সম্পাদকীয়

ধসারা বিশ্ব যখন করোনা মহামারীর বিপর্যয় রোধে সক্রিয়, তখন ২০২০ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের ১৫টি রাষ্ট্রীয় চিনিকলের মধ্যে ছয়টিরই বন্ধের ঘোষণা আসে। ২০২০-এর মাড়াই মৌসুমে পাবনা, কুষ্টিয়া, রংপুর, পঞ্চগড়, শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকলের আখ মাড়াই বন্ধ করে উৎপাদিত চিনি পার্শ্ববর্তী চিনিকলগুলোয় মাড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বন্ধ হওয়ার পর থেকে দুটি মাড়াই মৌসুম চলে গেল। চলতি বছর নভেম্বরে তৃতীয় মাড়াই মৌসুম শুরু হবে। এরই মধ্যে রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর বিশ্বজুড়ে তীব্র জ্বালানি সংকট শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছে আসন্ন তীব্র খাদ্য সংকটের অশনিসংকেত। এ বছরের শুরু থেকে জ্বালানি তেলের মূল্যই শুধু বাড়েনি, বেড়েছে ভোজ্যতেলের মূল্যও। দুটি বৃহৎ গম রফতানিকারক দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়ায় গম উৎপাদন ও গুদামজাত হুমকির মুখে গমের দাম বেড়ে গেছে। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের চাহিদা বৃদ্ধি এবং মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ভারত গম রফতানি নিষিদ্ধ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে চিনির দাম বেড়ে গেলে চিনি রফতানিতে ভারত কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে কিনা সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সর্বশেষ তিনদিন আগে আমরা জানতে পারলাম, সর্বোচ্চ চিনি উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিলের চিনিকলগুলো চিনি রফতানির চুক্তি বাতিল করে আখ থেকে ইথানল উৎপাদন করে রফতানি করতে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে সব ধরনের জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় আখ থেকে উৎপাদিত বায়োফুয়েলের চাহিদা বেড়েছে। ফলে চিনির চেয়ে আখ থেকে ইথানল উৎপাদন অধিক লাভজনক হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে চিনির বাজারে সংকট ঘনীভূত হবে এবং এ কারণেই চিনির দাম বাড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।

কয়েক সপ্তাহ ধরে টাকার অবমূল্যায়ন চলছে। ডলার শক্তিশালী হচ্ছে। এ সপ্তাহে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটায় ডলারের দাম খোলাবাজারে ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে। আর আমদানিকারকদের ৯৬ টাকার ওপর রেটে আমদানি করতে হচ্ছে। টাকার আরো অবমূল্যায়ন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ অবস্থায় চিনির মতো অপরিহার্য খাদ্য আমদানি আরো ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। কাজেই সব দিক থেকে চিনির দামের ওপর ঊর্ধ্বমুখী চাপ শুধু অপেক্ষার বিষয়।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫টি চিনিকলে ৮২ হাজার টন উৎপাদন হয়েছিল। ছয়টি মিল বন্ধের পর ২০২০-২১ অর্থবছরে চিনি উৎপাদন কমে ৪৮ হাজার টন হয়েছে এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন কমে ২৪ হাজার টনে নেমেছে। অর্থাৎ মিল বন্ধ হওয়ার পর প্রথম বছর বাংলাদেশে চিনি উৎপাদন প্রায় ৪১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং তার পরের বছর তা আরো ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে যখন চিনি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে, ভারতে ২০২০-২১ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় চিনি রফতানি ৪০ শতাংশ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। প্রায় একই ধরনের আবহাওয়া ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও যখন ভারতে চিনি শিল্পের বিকাশ ঘটছে তখন বাংলাদেশে শিল্পটি কেন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল না তা নিশ্চয়ই প্রশ্নের দাবি রাখে।

এমন তো নয় যে, বাংলাদেশে মিল থেকে উৎপাদিত চিনির চাহিদা নেই। এখন বাজারে প্রতি কেজি চিনির মূল্য নিম্নে যখন ৮০ টাকা, তখন কোনো দোকানে মিলের উৎপাদিত চিনি আমদানীকৃত সাদা চিনির সঙ্গে মিশিয়ে বেসরকারি উদ্যোগে ১২০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। দেশের ভোক্তারা সেই চিনি বাজারমূল্যের চেয়ে ৪০ টাকা বেশি দামে কেনার সময় ভাবছে দেশীয় মিলের চিনি কিনছে। ছয়টি রাষ্ট্রীয় চিনিকল বন্ধ হওয়ার পর এখন বেসরকারি রিফাইনারি ও অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে চিনির বাজার। ভোজ্যতেলের সংকটের মতোই চিনির সংকট শুরু হলে এখান থেকে বেসরকারি রিফাইনারিরাই চিনির বাজারে লাভবান হবে। তখন মূল্য বাড়লেও সরকারের কাছে মূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় থাকবে না। ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির পর প্রধানমন্ত্রী দেশীয় ভোজ্যতেলের ওপর, যেমন বাদাম তেলের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর কথা বলেছেন। খাদ্যের অপরিহার্য উপাদান আমদানিনির্ভর হয়ে উঠলে প্রায়ই আমরা নীতিনির্ধারকদের দেশীয় পণ্যের ওপর স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলতে শুনি। কিন্তু আদতে করেন তার ঠিক উল্টো।

তেল ও চিনির মূল্য দুটোই আগে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে চিনিকল ছাড়াও ১৪টি তেলকল এবং পাঁচটি তেল শোধনাগার ছিল। (বিএসএফআইসি ২০১৯) যখন থেকে বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হলো এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে তেল ও চিনি আমদানি করে বিক্রির অনুমতি দেয়া হলো, তখন থেকে এ দাম আর নিয়ন্ত্রণে থাকল না। দেশীয় চিনিকলগুলো অসম প্রতিযোগিতায় দিনে দিনে অলাভজনক হতে শুরু করল, আর তেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণও চলে গেল গুটিকয়েক ব্যবসায়ীদের হাতে। তাই কিছুদিন আগেই আমরা দেখলাম আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পূর্বের আমদানীকৃত তেল বাজার থেকে উধাও হতে শুরু করল। চিনির বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে এর আগেও বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি আমদানিকারকরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু তখন দেশীয় চিনির মজুদ থাকায় এবং সেগুলো কম দামে সরবরাহ করতে পারার কারণে বেসরকারি কোম্পানিগুলো অসাধুভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও তা পারেনি। আবার ঠিক যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে তখন দেখা গেছে দেশীয় চিনিকলগুলো লাভ করেছে।

আসন্ন খাদ্য সংকট, যুদ্ধ পরিস্থিতি, টাকার অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিতিশীলতা—এ সবকিছু বিবেচনায় খাদ্যতালিকায় অপরিহার্য পণ্য চিনি একটি কৌশলগত পণ্য হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। কৌশলগত পণ্য বলতে সেসব অপরিহার্য খাদ্যপণ্যকেই বোঝায়, যেগুলো সাময়িক লোকসান হলেও ভর্তুকি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা, সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে এর ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা, লোকসান কমানো ও জনস্বার্থ বিবেচনায় এর সর্বোপরি বিকাশ ঘটানো একান্ত প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালনার জন্য চিনি শিল্পকে অতীতে অনেকটা কৌশলগত পণ্য হিসেবেই দেখা হতো। কারণ বাংলাদেশের দ্য পাবলিক করপোরেশন (ম্যানেজমেন্ট কো-অর্ডিনেশন) অর্ডিন্যান্স ১৯৮৬-এর ১১ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোতে লোকসান হলে সরকারকে ভর্তুকি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, “The Government shall reimburse to a public corporation the financial loss, if any, incurred by it or by any of its enterprises consequent upon the following by it or by such enterprises any specific instructions given by the Government on matters relating to the business or administration of such corporation or enterprises.”

কিন্তু রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো লোকসান করলেও সরকার ভর্তুকি না দিয়ে ঋণ দিয়ে দিনে দিনে এ চিনিকলগুলোকে ঋণগ্রস্ত করে তুলেছে। ঋণের একটি বড় অংশ যেত কৃষকদের কাছে বীজ ও সার কেনা বাবদ ঋণ হিসেবে। কৃষকরা চিনিকলে সরবরাহের সময় সেই ঋণ প্রতি বছর পরিশোধ করলেও মিলের অব্যবস্থাপনায় লোকসানের কারণে সেই ঋণ মিলগুলো পরিশোধ করতে পারত না। আর তাতে মোট পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। ঋণগুলো মূলত নেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় চারটি ব্যাংক থেকে চলতি মূলধনের চাহিদা পূরণ, কৃষিঋণের জন্য। এ পুঞ্জীভূত ঋণের ৯ শতাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে প্রদেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২-২১ সাল পর্যন্ত ২৩ হাজার কোটি টাকার উপরে সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকগুলো। শুধু করোনার সময় ঋণ পরিশোধের শিথিলতার মধ্যে ২০২১ সালেই বিশেষ গোষ্ঠীর ৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকার উপর সুদ মওকুফ করা হয়েছে। এছাড়া বিআইবিএমের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে সরকারি ব্যাংকের ঋণ অবলোপনের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৯৪০ কোটি টাকায়। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ অবলোপন ছিল ৬ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা বিশেষায়িত ও বিদেশী ব্যাংক অবলোপন করেছে। ঋণ একবার অবলোপন হলে তা পরিশোধের সম্ভাবনা কমে যায়। এসব অবলোপনকৃত ঋণ থেকে বেশি উপকৃত হয় প্রভাবশালীরাই। এবং আমরা দেখি কীভাবে জনগণের অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ব্যক্তি খাতে স্থানান্তর হয়। এ চিত্র শুধু ব্যাংকিং খাতেই নয়, বিদ্যুৎ, ব্রিজ-রাস্তা নির্মাণ খাত থেকে শুরু করে কৃষি খাতেও ঘটছে। অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি, জনগণের অর্থ শুধু কীভাবে ব্যয় করলে তা জনস্বার্থে লাগবে, সেভাবে বরাদ্দ না করায় কীভাবে লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। অথচ মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণের কারণে চিনির উৎপাদন খরচ বেড়ে কোনো কোনো মিলে ৩০০ টাকার উপরে চলে গিয়েছিল।

রংপুর চিনিকলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে ২০১৯-২০ সালে খরচ হয়েছে ১৮৬ টাকা ২৪ পয়সা। এ চিনিকলের ১৫৮ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ আছে। এর সুদ হিসাব করলে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনের খরচ দাঁড়ায় ৩১১ টাকা ৯৭ পয়সা। পঞ্চগড় চিনিকলেও সে সময় প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ছিল ৩০২ টাকা (সুদসহ)। একইভাবে প্রতি কেজি উৎপাদনে কুষ্টিয়ায় ২৭৩, শ্যামপুরে ২৬২, সেতাবগঞ্জে ২৪৯ ও পাবনায় ১৭৮ টাকা ব্যয় হয়েছে। আর বিক্রি হয়েছিল ৫৩-৫৭ টাকা কেজি দরে। (প্রথম আলো, ৩ ডিসেম্বর ২০২০) ঋণের সুদ পরিশোধের খরচ ২০০৬-০৭ অর্থবছরে যেখানে ছিল মোট উৎপাদন খরচের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সে সময় সব মিলের মধ্যে সেতাবগঞ্জ ও পঞ্চগড় চিনিকলে ঋণের সুদ বাবদ খরচ উৎপাদন খরচের সর্বোচ্চ (৪৪.৭ শতাংশ) এবং কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে সর্বনিম্ন (২১.৮ শতাংশ) ছিল। (বিএসএফআইসি, ২০১৮-১৯, বিএসএফআইসি, ২০০৬-০৭)

রাষ্ট্রীয় ছয়টি চিনিকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির জন্য। এবং আমরা দেখলাম, এ উৎপাদন খরচ বাড়ার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল পুঞ্জীভূত ঋণ। এছাড়া আরো অনেক কারণে উৎপাদন খরচ বেশি ছিল। যেমন কৃষকদের কাছে আখের দাম নিয়মিত পরিশোধ না করার কারণে আখ চাষে অনীহা, পর্যাপ্ত আখের সরবরাহ না থাকা, আখ ভালো জাতের না হওয়ায় এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় চিনি আহরণের মাত্রা কমে যাওয়া, বিলম্বে আখ মাড়াইয়ের কারণে আখের সুক্রোজ কমে যাওয়া, পুরনো যন্ত্র ব্যবহারের কারণে বেশি আখ থেকে কম চিনি উৎপাদন হওয়া। এছাড়া অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, পুর্জি বিতরণে অনিয়ম—এসব কারণেও চিনির উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়েছে। অথচ এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিলেই উৎপাদন খরচ কমানো যেত। এবং এখনো চেষ্টা করলে ও সরকার উদ্যোগী হলে সেই চিনিকলগুলোকে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করা সম্ভব। মিলগুলো চালু করে কীভাবে এর বিকাশ করা সম্ভব এ নিয়ে বিস্তারিত প্রস্তাব পরিশিষ্ট ‘ক’-এ দেয়া হলো।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আগে চিনি শিল্প রক্ষার জন্য নিচের প্রস্তাবগুলো পেশ করা হলো: ১) বন্ধ করে দেয়া ছয়টি মিল পুনরায় চালু করে দিতে হবে। ২) বিএসএফআইসির হিসাব অনুযায়ী, মাড়াই স্থগিত মিলগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৫ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। মিলগুলো বসিয়ে না রেখে এবং যন্ত্রপাতি নষ্ট হতে না দিয়ে অবিলম্বে মিলগুলো চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। ৩) বকেয়া বেতন ভাতা (৩১ দশমিক ১১ কোটি টাকা), পিএফ বকেয়া (১১১ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা), গ্র্যাচুইটি বকেয়া (২৮৪ দশমিক ৫০ কোটি টাকা) অবিলম্বে পরিশোধ করার জন্য বাজেটে বরাদ্দ দিতে হবে। ৪) আখ ক্রয়ের জন্য ২৫% ভর্তুকি দিতে হবে। ৫) আখ চাষের জন্য ১৫টি চিনিকলসংলগ্ন এলাকায় আগের মতো ঋণ দিতে হবে। ৬) মিলগুলোর পুঞ্জীভূত ঋণ (৩ হাজার ৮৫ কোটি টাকা) মওকুফ করতে হবে। ৭) মিলগুলো পুনরায় চালু করলে সেগুলো কীভাবে লাভজনক করা যায় সে সম্পর্কে কিছু প্রস্তাব পরিশিষ্ট ‘ক’-এ উল্লেখ করা হলো।

পরিশিষ্ট ‘ক’

চিনিকলগুলো চালু করে এর বিকাশের জন্য নিচে করণীয় প্রস্তাব পেশ করা হলো।

১) আখের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি: ক. আখের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য আখচাষীকে আখ বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এ লক্ষ্যে চিনিকলগুলোর জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। পুর্জি বিতরণের সব অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। খ. একরপ্রতি গড় ফলন বর্তমান ১৮-২০ টন থেকে ৩০ টনে উন্নীত করার জন্য বিদ্যমান উচ্চফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতের চাষাবাদ বাড়াতে হবে। গ. চাষীদের সময়মতো শোধিত বীজ, সার, কীটনাশক সরবরাহ করতে হবে। এক্ষেত্রে সব অনিয়ম দূর করতে হবে। ঘ. আখের আধুনিক জাত দীর্ঘস্থায়ী হয় না, নানা কারণেই দ্রুত রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে ফলন কমে যায়। ফলে বিএসআরআইকে ক্রমাগত নতুন নতুন জাত অবমুক্ত করতে হবে, যেন নিয়মিত প্রতিকূল পরিবেশে ভালো ফলন নিশ্চিত করা যায়। এ লক্ষ্যে বিএসআরআইয়ের প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা, যেমন ফুল ফোটাতে সক্ষম প্যারেন্ট জাতের সংকট, ব্রিডিংয়ের ক্ষেত্রে আলো ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সমস্যা ইত্যাদির সমাধান করতে হবে।

২) চিনি আহরণ হার বাড়াতে করণীয়: ক. আখ কাটার সময় প্রথমে মুড়ি আখ, তারপর যথাক্রমে আগাম, মধ্যম ও নাবি আখ কাটতে হবে এবং আখ কাটার পর ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মাড়াই সম্পন্ন করতে হবে। চিনিকল কর্তৃক আরো বেশি করে আখ সময়মতো পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত ট্রাক-ট্রেইলার-ট্রাক্টরের ব্যবস্থা করতে হবে। খ. চিনিকলের যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন করতে হবে। গ. নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে কারখানার প্রসেস লস ও অপচয় বন্ধ করতে হবে। ঘ. উন্নত মানের আখ উৎপাদনের জন্য কৃষকদের প্রণোদনা দিতে হবে। প্রয়োজনে মিলের লভ্যাংশ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

৩) ব্যবস্থাপনা সংকট নিরসনে করণীয়: ক. প্রতিটি কারখানায় জৈবসার উৎপাদন ইউনিট স্থাপন করতে হবে। খ. কো-জেনারেশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে হবে। গ. মাড়াই মৌসুম ছাড়াও সারা বছর যেন কারখানার জমি, অবকাঠামো, শ্রমশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় সেজন্য কারখানার জমিতে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে; যেমন আম, আনারস, টমেটো, আলু ইত্যাদি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন, ভোজ্যতেল শোধনাগার স্থাপন, মসলা উৎপাদন কারখানা ইত্যাদি। ঘ. যেহেতু বিট বছরে দুবার চাষাবাদ করা যায়, সেহেতু আখের সাথী ফসল হিসেবে বিট চাষাবাদ ও বিট থেকে রস আহরণের জন্য ডিফিউশন ইউনিট স্থাপন করা যেতে পারে। ফলে আখ মাড়াই মৌসুম শেষেও চিনিকল অলস থাকবে না এবং চিনির উৎপাদন খরচ কমে আসবে। ঙ. চিনি কলের নিজস্ব জমিতে রিফাইনারি স্থাপন করে সারা বছর রিফাইন সুগার উৎপাদন করলে একদিকে চিনিকলগুলোর লোকসান কমবে, অন্যদিকে চিনির বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। চ. চিনির বিতরণ বিস্তৃত করার জন্য ডিলারদের পর্যাপ্ত প্রণোদনা দিতে হবে। ডিলাররা সরকারি চিনি বিক্রির ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার কারণে বেসরকারি চিনি বিক্রিতে উৎসাহিত বোধ করে সেসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। ছ. চিনির সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। জ. যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, শ্রমিক নিয়োগ, পুর্জি প্রদানে অনিয়ম দুর্নীতি অবহেলা প্রতিরোধ করতে হবে।

[শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিট মিলনায়তনে পাটকল চিনিকল রক্ষায় শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্যের উদ্যোগে ‘২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বাংলাদেশের মৌলিক শিল্প রক্ষায় বন্ধ সকল পাটকল চিনিকল চালু ও তার বিকাশে আমাদের প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধ]

মোশাহিদা সুলতানা: সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়