নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন হচ্ছে

সাইফ সুজন

অনিয়ম-দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পাঁচজন ট্রাস্টিকে বাদ দিয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি) পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিগগিরই বিষয়ে একটি প্রস্তাব চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানো হবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পর্ষদ থেকে বাদ পড়তে যাওয়া সদস্যরা হলেন আজিম উদ্দিন আহমেদ, রেহানা রহমান, এমএ কাশেম, মোহাম্মদ শাজাহান বেনজীর আহমেদ।

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের কয়েকজন সদস্যের বেশকিছু অনিয়ম উঠে আসে। বিষয়ে দুদকের করা একটি মামলা আদালতে বিচারাধীন। সেখানের একজন ট্রাস্টি প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর জালিয়াতি মামলার আসামি। সরকারের নানা সংস্থার বিভিন্ন তদন্ত পর্যবেক্ষণের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়টির কল্যাণে ট্রাস্ট পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। তাই সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সভায় -সংক্রান্ত প্রস্তাব চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

দুদকের করা বিচারাধীন মামলার রায়ের আগেই এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে উপমন্ত্রী বলেন, সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এরই মধ্যে বেশকিছু অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। এর পরও যদি তারা কখনো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন, তখন সেটি দেখা যাবে।

যে পাঁচজন সদস্যকে বিওটি থেকে বাদ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, এক দশক ধরে তারাই ছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকের ভূমিকায়। এদের সবাই বিভিন্ন মেয়াদে ফাউন্ডেশন বিওটি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। গত কয়েক বছরে তাদের সংশ্লিষ্টতায় জমি কেনার নামে অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির টাকায় গাড়ি ভ্রমণবিলাস, অবৈধভাবে মোটা অংকের সিটিং অ্যালাউন্সের মতো বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটে নর্থ সাউথে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টিদের অনিয়ম তদন্ত করতে গিয়ে জমি কেনা বাবদ কয়েকশ কোটি টাকার অনিয়ম খুঁজে পায় দুদক। ঘটনায় গত মে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জমি কেনা বাবদ অতিরিক্ত ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঁচজন ট্রাস্টিসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করে দুদক। এর মধ্যে পাঁচজন ট্রাস্টি হলেন আজিম উদ্দিন আহমেদ, রেহানা রহমান, এমএ কাশেম, মোহাম্মদ শাহজাহান বেনজীর আহমেদ। আর বাকি একজন হলেন আশালয় হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন মো. হিলালী। মামলায় জামিন চেয়ে গত ২২ মে আদালতে হাজির হলে চারজন ট্রাস্টিকে শুরুতে পুলিশি হেফাজত এবং পরে কারাগারে পাঠান আদালত। তারা এখনো জামিন পাননি।

প্রভাবশালী চার ট্রাস্টি গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় নর্থ সাউথের আর্থিক প্রশাসনিক কার্যক্রমে এক ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। কেননা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য সর্বোচ্চ লাখ টাকা ব্যয়ের অনুমোদন করতে পারেন। এর বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হলে সেটি অবশ্যই বিওটির অনুমোদন লাগে। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করলে বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম চালিয়ে নিতে উপাচার্য কোষাধ্যক্ষের যৌথ স্বাক্ষরে প্রয়োজনীয় আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয় সরকার।

এদিকে আর্থিক অনিয়মের বাইরে স্বেচ্ছাচারিতারও অভিযোগ রয়েছে নর্থ সাউথের প্রভাবশালী ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভিন্ন সময় মতানৈক্য দেখা দিলে নর্থ সাউথের প্রতিষ্ঠাকালের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকেও বিশ্ববিদ্যালয়টির বিওটি থেকে বাদ দিয়েছেন তারা; অনেককে বাদ না দিলেও নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম থেকে বিরত রেখেছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাসে কোনো উপাচার্যকেই সন্তোষজনক সম্মানজনকভাবে বিদায় দেননি তারা।

বিষয়ে জানতে চাইলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ফাউন্ডেশনের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল বণিক বার্তাকে বলেন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল আমিসহ তিনজন ব্যক্তির। বাকি দুজন হলেন প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক মুসলেহ উদ্দিন ফাউন্ডেশনের প্রথম চেয়ারম্যান ইফতেখারুল আলম। শুরুতে গুলশানের একটি ভবনে ফ্লোর ভাড়া করে ছোট পরিসরে, পরবর্তী সময়ে বনানীতে অনেকগুলো ভবন, এরপর বসুন্ধরায় বড় ক্যাম্পাসএর সবই আমাদের হাতে করা। যদিও ২০১২ সালের দিকে একটি পক্ষ চাইল বিশ্ববিদ্যালয়কে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করবে, নিজেরা লাভবান হবে। এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় আমাদের নানাভাবে অপমান করার অপচেষ্টা শুরু হয়। একপর্যায়ে আমরা নিজেদের সম্মান বাঁচাতে দূরে চলে আসি। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনে কাজে আসতে পারি, তাহলে এখনো আমি সময় দিতে প্রস্তুত। কারণ এটা আমাদের আবেগের জায়গা।

বিওটির একটি অংশের অনিয়মের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ইউজিসির নিশ্চুপ অবস্থানকে দায়ী করেন ট্রাস্টি। তিনি বলেন, আমরা দূরে চলে এলেও তাদের অনিয়মের বিষয়ে নীরব ছিলাম না। অন্যায় সিদ্ধান্ত কার্যক্রমের বিষয়ে মন্ত্রণালয় ইউজিসিকে দফায় দফায় চিঠি দিয়েছি। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নীরব ভূমিকায় একের পর এক অনিয়ম করার সুযোগ পেয়েছেন তারা।

শিক্ষাবিদ, আমলা, রাষ্ট্রদূত, ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত ৩০ সদস্য নিয়ে গড়ে ওঠা ফাউন্ডেশন ফর প্রমোশন অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (এফপিইআর) আওতায় ১৯৯২ সালে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তী সময়ে সেটির নাম পরিবর্তন করে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ফাউন্ডেশন (এনএসইউএফ) করা হয়। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর পর সেটিকে রূপ দেয়া হয় দ্য নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টে। ট্রাস্ট রেজিস্ট্রেশনের সময় প্রতিষ্ঠাকালে অবদান রাখা ফাউন্ডেশনের অনেক শিক্ষানুরাগী সদস্যকে বাদ দিয়ে শুধু অর্থ দিয়ে সহায়তা করা ব্যক্তিদের ট্রাস্টি করা হয়। ফলে ক্রমান্বয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ট্রাস্টি সদস্যদের প্রভাব বাড়তে থাকে নর্থ সাউথে।

প্রতিষ্ঠাকালীন বিভিন্ন নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন বিশিষ্ট আমলা কূটনীতিক অধ্যাপক মুসলেহ উদ্দিন। তৎকালীন আইন অনুযায়ী তিনিই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম উপাচার্য প্রেসিডেন্ট। যদিও এত অবদান সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসে কিংবা ওয়েবসাইটে মুসলেহ উদ্দিন বিষয়ে কোনো ধরনের তথ্যই উল্লেখ নেই। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে গিয়ে তৎকালীন ফাউন্ডেশন সদস্যদের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে একপর্যায়ে তাকে নর্থ সাউথ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। নিজের লেখা একটি বইয়ে তিনি বিষয়ে বিভিন্ন অভিযোগও তুলে ধরেন।

দ্য নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ট্রাস্ট গঠনকালে এর সদস্য সংখ্যা ছিল ২৩। এর মধ্যে ১৬ জন ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা আজীবন সদস্য আর বাকি সাতজন সাধারণ সদস্য ট্রাস্ট ডিড অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠাতা আজীবন সদস্যদের মৃত্যুর পর তাদের উত্তরাধিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি হবেন। আর সাধারণ সদস্যদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর পর তাদের সদস্যপদ থাকবে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যমতে, বিওটিতে ১৫ সদস্যের তথ্য দেয়া রয়েছে, এছাড়া উপাচার্য আইনি ক্ষমতাবলে বিওটির সদস্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন