ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বর্ষীয়ান লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর নেই। গতকাল স্থানীয় সময় ভোরে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। পরিবারের সদস্য ও লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সন্তান সাংবাদিক অনুপম চৌধুরীর বরাত দিয়ে লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, গতকাল ভোরে লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ মিশন তার পরিবারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে এবং দাফনের প্রস্তুতিতে সার্বিক সহযোগিতা করছে।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী এ সাংবাদিক স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র রচয়িতা। গানটি বিবিসি বাংলা সার্ভিসের শ্রোতা জরিপে বাংলা গানের তালিকায় তৃতীয় সেরা স্থান লাভ করে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর তত্কালীন ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত অবিভক্ত ভারতের বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি জয় বাংলা, পরে যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর সেখানেই স্থায়ী হন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। যুক্তরাজ্যে তিনি নতুন দিন নামে একটি সংবাদপত্র চালু করেন। এছাড়া সেখান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি।
তিনি সাংবাদিকতা জীবনে ‘ডানপিটে শওকত’, ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘নাম না জানা ভোরে’, ‘নীল যমুনা’, ‘শেষ রজনীর চাঁদ’ ও ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’র মতো ৩৫টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নামের একটি ফিল্মও প্রযোজনা করেন।
সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৯ সালে তিনি স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি পদক, স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পদক, সংহতি আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পান। তিনি ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরীকে হারান। তিনি চার মেয়ে ও এক ছেলের জনক।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আলাদা শোকবার্তায় তারা লেখক ও সাংবাদিকের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বাংলাদেশ প্রগতিশীল, সৃজনশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন অগ্রপথিককে হারাল। তার একুশের অমর সেই গান বাঙালি জাতিকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তির আন্দোলনে অসম সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল।
সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার মেধা-কর্ম ও লেখনীতে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন এবং বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মননকে ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সমর্থন করে জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তার সঙ্গে আমার বহু স্মৃতি জড়িত। অনেক পরামর্শ পেয়েছি। একজন বিজ্ঞ ও পুরোধা ব্যক্তিত্বকে হারালাম, যিনি তার লেখা ও গবেষণায় আমাদের বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা শোকবার্তা দিয়েছেন।