক্ষা দরকার। বিদ্যুতের দাম বাড়ালে, পণ্যটি ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে সরকার কীভাবে এসব মানুষকে সাহায্য করবে? ফলে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হলে সরকারের বাজার বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যুতের মতো অপরিহার্য সেবার মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী। সাধারণ মানুষের ভোগব্যয় থেকে শুরু করে শিল্পোৎপাদনসহ সার্বিক অর্থনীতিতেই এর বড় প্রভাব দেখা যায়। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি টাকার অবমূল্যায়নসহ নানা কারণে দেশের ভোক্তাশ্রেণী চাপে রয়েছে। এর মধ্যেই যেভাবে বিদ্যুতের দাম বারবার বাড়ানো হচ্ছে, তাতে গ্রাহকের সেবাটি নেয়ার সক্ষমতাও কমছে। একই সঙ্গে খাতের লোকসানও প্রতিনিয়ত বাড়তে বাড়তে অস্বাভাবিক পর্যায়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) মনে করছে, ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নয়, বরং কমানো সম্ভব। দুর্নীতি, অনিয়ম অব্যবস্থাপনা রোধ করা গেলে খাতটিকে লোকসানি থেকে সাশ্রয়ী করে তোলা যাবে।

ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক . শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, দুর্নীতি অব্যবস্থাপনা রোধ করে বিদ্যুৎ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। এটি না করে পাইকারি দাম বাড়িয়ে বাড়তি হাজার কোটি টাকা তোলা হচ্ছে। এভাবে ভোক্তার পকেট থেকে টাকা নিয়ে মুনাফা করছে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো। নানা আইন করে ভোক্তার কথা বলার সুযোগ না রেখে খাতে অস্থিরতা আরো বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে।

বৈশ্বিক সংকট বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে সরকারের সাফল্যকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছে বলে মনে করছে বিদ্যুতের নীতি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেল। সংস্থাটির ভাষ্য অনুযায়ী, শতভাগ বিদ্যুতায়নে গ্রাহক যখন বড় আকারে আস্থা পেয়েছিল, ঠিক সেই সময় বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি উত্তাপ চ্যালেঞ্জে ফেলেছে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সরকারের বড় সাফল্য। বৈশ্বিক মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত, জ্বালানি উত্তাপ, ডলার রিজার্ভ সংকট চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। তবে এটিকে মোকাবেলা করে কীভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় সেই পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। গ্রাহকের বিদ্যুেসবা নিশ্চিত করতে সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন