কয়লা ও এলএনজি আমদানি ক্রমেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছে

এক বছরে কয়লার দাম বেড়েছে ১৯৪%, এলএনজির ২১২%

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। কয়লার অস্বাভাবিক ক্রয়চাপ সবকটি মহাদেশেই। রেকর্ড পর্যায়ের কাছাকাছিতে কয়লা এলএনজির স্পট মূল্য। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সর্বোত্কৃষ্ট মানের কয়লার দাম টনপ্রতি ৪১০ ডলার ছাড়িয়েছে। রেকর্ড পর্যায় থেকে নেমে এলেও স্পট মার্কেটে এখনো এলএনজি কেনাবেচা হচ্ছে প্রতি এমএমবিটিইউ ৪০ ডলারের কাছাকাছিতে।

একই কয়লার দাম গত বছরের জুলাইয়ে ছিল প্রায় ১৩৯ ডলার। আগের বছরের একই সময়ে তা ছিল প্রতি টন ৪৮ ডলার। সে হিসেবে গত এক বছরে কয়লার দাম বেড়েছে ১৯৪ শতাংশ। দুই বছরে বেড়েছে ৭৫৫ শতাংশ। এর চেয়েও বড় উল্লম্ফন দেখা গিয়েছে এলএনজির মূল্যে। গত এক বছরে জ্বালানি পণ্যটির দাম বেড়েছে ২১২ শতাংশ। ২০২০ সালের জুলাইয়ের পর থেকে মোট বৃদ্ধির হার হাজার ৭০০ শতাংশেরও বেশি।

কভিডের প্রাদুর্ভাবোত্তর বিশ্বে বাড়তি চাহিদার কারণে গত বছরের শুরুর দিকে জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়তির দিকে চলে যায়। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যায় ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। রাশিয়ার ওপর একের পর এক বিধিনিষেধ জারি করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমা ব্লক। ভূরাজনীতির বাইরেও আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারের বড় প্রভাবক হয়ে ওঠে ইউরোপে রুশ জ্বালানি সরবরাহ। টানাপড়েনের মধ্যে রুশ জ্বালানির বিকল্প অনুসন্ধানে মরিয়া হয়ে ওঠে ইউরোপীয় দেশগুলো। সর্বশেষ গতকাল রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে ওঠে। রুশ জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলো এখন আবারো কয়লার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। ইউরোপে কয়লার আকস্মিক চাহিদা বৃদ্ধি পণ্যটির বাজারমূল্যকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। দেশগুলোর অর্থনীতি বরাবরই জ্বালানি পণ্যের মূল্যের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখিয়ে এসেছে। সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় দেশগুলো এখন জ্বালানি আমদানিতে লাগাম টানতে বাধ্য হচ্ছে। চাহিদামাফিক জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় অনেক দেশেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ধস নেমেছে। দিনের বড় একটি সময় ব্ল্যাকআউটে থাকতে হচ্ছে দেশগুলোকে।

সামনের দিনগুলোয় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্য দুটির মূল্য দীর্ঘমেয়াদে আরো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠার পূর্বাভাস রয়েছে। বিষয়ে বিশ্লেষকদের ভাষ্য হলো রুশ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ায় ইইউ অঞ্চলভুক্ত দেশগুলো এখন জ্বালানির বিকল্প উৎসের সন্ধানে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে সামনের দিনগুলোয় পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে জ্বালানি পণ্যের বৃহৎ ভোক্তা দেশগুলোও এখন আমদানি বাড়িয়ে চলেছে। এতে নাজুক অবস্থানে পড়ে গিয়েছে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো। বিশেষ করে শীতকালে বাড়তি চাহিদার সময় পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, সে বিষয়ে ধারণা দিতে পারছেন না বাজার-সংশ্লিষ্টদের কেউই।

আন্তর্জাতিক বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি দেশের বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত নিয়েও বড় ধরনের আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে। দেশে বিদ্যুৎ খাতের নির্মাণাধীন বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে রূপপুর বাদে বাকি সবই কয়লাভিত্তিক। বর্তমানে দেশে হাজার ৯৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার মোট সাতটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। এর মধ্যে রামপালসহ তিনটি চলতি বছরেই উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। আগামী বছর উৎপাদনে আসবে দুটি। বাকিগুলোও ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার্য কয়লার সংস্থান করা হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। সম্ভাব্য উৎস ধরা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ আফ্রিকাকে। তিন দেশ থেকেই কয়লা আমদানি বাড়াতে তত্পরতা চালাচ্ছে ইউরোপীয় দেশগুলো। এতদিন ইউরোপে ব্যবহূত কয়লার সবচেয়ে বড় উৎস ছিল রাশিয়া। দেশটির সঙ্গে ইউরোপের জ্বালানি বাণিজ্য এখন এক প্রকার অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলোও এখন কয়লার বিকল্প উৎস হিসেবে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর নির্ভরতা বাড়াতে জোর তত্পরতা চালাচ্ছে। রাশিয়ার বাইরে মূলত তিন দেশের কয়লাই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে মানসম্মত উপযোগী। অদূরভবিষ্যতে ইউরোপ দেশ তিনটির কয়লা রফতানির প্রধান গন্তব্য হিসেবে এশিয়াকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশ তিনটি থেকে সরবরাহকৃত কয়লার দামও এখন জোরগতিতে বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে দেশে চলমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কমিশনিংয়ের পর প্রয়োজনীয় কয়লার সংস্থান করা নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

সাশ্রয়ী জ্বালানি বিবেচনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পরিকল্পনায় কয়লার মূল্যের টনপ্রতি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছিল ১২০ থেকে ১৫০ ডলার। যদিও বাজারে এখন জ্বালানি পণ্যটির মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে নির্ধারিত মার্জিনের তিন গুণেরও বেশিতে।

আন্তর্জাতিক বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি প্রকল্পগুলোয় যে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে, তা স্বীকার করছেন বিদ্যুৎ খাতের নীতিনির্ধারক গবেষকরাও। বিদ্যুতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি বিচার করলে আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোয় এর প্রভাব রয়েছে। এটি এখন একটি বাস্তবতা। তবে আমরা চেষ্টা করছি বড় প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে চালু করতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। সাশ্রয়ী করার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলার বিকল্প নেই।

দেশে এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে দুটি। এর মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহকৃত কয়লা দিয়ে চলছে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র। হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করতে হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া থেকে। বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন চালু রাখা নিয়েও বড় ধরনের সংশয় রয়েছে।

এছাড়া দেশে রিলায়েন্স ইউনিক গ্রুপের দুটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (প্রতিটি ৭৫০ মেগাওয়াট) নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির সময়মতো উৎপাদনে আসা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে।

এলএনজি সংকটের কারণে সময়ে সময়ে দেশে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়; দেশের পরিবহন, শিল্পোৎপাদন, গৃহস্থালিসহ সংশ্লিষ্ট সব খাতেই এখন রেশনিংয়ের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ চালু রাখতে হচ্ছে জ্বালানি বিভাগকে।

ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি অথবা পশ্চিমা ব্লকের সঙ্গে রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভূ-অর্থনৈতিক টানাপড়েনের সমাধানের সম্ভাবনা দেখা দেয়ার আগ পর্যন্ত জ্বালানি পণ্যের মূল্যে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরবে না বলে মনে করছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। সে হিসেবে আগামী ছয় মাস বা এক বছর আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কয়লা বা স্পট এলএনজি আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ সংকটের সমাধান করা এক প্রকার অসম্ভব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

কয়লা এলএনজির বাড়তি মূল্য চলতি অর্থবছরে সার্বিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তার ভাষ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে জ্বালানি পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব থাকবে। সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। সরকার এখন জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্যের আমদানিতে সাশ্রয়ী হওয়ার চেষ্টা করছে। বিদ্যুতে পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে সমস্যা মোকাবেলার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। বিষয়গুলো অবশ্যই সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা, মানুষের ভোগপ্রবণতা উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগী সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

জ্বালানি পণ্যের নতুন মজুদ অনুসন্ধান উত্তোলন কার্যক্রমে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ থাকলে বর্তমান পরিস্থিতিতে সার্বিক অর্থনীতিতে চাপ কম পড়ত বলে মনে করছেন তিনি। তার বক্তব্য অনুযায়ী, দেশের জ্বালানি খাত আমদানিনির্ভর। আমাদের নীতিগত জায়গায় দুর্বলতা হলো আমরা জ্বালানির স্থানীয় মজুদ অনুসন্ধানে সেভাবে বিনিয়োগ করিনি। আমাদের স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ বাড়লে আমাদের আমদানিতে খরচ কম হতো। যারা এগুলো নিয়ে কাজ করছেন, তারাও বলছেন গ্যাসের অনুসন্ধান উত্তোলন নিয়ে আমাদের বড় ধরনের বিনিয়োগে যাওয়া উচিত ছিল।

বর্তমান পরিস্থিতি সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য অনেক দুরূহ হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি এখন আমদানিতে প্রভাব ফেলছে। আবার এর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের টাকারও অবমূল্যায়ন হচ্ছে। আগে যেখানে ডলারের বিনিময় হার প্রায় ৮৬ টাকা ধরে জ্বালানি কিনতে হয়েছে, এখন সেটা কিনতে হচ্ছে প্রায় ৯৪ টাকা ধরে। একে দাম বেড়েছে তার ওপর স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন। এতে আমাদের রিজার্ভে চাপ পড়েছে। স্থানীয় খরচে চাপ পড়েছে। অবশ্যই সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য পরিস্থিতিকে তা চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। এতে সরকারের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা আরো দুরূহ উঠবে। একপর্যায়ে গিয়ে কতটুকু ভর্তুকি দেয়া হবে সে বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিল্প খাতেও উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহন পর্যন্ত সব ধরনের খরচই বাড়ছে। এটি অব্যাহত থাকলে একদিকে ভোক্তার ওপর চাপ বাড়বে, অন্যদিকে প্রতিযোগী সক্ষমতার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন