বাংলা গানেরও জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ!

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ

হুমায়ূন আহমেদ: ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২

হুমায়ূন আহমেদকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের জাদুকর। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সুখ, দুঃখ স্বপ্ন তার কলমে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। যে কারণে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো দেশের সব শ্রেণীর মানুষ আপন করে নিয়েছে। সাহিত্য ছাড়াও নাটক চলচ্চিত্রে হুমায়ূন আহমেদ যোগ করেছেন ভিন্ন মাত্রা। বহুমাত্রিক প্রতিভাধর লেখক শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গসহ সারা বিশ্বের বাংলাভাষী মানুষের কাছে পেয়েছেন প্রবাদপ্রতিম জনপ্রিয়তা। লেখকের জন্ম মৃত্যুদিনে তার গল্প, উপন্যাস, নাটক চলচ্চিত্র নিয়ে বিস্তর আলোচনায় মেতে ওঠে সর্বস্তরের গণমাধ্যম। খুব বেশি আলোচনা হয় না তার লেখা গান নিয়ে। যেন লেখক, পরিচালক পরিচয়ের নিচে চাপা পড়ে যায় হুমায়ূন আহমেদের গীতিকার পরিচয়। যদিও গীতিকার হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন না তিনি। হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়লেই বোঝা যায় অসম্ভব সংগীত অনুরাগী ছিলেন তিনি। তার গল্প, উপন্যাসে প্রায়ই দেখা যেত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হাছন রাজা, নজরুল ইসলামের গানসহ নানা লোকগান।

হুমায়ূন আহমেদ গান লিখেছেন কম। সাধারণত তার সিনেমা নাটকের জন্যই লিখেছেন। তার লেখা সব গান তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বই সিনেমার মতোই গানগুলোকে আপন করে নিয়েছে ভক্তরা।

যদি মন কাঁদে, চাঁদনী পসরে কে আমায় স্মরণ করে, একটা ছিল সোনার কন্যা, আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা, আমার উড়াল পঙ্খী রে ইত্যাদি গানগুলো এখনো সমান প্রাসঙ্গিক আবেদনময়ী।

কথাসাহিত্যিকের সিনেমায় একাধিক গান গেয়েছেন অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু। হুমায়ূন আহমেদের গান নিয়ে বাবু বণিক বার্তাকে বলেন, তিনি যেমন জনপ্রিয় সাহিত্যিক ছিলেন তেমনি জনপ্রিয় গীতিকারও। তার লেখায় সহজ-সরল বেদনা ফুটে উঠত। শ্রোতা খুব সহজেই নিজেকে খুঁজে পেত তার গানের কথায়। এজন্যই এখনো তার গান শ্রোতাদের এত পছন্দের। হুমায়ূন আহমেদের গান আমি এখনো গুনগুন করে গাই। তিনি শুধু বাংলা সাহিত্যের নন, বাংলা গানেরও জাদুকর।

হুমায়ূন আহমেদ তার দুই দুয়ারি সিনেমার জন্য একটা গান লিখেছিলেন। মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ শিরোনামের গানটি গেয়েছিলেন কণ্ঠশিল্পী আগুন। গানের স্মৃতিচারণ করে আগুন বলেন, অসাধারণ গানটির জন্য কোনো দিনক্ষণ কিংবা সময় ঠিক করা ছিল না। ২০০০ সালের দিকের কথা হবে এটি। শ্রুতি স্টুডিওতে গিয়ে দেখি হুমায়ূন চাচা বসে আছেন। তার সঙ্গে আমার সেদিনই প্রথম দেখা। তিনি আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, আগুন, তুমি আমার চলচ্চিত্রের জন্য একটা গান করবে। আমি জানি, তোমার কণ্ঠেই গানটি বেশ ভালো মানাবে। কারণ তোমার বাবাকে দেখেই আমরা শিখেছি। শুধু এটুকু বলার পরই উপস্থিত থাকা গানের সুরকার মকসুদ চাচা (মকসুদ জামিল মিন্টু) আমাকে গানটি দেখার জন্য বলেন। আমি সেদিন বলেছিলাম, চাচা, আমি পারব তো? তিনি আমাকে বলেছিলেন, তোমার যেমন করে গাইতে ইচ্ছে করে, তেমন করেই গাও। আমি কোনো কিছু না ভেবেই গানটি নিজের কণ্ঠে কিছুক্ষণের মধ্যেই তুলে ফেলি। এরপর যখন গানটির রেকর্ডিং সম্পন্ন হয় তখন হুমায়ূন চাচা আমাকে বলেছিলেন, আমি বলেছিলাম না, তোমার থেকে ভালো গান আর কারো কণ্ঠে মানাবে না। এবার তুমি গানটি একটু সময় নিয়ে শুনে দেখো। গানের রেকর্ডিং করার ঘটনাটি আজও আমার মনে পড়ে। হঠাৎ করেই এমন একটি গানে আমি কণ্ঠ দিতে পারব ভাবিনি। রেকর্ডিং শেষে গানটি অনেকবার নিজেই গুনগুনিয়ে গেয়েছিলাম।

হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি গানের সুর করেছেন এসআই টুটুল। টুটুল বণিক বার্তাকে বলেন, হুমায়ূন আহমেদ স্যার অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন আগে তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে ঘিরে একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনা ছিল শাওনকে নিয়ে নতুন মৌলিক একক অ্যালবাম করবেন। অ্যালবামের জন্য স্যার নিজে এবং কবি নির্মলেন্দু গুণ ছাড়াও গান লিখবেন ওপার বাংলার শীর্ষ দুই সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সব গানের সুর করার কথা ছিল আমার। এটি আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। আমার সংগীতজীবনের সেরা গানের একটি হলো যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়। হুমায়ূন স্যার বৃষ্টি প্রচণ্ড উপভোগ করতেন। গানটি বর্ষার প্রতি ভালোবাসার সুর। পুরো গানেই বৃষ্টিকে ধরার চেষ্টা করেছি।

একটা ছিল সোনার কন্যা শিরোনামের গানটি গীতিকবি হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় গান। ২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহূত হয়। গানটি প্রকাশ হতেই সারা বাংলায় এটি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। হাটে ঘাটে মাঠে শহর কিংবা নগর; সবখানেই বেজেছে সুবীর নন্দীর মিষ্টি গলার এই গান। এপার ছাড়িয়ে কলকাতায়ও তুমুল জনপ্রিয়তা পায় গানটি। গানে কণ্ঠ দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা কণ্ঠশিল্পী হয়েছিলেন প্রয়াত সুবীর নন্দী। ছবিতে গানটি দেখা গিয়েছিল অভিনেতা মাহফুজ আহমেদের ঠোঁটে। গানের সুর সংগীতায়োজন করেছেন মকসুদ জামিল মিন্টু।

২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া দুই দুয়ারি ছবিতে বরষার প্রথম দিনে গানটিতে কণ্ঠ দেন সাবিনা ইয়াসমিন। মকসুদ জামিল মিন্টুর সুর সংগীতে গানটির জন্য সাবিনা ইয়াসমিন ২৫তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা গায়িকার পুরস্কার পেয়েছিলেন। রোমান্টিক গান হিসেবে এটি আজও শ্রোতাদের মন ভরায়। হুমায়ূন আহমেদের লেখা ভিন্ন অনুভূতির একটি গান চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে জোছনা রাতে গান শোনার আনন্দ পাননি কিংবা গুনগুন করে নিজেই গেয়ে ওঠেননি এমন শ্রোতা হয়তো খুবই কম। গানটি ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া চন্দ্রকথা ছবিতে গেয়েছেন সেলিম চৌধুরী। গানটির সুর সংগীতায়োজন করেছেন মকসুদ জামিল মিন্টু।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন