টেকসই উন্নয়ন

বেড়ে চলা খরার ঝুঁকি মোকাবেলায় করণীয়

ইব্রাহিম থিয়াও

বিশ্বে খরা পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। কোনো অঞ্চল বা দেশই এর বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। দক্ষিণ ইউরোপ এখন তীব্র খরার মুখে। ইতালিতে চলছে ৭০ বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ খরা। গবেষণার তথ্য বলছে, পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্র হাজার ২০০ বছরের মধ্যে গত দুই দশক ছিল সবচেয়ে শুষ্ক। বর্তমানে চিলি ধারাবাহিকভাবে চলা খরার ১৩তম বছরে পর্দাপণ করেছে এবং মেক্সিকোর তৃতীয় বৃহত্তম শহর মন্টেরি এখন পানির বরাদ্দ নিয়ন্ত্রণে (ওয়াটার রেশনিং) করতে বাধ্য হচ্ছে।

আফ্রিকার শিং বলে খ্যাত ইথিওপিয়া, কেনিয়া সোমালিয়া বৃষ্টিহীন ধারাবাহিক চতুর্থ বছরের রেকর্ড করছে। সেসব দেশে পরিস্থিতি ক্রমে মানুষ, গবাদিপশু এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্য বিপত্সংকুল হয়ে উঠছে। ভুগছে প্রতিবেশ শৃঙ্খলের প্রতিটি জীব-অণুজীব।

ভোগান্তি মৌরিতানিয়ায় আমার প্রথম মুখোমুখি হওয়া খরার ভীতিকর স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।  বয়স তখন সবে ১২ বছর, যখন আমার জনগোষ্ঠীর প্রতিটি পরিবার সর্বস্ব হারিয়েছিল। আমাদের খাদ্য, গবাদিপশু, জীবিকা সবকিছু নিঃস্ব হয়েছিল। পরিবারের খাদ্য জোগাতে না পেরে আমাদের অভিভাবকের অনেকেই নিজের প্রাণসংহার করেছিল। দুঃসহ অভিজ্ঞতা সবসময় আমার সঙ্গে থেকেছে। সেজন্য ছোট বয়সে আমার জীবন যেভাবে পার হয়েছে তেমনটা যেন আর কোনো শিশুর জীবন না হয়, তা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি। নানা উদ্যোগ নিতে প্রণোদিত হচ্ছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো অনেক শিশু খরায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ভীতসন্ত্রস্ত হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে আরো অনেকেই হবে। বিজ্ঞানীরা প্রক্ষেপণ করছেন, জলবায়ু পরিবর্তন খরার পৌনঃপুনিকতা, স্থায়িত্ব ভৌগোলিক বিস্তার আরো বাড়াবে। প্রাক্কলন করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ চারজনের মধ্যে তিনজনই খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

সব অঞ্চলের এলাকা ক্রমেই শুষ্ক হয়ে উঠছে। ঠিক কোন জায়গাগুলোয় সবচেয়ে তীব্র খরা পরিস্থিতি আবির্ভূত হবে তা নিয়ে এখনো ঐকমত্য না থাকলেও বিজ্ঞানীরা সম্মত, ভূমি বিপর্যয় সমস্যাটি বাড়িয়ে তুলবে। শুধু তা- নয়, এর চেয়েও খারাপ পরিণতি অপেক্ষা করছে। জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃসরকারি প্যানেল সতর্ক করছে, গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে এবং সামনের আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি বদলের ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট অগ্রগতি করছি না।  

সাম্প্রতিক ভীতিপ্রদ অভিজ্ঞতা এবং সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক প্রক্ষেপণ উভয়ই ভবিষ্যৎ খরার ঝুঁকির বিরুদ্ধে স্থায়িত্বশীলতা গড়ে তোলার জন্য প্রত্যেকের মধ্যে একটা জরুরতের বোধ জাগার বার্তা দেবে। খরা একটা প্রাকৃতিক ঘটনা, কিন্তু এটিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতে দেয়া যাবে না। ভূমি পানি ব্যবহারের অধিকতর ভালো সিদ্ধান্ত এবং ভূমি পুনরুদ্ধার উদ্যোগগুলো অন্তত ভূমি বিপর্যয় আংশিকভাবে কমাতে পারে।

জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থা এবং ইউএন কনভেনশন টু কমব্যাট ডেজার্টিফিকেশনের  (ইউএনসিসিডি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন নাজুক জনগোষ্ঠীর মধ্যে খরার ঝুঁকি কমিয়েছে, এমন কিছু সফল ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত চিহ্নিত করেছে। ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, ভারত তিউনিসিয়ায় খরার বিরূপ প্রভাব কমাতে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং এবং টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার কিছু ব্যবস্থা চর্চিত হচ্ছে।  কিছুটা সময় লাগলেও সব দেশই খরাপ্রবণ এলাকা থেকে পানি নিরাপত্তার এলাকায় মানুষকে স্থানান্তরে সাহায্য করতে একই ধরনের কৌশল গ্রহণ করতে পারে।

অবশ্য বর্তমান অ্যাপ্রোচের বড় সীমাবদ্ধতা হলো, এটা জাতীয় ব্যবস্থার ভিত্তিতে প্রণীত, যদিও খরা কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সীমানা দেখে না। তাই আন্তঃদেশগুলোর মধ্যকার বিভিন্ন খাতে সক্রিয় পরিকল্পনা আবশ্যক; কিন্তু আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া খরার প্রভাব অন্য দেশগুলোয় পড়াটা রোধ করা যাবে না। সাধারণ তাত্ক্ষণিক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে নিঃশেষিত পানিসম্পদ ঘিরে সংঘাত, খাদ্যের উচ্চমূল্য বা ঘাটতি, বনে দাবানাল, ব্যাপক বন উজাড় গবাদিপশুর ক্ষতি, বালি ধূলিঝড়, মানুষের বাস্তুচ্যুতি, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অভিবাসনে বাধ্য হওয়া এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।   

খরা অনুমান করা এবং এটা মোকাবেলায় দ্রুত সাড়া প্রদানে সম্মিলিত ব্যবস্থা উল্লেখিত পরিণতির মাত্রা কমাতে পারে কিংবা বদলাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ অস্ট্রেলিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খরাদুর্গত মানুষ যাতে এর প্রভাব কমাতে পারে এবং মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে, সেজন্য অনেক আগেই নীতি পরিকল্পনা প্রটোকল প্রণয়ন করেছে।

বিশ্বব্যাপী ধরনের স্থায়িত্বশীলতা গড়ে তুলতে সময় রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। সৌভাগ্যক্রমে নীতিনির্ধারকরা একটা ভিত্তি তৈরি করেছে যে তারা স্থায়িত্বশীলতা গড়ে তুলতে পারে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আফ্রিকার সাহেলের একটা আঞ্চলিক খরা ঝুঁকি ব্যবস্থা আছে। উৎপাদক সংঘ থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকারীসহ বিভিন্ন ধরনের অংশীজনকে এক জায়গায় আনতে এটা তৈরি করা হয়েছিল। আঞ্চলিক পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এটা বেশ কাজে লাগছে। এর সুফল পাচ্ছে মানুষ।

এমনকি ভারত আরো সমন্বিত ব্যাপকভিত্তিক কৌশল গ্রহণ করেছে। তারা জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খরা ব্যবস্থাপনাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটা এমন জটিল কৌশল, যা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ জাতীয়, রাজ্য স্থানীয় পর্যায়ের সুচারু সমন্বয় নিশ্চিত করে। ১৫ বছর আগে শুরু হওয়া প্রক্রিয়ার পর ভারতের এখন একটি সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা সিস্টেমও রয়েছে। এটিও খরা সতর্কীকরণ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে থাকে।

গত জুনে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে, এখন থেকে খরা দেশটির কৌশলগত অভ্যন্তরীণ পররাষ্ট্রনীতির প্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হবে। সবচেয়ে সূক্ষ্ম অত্যাধুনিক খরা তদারকি এবং রেসপন্স মেকানিজমের আঁতুড়ঘর হিসেবে দেশটি বিশ্বব্যাপী অধিকতর ভালো ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি উন্নয়নে সাহায্য করতে পারে।  

ঘন ঘন এবং ভয়াবহ খরার প্রভাব বেসামাল হওয়ার আগেই দ্রুত কাজ করার ব্যাপারে বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোর মধ্যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। গত মে মাসে অনুষ্ঠিত ইউএনসিসিডির শীর্ষ সম্মেলনে খরার ওপর কাজ করতে একটা আন্তঃসরকারি ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরির মাধ্যমে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সামষ্টিক পদক্ষেপ সংহতকরণের এখন একটা বৈশ্বিক প্লাটফর্ম আমরা পেয়েছি।

এখন আমরা একযোগে খরার প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তবে কার্যকর স্থায়িত্বশীলতা গড়ে তুলতে যা প্রয়োজন তা করার জন্য কমিউনিটি থেকে জাতীয় সব পর্যায়ের নেতাদের দৃঢ় অঙ্গীকার করতে হবে এবং দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে। নইলে খরার ঝুঁকি মোকাবেলা আমাদের জন্য অনেক কঠিন হবে।

[স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

 

ইব্রাহিম থিয়াও: ইউএন কনভেনশন টু ডেজার্টিফিকেশনের নির্বাহী সচিব

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন