প্রাইম ব্যাংক

ইমাম গ্রুপের শতকোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে অনীহা!

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

ব্যাংক ঋণ দিয়েছে এক যুগেরও আগে। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করায় গ্রাহক খেলাপি হওয়ারও পেরিয়েছে এক দশক। মামলা করার পর আদালতের রায় পায় ব্যাংক। বন্ধক থাকা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ব্যাংককে ঋণ আদায়ের সুযোগও দিয়েছেন আদালত। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী একজন ম্যাজিস্ট্রেট ৮২ জন পুলিশ সদস্য নির্দিষ্ট দিনে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকের কোনো প্রতিনিধি খেলাপি গ্রাহকের সম্পত্তি দখল নিতে আসেননি। বন্ধকি সম্পত্তি হিসেবে গ্রাহকের বহুতল শপিং মলটি দখলে নিতে না পারায় খেলাপি ঋণের অর্থ সমন্বয়ের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে ব্যাংকের।

দেশের অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি চট্টগ্রামভিত্তিক ইমাম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ আলী। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ব্যাংক মিলিয়ে ইমাম গ্রুপের কাছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। ঋণ পরিশোধ না করে মোহাম্মদ আলী বর্তমানে বিদেশে পলাতক। মোহাম্মদ আলীর সন্তানদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়েও আদালত সতর্ক করেছেন সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে। ইমাম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কাছ থেকে প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের জুবিলী রোড শাখার শতকোটি টাকা খেলাপি ঋণের অর্থ আদায়ে বন্ধকি সম্পত্তির দখল নিতে না পারার ঘটনাটি ঘটেছে।

ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতে দেশের খেলাপি গ্রাহকদের বড় একটি অংশের অবস্থান চট্টগ্রামে। এরই মধ্যে আদালত গ্রাহকের বন্ধক দেয়া বাণিজ্যিক স্থাপনা থেকে আয়ের সুযোগ দিলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অজানা কারণে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আদালতকে সহায়তা করছে না। খেলাপি গ্রাহকের সঙ্গে সুসম্পর্ক কিংবা ঋণ আদায়ে অবহেলার কারণে প্রাইম ব্যাংকের প্রায় ১০০ কোটি টাকা আদায় নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রাইম ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখা ব্যবস্থাপক সিরাজুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, খেলাপি ঋণের টাকা আদায়, মামলা পরিচালনা, বন্ধকি সম্পত্তি দখল নিলাম-সংক্রান্ত বিষয়গুলো ব্যাংকের স্পেশাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগ (এসএএমডি) দেখাশোনা করে। বিষয়ে অন্য কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি তিনি।

যোগাযোগ করা হলে প্রাইম ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের এসএএমডি বিভাগও বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি। তবে নাম প্রকাশ না করে ওই বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ইমাম গ্রুপের যে সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে বন্ধক ছিল সেটি বর্তমানে বহুতল বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে। আদালতের নির্দেশনার সঙ্গে -সংক্রান্ত তথ্যের অসংগতির কারণে নির্ধারিত দিনে ব্যাংকের পক্ষ থেকে কেউ ওই সম্পত্তি ক্রোক করতে যাননি। তবে আদালতের কারণ দর্শানোর নোটিসের পর বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে খেলাপি গ্রাহকের বন্ধকি সম্পত্তি ব্যাংক ক্রোক করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

চট্টগ্রামের অর্থঋণ মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, আদালত বন্ধকি সম্পত্তি ক্রোক করার জন্য নির্দেশনা দেয়ার পর ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা নাজির, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট, ব্যাংকের আইনজীবী প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম সময় নির্ধারণ করে। ফলে নির্ধারিত দিনে ব্যাংকের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকা কিংবা তথ্যটি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানবে না, এটা নিতান্তই অবান্তর। নিশ্চিতভাবেই অজানা কোনো কারণে খেলাপি গ্রাহকের ওই সম্পত্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের অনীহা রয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যে যুক্তিই দিক না কেন, এক্ষেত্রে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা চট্টগ্রাম জজ কোর্টের এক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, একটি ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ের কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পেয়েও সেটি গ্রহণ না করা অর্থঋণ আদালতের ইতিহাসে নজিরবিহীন। প্রাইম ব্যাংকের কর্মকাণ্ড ব্যাংকের যোগসাজশে হয়েছে।

আদালতের তথ্যমতে, ইমাম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে প্রাইম ব্যাংক চট্টগ্রাম জুবিলী রোড শাখার ৬৩ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে আছে। অর্থ আদায়ে ২০১৬ সালে অর্থঋণ মামলা করে ব্যাংক। ২০১৭ সালে অর্থঋণ মামলার রায়ের পর প্রতিষ্ঠানটির বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তুললেও কোনো দরদাতা পাওয়া যায়নি। বর্তমানে খেলাপি অর্থের পরিমাণ শতকোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

বাদী আদালতের নিলাম আদেশকে চ্যালেঞ্জ করলে হাইকোর্ট ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে প্রথম কিস্তি বাবদ কোটি টাকাসহ ডিক্রিদারের যাবতীয় পাওনা ৩৬টি কিস্তিতে পরিশোধের জন্য গ্রাহককে নির্দেশ দেন। কিন্তু গ্রাহক আদেশ পালনে ব্যর্থ হলে নন কমপ্লায়েন্স অব দ্য কোর্ট অর্ডার বিবেচনায় ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রিট পিটিশনটি (নং-১৮৬৪৬/২০১৭) খারিজ হয়। দায়িকপক্ষ ওই আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে সুপ্রিম কোর্টে আপিল (সিএমপি নম্বর-২১১/২০১৮) করে। আপিল বিভাগ মামলার ওপর কোনো স্থগিতাদেশ না দেয়ায় ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর তফসিলভুক্ত সম্পত্তির মালিকানা স্বত্ব অর্থঋণ আইনের ৩৩() ধারা অনুযায়ী পাওনাদার ব্যাংক বরাবর ন্যস্ত করেন।

ব্যাংক মালিকানাপ্রাপ্ত সম্পত্তির দখল পাওয়ার আবেদন করলে ডিক্রিদার বরাবর তফসিলকৃত সম্পত্তির দখল ন্যস্ত করতে দেওয়ানি পরোয়ানা ইস্যু করে। চলতি বছরের ১৯ মার্চ পুলিশ বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া দখল পরোয়ানা জারি করা সম্ভব নয় মর্মে বিনা তামিলে ফেরত আসে। এমনকি তফসিলোক্ত সম্পত্তিগুলো ভিন্ন ভিন্ন মৌজায় অবস্থিত হওয়ায় মৌজাওয়ারি দখলের নির্দেশ দেয়া হয়। ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দখলে সহযোগিতা করতে মার্চ জেলা প্রশাসন থেকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ৮২ সদস্য আদালতের আদেশ মোতাবেক প্রস্তুত থাকলেও ব্যাংকের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না।

আদালত সূত্র জানিয়েছে, আদালতের কাছে আবেদন করে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছ থেকে সময় নিয়ে সম্পত্তি ক্রোক করার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় ব্যাংকের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত হননি। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ের সুযোগটি নষ্ট হয়েছে।

আদালতের -সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, নং তফসিলভুক্ত সম্পত্তি আলী প্লাজা চট্টগ্রাম নগরে অবস্থিত একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। এটির বর্তমান আইনগত মালিক প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংক মামলা করার ১০ বছর অতিক্রান্ত হলেও ডিক্রীকৃত অর্থের কানাকড়িও আদায় করতে পারেনি। বর্তমানে মোহাম্মদ আলীর কাছে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১০০ কোটি টাকা। অবস্থায় মালিকানাপ্রাপ্ত সম্পত্তির দখল নিতে ডিক্রিদার ব্যাংকের অনুপস্থিত থাকা চরম দায়িত্বহীন আচরণ। ট্রাস্টি অব পাবলিক মানি হিসেবে নাগরিকদের আমানতের অর্থ আদায়ে ডিক্রিদার ব্যাংক যে চরম উদাসীনতা দেখিয়েছে তা অগ্রহণযোগ্য। আদালতের আদেশে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গৃহীত কর্মসূচিতে বিনা নোটিসে অনুপস্থিতি অসদাচরণ আদালতের আদেশ লঙ্ঘনের শামিল।

আদালতের নির্দেশ পালন না করায় ডিক্রিদার প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবর আদেশের কপি কেন পাঠানো হবে না তা আদালতে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে সেপ্টেম্বর প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের হেড অব রিকভারি অ্যান্ড লিগ্যাল ডিভিশন জুবিলী রোড শাখার ব্যবস্থাপককে নির্দেশ দেয়া হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সম্পত্তি দখলের বিষয়ে যথাসময়ে তথ্য দেননি বলে ব্যাখ্যা দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সাম্প্রতিক সময়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের মামলা পরিচালনার জন্য নতুন প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে ব্যাংক। আদালতের কাছে আবারো বন্ধকি সম্পত্তি ক্রোক করার আগ্রহ জানিয়েছে তারা।

খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ইমাম ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে বেশির ভাগ মামলা হয় ২০১২-১৩ সালে। অর্থঋণ নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট (এনআই) অ্যাক্ট মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৬০টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রুপটির কাছে ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৭৯৩ কোটি টাকা পাওনার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে মোট ৫৫টি মামলায় মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান আনিকা এন্টারপ্রাইজের কাছে ১৩৭ কোটি টাকা পাওনা কৃষি ব্যাংকের। কৃষি প্রকল্পে বিনিয়োগের নামে ঋণ নেয়া হয়। পাওনা আদায়ে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্থঋণ মামলা করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। মামলাটি বর্তমানে অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন। ইমাম গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান মেসার্স রোমানা এন্টারপ্রাইজের কাছে ব্যাংক এশিয়ার পাওনার পরিমাণ ৩৪ কোটি টাকা। ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত নেই ব্যাংকের কাছে। বিভিন্ন সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য নেয়া ঋণ ফেরত দেয়া হয়নি গত দেড় দশকেও।

ব্যাংকের দায়ের করা দুটি চেক ডিজঅনার মামলায় গত বছরের ডিসেম্বর আদালত এক বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন মোহাম্মদ আলীকে। তার বিরুদ্ধে ২০১২ সালে অর্থঋণ আদালতে করা মামলাটির বিচারকাজ উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে। ইমাম গ্রুপের কাছে উত্তরা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার পাওনা ৬১ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংকের ৬৫ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের ৬১ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের ১০০ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ১৯ কোটি, যমুনা ব্যাংকের ১০ কোটি, ন্যাশনাল হাউজিংয়ের কোটি, ঢাকা ব্যাংকের কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংকের কোটি, ইউসিবিএলের কোটি অগ্রণী ব্যাংকের দেড় কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এছাড়া বিআইএফসি, ফার্স্ট লিজিংয়ের বড় অংকের খেলাপি ঋণ বকেয়া আছে বলে জানা গিয়েছে। এসব পাওনার বিপরীতে প্রায় সব পাওনাদার ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্থঋণ মামলা করেছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের বিরুদ্ধে ২০টিরও বেশি চেক ডিজঅনার মামলা রয়েছে। এসব মামলায় মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। যদিও ২০১৯ সালের শেষ দিকে কভিড-পূর্ববর্তী সময়ে দেশত্যাগ করে বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন গ্রুপটির কর্ণধার মোহাম্মদ আলী।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন