অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

ন্যূনতম অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় নয়

উচ্চশিক্ষার চাহিদা বিবেচনায় রেখে সরকার দেশব্যাপী বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলছে কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিজস্ব অবকাঠামো নেই। ভাড়া ভবন বা বিকল্প স্থানে এগুলো প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এমনকি অবকাঠামোগত কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই অধিকাংশ নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেগুলো আবার শিক্ষা কার্যক্রমও শুরু করেছে। গতকাল বণিক বার্তায় এমন কয়েকটি নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শিক্ষক নিয়োগ অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়াই এসব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা গুণগত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতের বড় প্রতিবন্ধক। বিদ্যমান বাস্তবতায় ন্যূনতম অবকাঠামো, পর্যাপ্ত শিক্ষক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা প্রত্যাশিত নয়। প্রত্যাশা থাকবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা চালুর আগে বিষয়গুলো নিশ্চিত করবে।

দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত এবং বিশ্বমানের শিক্ষা গবেষণার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান হতে হয় বিশ্বমানের, যাদের কর্মক্ষেত্র থাকে বিশ্বব্যাপী। তাই স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় না এনে দরকার বিশ্বমানের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। হতাশাজনক হলেও সত্য, আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ভারত, মালয়েশিয়া চীনের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তালিকার ওপরের দিকে স্থান করে নিতে পারলেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই স্থান পায়নি। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়, পর্যাপ্ত মানসম্মত আধুনিক শিক্ষা গবেষণার অভাব এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতাকে। তাই শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় বা জেলায় জেলায় নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় না খুলে চলমানগুলোর আরো অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোই সমীচীন। কাজে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে সরকারকেই। আর এরই অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক উচ্চশিক্ষা গুণ-মান বর্ধন প্রকল্প শিরোনামে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার মানোন্নয়নে তোড়জোড় চলছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তবে সেখানেও যথাযথ নিরীক্ষণ মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত না করেই অর্থ আয়ের দিকে ঝুঁকছে। শিক্ষকের সংকট, মানসম্পন্ন উপকরণের অভাব প্রভৃতি মিলে উচ্চশিক্ষাকে আরো নিচের দিকে নিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এখান থেকে উত্তরণে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ বা গবেষণার জন্য ন্যূনতম যন্ত্রপাতি/সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে ইউজিসি নতুন নতুন বিষয়/ডিগ্রির জন্য আলাদা বরাদ্দ দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সরকারি অনুদানের মাধ্যমে এগুলোকে আরো যুগোপযোগী করার যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারে। এসবের মাধ্যমেই হয়তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যথাযথ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।

চীনে সমাজতান্ত্রিক দল ক্ষমতায় আসার পর দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছিল। কারণ, তারা হিসাব করে দেখেছিল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থান করা আসলেই বড় কঠিন কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের চেয়ে তারা কারিগরি শিক্ষার প্রতি জোর দেয়। কারিগরি প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই কাজ করেছেন। চীন কারিগরি প্রকৌশল বিদ্যায় কতটা এগিয়েছে সেটি সবাই দেখতে পাচ্ছে। আগে ইউরোপসহ পার্শ্ববর্তী দেশে প্রচুর শিক্ষার্থী যেত, এখন সেই হার অনেকটা কমে গেছে। বেঁচে যাচ্ছে অনেক রাষ্ট্রীয় অর্থ। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে ভালোমানের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা গেলে সেটি হবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি হাতিয়ার। এজন্য প্রয়োজন সুস্থ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। কোচিং সেন্টার ধরনের যেসব বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেগুলোকে একত্র করে মানসম্পন্ন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা, উপদেশ উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশে আবাদি জমির যে সংকট, তার ওপর নিত্যনতুন আবাসন, কলকারখানা, বাজার, শহর, অফিস-আদালত হচ্ছে যার অধিকাংশই অপরিকল্পিত। জনসংখ্যা বাড়ছে অথচ আবাদি জমি কমছে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার আগে এসব বিষয়ও বিবেচনায় রাখতে হবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন বা চালু করতে গেলে ন্যূনতম কী কী সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন তার একটি সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রণয়ন করা জরুরি। অবকাঠামো থেকে শুরু করে শিক্ষক-কর্মকর্তা-শিক্ষার্থী অনুপাত কত হবে, তারও একটি নিয়ম তৈরি করা প্রয়োজন। সেটি পূরণ ব্যতীত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন বা চালু করা উচিত নয়।

গত এক দশকে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গিয়েছে, আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেটিকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা। অথচ একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় ন্যূনতম কিছু বিষয়ের দিকে দৃষ্টি না দিলে উচ্চশিক্ষার মূল ধারণাটাই ব্যাহত হতে পারে। বাংলাদেশে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে যত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীকে সম্ভব উচ্চশিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা। উচ্চশিক্ষাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি ব্যাচ ভর্তি হবে এবং তারপর সামনের বছর আরেকটি ফ্লোর বাড়ানো হবে, আরেকটি রুম বাড়ানো হবেএমন জোড়াতালি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এগোতে থাকে। একটি বিষয় পরিষ্কার, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার সুবিধা বাড়ানোর পথে প্রধান অন্তরায় অর্থ। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় টাকার জোগান দিতে সরকার যে হিমশিম খাচ্ছে সেটিও অজানা নয়। সেজন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরকারের বরাদ্দ আরো বাড়ানো দরকার। গবেষণা জোরদারের মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আয়ও করতে পারে। সম্পদ অবকাঠামোও সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে আয় করা সম্ভব।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব ক্যাম্পাস নির্মাণে জোর তাগাদা দিয়ে আসছে। শুধু তা- নয়, সেখানে কী কী সুবিধা থাকা আবশ্যক, তাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে। কোথায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হবে, তারও অনুমতি নিতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ ছাড়া বিভাগ খোলার অনুমতি পর্যন্ত মিলছে না। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেকে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেয়ালের উল্টো পিঠে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরই নিজস্ব ভবন জমি নেই, ভাড়া করা ভবনে চলছে পাঠদান। শিক্ষার্থীদের বসার পর্যাপ্ত স্থান না থাকায় ক্লাস পর্যন্ত বিঘ্নিত হচ্ছে। এখন তো আবার জানা যাচ্ছে, এমন বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে যেখানে কোনো শিক্ষকই নিয়োগ দেয়া হয়নি। এটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভঙ্গুর দশাকেই তুলে ধরে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলে তার জন্য এক রকম নিয়ম আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলে তার জন্য ভিন্ন নিয়ম, এটি কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রবণতা কমে এলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চালু হচ্ছে দেদার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চালুতে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার জন্য অবকাঠামো নিশ্চিত না করা। অধিকাংশ নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যূনতম অবকাঠামো, শিক্ষক, কর্মকর্তা, পাঠাগার সুযোগ-সুবিধাই নেই। ফলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে।

পাবলিক হোক কিংবা প্রাইভেট কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অবকাঠামো তৈরির আগে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর কোনো সুযোগ নেই। গ্রন্থাগার ল্যাবরেটরির মতো মৌলিক সুবিধা ছাড়া উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কথা ভাবাও যায় না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগেই কয়েকটা ব্যাচ গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। অথচ তারা উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম সুবিধাও পায়নি। উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম পরিবেশ গড়ে তোলার আগে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেই কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়া উচিত নয়। সরকারের উচিত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নীতি প্রণয়ন করে তার যথাযথ বাস্তবায়ন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিলেই তো হবে না, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় যথেষ্ট দক্ষ জনশক্তি আছে কিনা, তারা মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারবেন কিনা, তাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

অপরিকল্পিত উন্নয়ন যেমন অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর, ঠিক তেমনি অপরিকল্পিত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনও উচ্চশিক্ষার জন্য ক্ষতিকর। কারণ মানসম্পন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ব্যতিরেকে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণে সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকবে রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, অর্থনীতির সঙ্গে মিল রেখে পরিকল্পিত প্রক্রিয়ায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হবে। উচ্চশিক্ষার জন্য ন্যূনতম অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন