গণিত ও ইংরেজি শিক্ষকের ৮০ শতাংশই ভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রিধারী

সাইফ সুজন

চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে উচ্চশিক্ষাসব ক্ষেত্রেই ইংরেজিতে দক্ষতা জরুরি। আর বিশ্বের সব শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় গণিত শিক্ষাকে। যদিও দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই তাদের বিদ্যালয়জীবন শেষ করছে দুটি বিষয়ে দুর্বলতা নিয়ে। গণিত ইংরেজি বিষয়ে দক্ষ প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকাকেই এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বলছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে গণিত ইংরেজি বিষয়ে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের ৮০ শতাংশেরই নেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।

দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতি বছরই বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস শীর্ষক প্রতিবেদন প্রণয়ন করে আসছে ব্যানবেইস। প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত সর্বশেষ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন ৯৬ হাজার ৫৮ জন। এর মধ্যে কেবল হাজার ২৪১ জন শিক্ষক ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রিধারী। আর বিষয়ে স্নাতকোত্তর ছিলেন হাজার ৪১ শিক্ষক। সে হিসাবে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের ৮৪ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ডিগ্রি নেই।

অভিন্ন চিত্র দেখা যায় গণিতের ক্ষেত্রেও। ব্যানবেইসের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর দেশের সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় গণিতের শিক্ষক ছিলেন সর্বমোট ৬৭ হাজার ৯৫৫ জন। যদিও এর মধ্যে মাত্র হাজার ৮৪৩ জন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক হাজার ২৮৫ শিক্ষক গণিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। সে হিসাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে ডিগ্রি রয়েছে কেবল ১৯ শতাংশ শিক্ষকের। বাকি ৮১ শতাংশই অন্য বিষয়ে ডিগ্রিধারী।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, যেসব শিক্ষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি নেই, তাদের দিয়ে পাঠদানে কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জন সম্ভব নয়। তাদের মতে, শুধু গণিত কিংবা ইংরেজি নয়, বিজ্ঞানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ডিগ্রিধারীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া জরুরি। প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, সম্প্রতি আমার অধীনে একজন এমফিল শিক্ষার্থী ধরনের একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তাতে আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, গণিত ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের পাঠদান শিক্ষার্থীদের শিখনফলের ভিন্নতা বিশ্লেষণ করেছি। সেখানে দেখা গেছে, যারা গণিতের গ্র্যাজুয়েট তাদের শিক্ষার্থীরা গণিত ভালো শিখছে, আর যারা বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট তাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে ভালো করছে। অন্যদিকে যিনি ম্যানেজমেন্টে পড়ে এসে গণিতে পাঠদান করছেন, তার শিক্ষার্থীদের বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের হার ছিল সবচেয়ে কম। যেহেতু ভিন্ন বিষয়ে গ্র্যাজুয়েটরা প্রাথমিকের গণিত কিংবা বিজ্ঞান কাঙ্ক্ষিত মানে পড়াতে পারছেন না, মাধ্যমিকে তো সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

অধ্যাপক হাফিজুর আরো বলেন, দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ দেয়া হলেও এর আগের অনেক শিক্ষক এখনো পাঠদানে নিয়োজিত, যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ। এসব জায়গায় সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি সঠিক পরিকল্পনা করে সেগুলোর বাস্তবায়ন করা উচিত।

বিষয়ভিত্তিক ডিগ্রিধারী শিক্ষকের দিক থেকে বেসরকারির তুলনায় অবশ্য সরকারি বিদ্যালয়গুলোর চিত্র ভালো। সরকারি বিদ্যালয়ে হাজার ৫০৬ ইংরেজি শিক্ষকের মধ্যে হাজার ৪৬৩ জনেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে, শতকরা যা ৩০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিদ্যালয়ে ৯১ হাজার ৫৫২ ইংরেজি শিক্ষকের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক ডিগ্রি রয়েছে ১৩ হাজার ৮১৯ জনের বা ১৫ দশমিক শূন্য শতাংশের। আর গণিতের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সরকারি বিদ্যালয়ে হাজার ৬০২ শিক্ষকের মধ্যে হাজার ২৫৪ জন বা ৩৪ দশমিক ৮১ ভাগের বিষয়ভিত্তিক স্নাতক স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। যদিও বেসরকারির ক্ষেত্রে সেই হার ১৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৬৪ হাজার ৩৫৩ শিক্ষকের মধ্যে গণিতের ডিগ্রি রয়েছে কেবল ১১ হাজার ৮৭৪ জনের।

এদিকে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও বেশ পিছিয়ে রয়েছেন গণিত ইংরেজির শিক্ষকরা। ২০১৯ সালে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার নানা দিক নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান। এর ফলাফলের ভিত্তিতে সেকেন্ডারি স্কুল টিচারস ইন বাংলাদেশ: ইন দ্য লাইট অব এসডিজি ফোর শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। তাতে উঠে আসে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় গণিত ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে নিয়োজিত ৫৫ শতাংশ শিক্ষকেরই বিষয়ভিত্তিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই।

জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, শিক্ষার মানের কথা বলতে গেলে সবার আগে যে বিষয়টি আসে, সেটি হলো শিক্ষকের যোগ্যতা। কারণ দক্ষ প্রশিক্ষিত শিক্ষক ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অথচ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার বিষয়টিই বেশ অবহেলিত। আর যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক না পাওয়ার অন্যতম কারণ আমরা তাদের আকৃষ্ট করতে পারছি না। বিভিন্ন খাতে যত বড় উন্নয়নই হোক না কেন, শিক্ষাকে অবহেলায় রেখে তা কখনই টেকসই হবে না। তাই আমার মতে, শিক্ষায় বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে হলেও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।

শিক্ষকদের যোগ্যতাগত ঘাটতির প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের শিখনফলে। সরকারের বিভিন্ন গবেষণায়ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ইংরেজি গণিত বিষয়ে দক্ষতাগত দুর্বলতার চিত্র উঠে আসে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তদারক মূল্যায়ন বিভাগ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের দক্ষতাবিষয়ক একটি গবেষণা পরিচালনা করে। ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস-২০১৯ শীর্ষক প্রতিবেদনটি যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি মাউশি। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাধ্যমিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এখনো ইংরেজি গণিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে। এর মধ্যে ইংরেজিতে বেশি খারাপ। ষষ্ঠ শ্রেণীর প্রায় ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে অবস্থা খুবই খারাপ, ৩২ শতাংশ খারাপ বা গড়পড়তা স্তরে আছে। দুই স্তর মেলালে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থাই খারাপ বলা যায়। মোটামুটি ভালো স্তরে আছে ১৮ শতাংশের মতো। বাকি শিক্ষার্থীরা ভালো খুবই ভালো স্তরে আছে। অষ্টম শ্রেণীতে ইংরেজিতে  ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যান্ড- স্তরে আছে। ২৮ শতাংশ মোটামুটি ভালো। শ্রেণীতে চার ভাগের প্রায় এক ভাগ খুবই ভালো করেছে। বিষয়ে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক ভালো। সাড়ে ১২ শতাংশ খারাপ স্তরে। বাকিরা মোটামুটি ভালো, ভালো খুবই ভালো।

গণিতে ষষ্ঠ শ্রেণীর প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী খারাপ। এর মধ্যে ১৩ শতাংশের অবস্থা খুবই খারাপ। মোটামুটি ভালো অবস্থানে আছে তিন ভাগের এক ভাগ শিক্ষার্থী। খুবই ভালো স্তরে আছে কেবল শতাংশ। অষ্টম শ্রেণীতে গণিত বিষয়ে ২২ শতাংশ খারাপ অবস্থায় এবং মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছে ৩৬ শতাংশ। বাকিরা ভালো খুবই ভালো। দশম শ্রেণীতে প্রায় শতাংশের মতো শিক্ষার্থীর অবস্থা খারাপ। শ্রেণীতে খুবই খারাপ শিক্ষার্থী প্রায় নেই বললেই চলে। ভালো অবস্থায় আছে প্রায় ৩৮ শতাংশ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন