ভবন ব্যবহার সনদ ছাড়া মিলবে না ব্যাংকঋণ

জেসমিন মলি

নির্মিত ইমারতে অনুমোদিত নকশা ব্যবহার হয়েছে কিনা, সেটি যাচাই-বাছাইয়ের পরই দেয়া হয় ব্যবহার সনদ বা অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট। ২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় যেকোনো ইমারত নির্মাণ শেষে তা ব্যবহার বা বসবাসের জন্য সনদ নেয়া বাধ্যতামূলক। আংশিক নির্মিত ইমারতের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। সনদটি প্রতি পাঁচ বছর পর পর নবায়ন করতে হয়। তবে ভবন মালিকদের মধ্যে সনদটি গ্রহণ বা নবায়নের আগ্রহ তেমন একটা নেই। অবস্থায় বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থান নিতে যাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ফ্ল্যাট বা ভবন ক্রয়-বিক্রয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যাংকঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রেও সনদটিকে বাধ্যতামূলক করতে চাইছে সংস্থাটি।

বিষয়টি নিয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব এবং রাজধানীর সব সাব-রেজিস্টার অফিস তফসিলি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের চিঠি দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে রাজউক। সংস্থাটি বর্তমানে রাজধানীতে ভবন নির্মাণ নিয়ে বিদ্যমান বিধিমালা সংশোধন করছে। এতে ব্যবহার সনদ না থাকলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে পানি, বিদ্যুৎ গ্যাসের সংযোগ নেয়ার ক্ষেত্রেও সনদটির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে সংস্থাটি।

রাজউক সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজধানীতে প্রতি বছর বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদনের জন্য প্রায় আড়াই হাজার নকশা রাজউকে জমা পড়ে। এর মধ্যে গড়ে অনুমোদন পায় প্রায় হাজার নকশা। ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র নকশাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র ঠিক না থাকায় অনেক আবেদনকারীর নকশার অনুমোদন দেয়া যায় না। এতদিন পর্যন্ত ভবন মালিকদের ব্যবহার সনদ নেয়ায় আগ্রহী করে তুলতে নানা তত্পরতা দেখিয়েছে রাজউক। কিন্তু নিয়ে ইতিবাচক কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বর্তমানে রাজউকের নতুন ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধনের কাজ চলছে। এতে নতুন ধারা যুক্ত করার মাধ্যমে ভবন নির্মাণকারীদের মধ্যে অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট গ্রহণের আগ্রহ বাড়াতে চায় রাজউক।

রাজধানীর অনেক ভবনই গড়ে উঠেছে অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে। আবাসন ব্যবসায়ী ভবন মালিকদের মধ্যে অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট গ্রহণে অনাগ্রহের পেছনে মূলত বিষয়টিকেই দায়ী করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী, যেকোনো ইমারত নির্মাণের পর অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায় অধিকাংশ বিদ্যমান ইমারতেরই সার্টিফিকেট বা সনদ নেই। এর কারণ হলো অধিকাংশ ইমারতই অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয় না। অর্থাৎ রাজউক থেকে অনুমোদন নেয়ার পর নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণ করা হয়। এমনকি গুলশান বনানীর মতো অভিজাত এলাকার বহুতল ভবনগুলোয়ও ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে।

তিনি বলেন, অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীর প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পরই অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট দেয় রাজউক। কিন্তু অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত ভবনগুলো সনদের আবেদনের শর্তই পূরণ করে না। এজন্য রাজউকে এর আবেদনও জমা পড়ে না। অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট নেয়ার দায়িত্ব মূল নকশা আবেদনকারীর। অসাধু বা অতিমুনাফালোভী হাউজিং বা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের অনেকেই সনদ না নিয়েই ক্রেতাদের কাছে অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করেন। ক্রেতারাও তা যাচাই-বাছাই না করেই ব্যবহার শুরু করে দেন। রাজউকের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং কর্মীদের পরিবীক্ষণে দুর্বলতা অসততার কারণেই এমনটি ঘটছে।

রাজধানীতে ৭০-৭৮ শতাংশ ভবন ত্রুটিপূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে বলে খোদ রাজউকেরই এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য হলো, এর মধ্য দিয়ে রাজউক এক প্রকারে নিজস্ব গাফিলতির কথা স্বীকারও করে নিয়েছে। গত কয়েক বছরে সংস্থাটির জনবল বেড়েছে। এর পরও ব্যবহার সনদ গ্রহণে ভবন মালিকদের আগ্রহী করে তুলতে না পারায় সংস্থাটির আন্তরিকতার ঘাটতিই প্রকট হয়ে উঠেছে।

বিষয়টি নিয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক . আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলে বাড়ির মালিকরা বাধ্য হবে অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট নিতে। ব্যাংকঋণ ইউটিলিটি সার্ভিস লাইন নেয়ার ক্ষেত্রেও সনদের বাধ্যবাধকতা আরোপ করার বিষয়টিও ইতিবাচক। আবার অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করার একটি বিষয়ও রয়েছে। সেক্ষেত্রে রাজউকের নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই। শুধু আইন করলেই হবে না। সেটি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য তদারকি বাড়াতে হবে।

নকশাবহির্ভূত স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে রাজউকের বিভিন্ন অথরাইজড অফিসের আওতায় পরিদর্শকদের নিয়মিতভাবে তদারকি করার কথা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব কর্মকর্তা তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেন না বলে রাজউকের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও স্বীকার করে নিয়েছেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সংস্থাটিতে সব দিকে নিয়মিত তদারকি বাড়ানোর মতো প্রয়োজনীয় জনবল এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। অভাব রয়েছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিরও। ফলে অনেক সময় নকশা ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত এসব স্থাপনায় রাজউকের অভিযান চলে ধীরগতিতে। সুযোগে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ হয়ে যায়। পরে যখন উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়, তখন নানাভাবে তাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়।

নির্মাণ খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্প বা দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে অবকাঠামো রক্ষায় নকশার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। নকশা অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণ হলে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা অনেক কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু রাজধানীতে এখন রাজউকের তত্ত্বাবধান ছাড়াই গড়ে উঠছে অসংখ্য বহুতল ভবন। এসব অবকাঠামোর নির্মাণকাজ বিধি মেনে হচ্ছে কিনা, সেটি তদারকিতেও ভূমিকা রাখতে পারছে না রাজউক। অভিযোগ রয়েছে, সংস্থাটির একশ্রেণীর কর্মকর্তা ইমারত মালিক নির্মাতাদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করে থাকেন। অর্থের বিনিময়ে নকশা অনুমোদন ভুয়া ছাড়পত্র দেয়ার অভিযোগও শুনতে পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে ইমারত মালিক নির্মাতারাও জানেন না এসব ছাড়পত্র ভুয়া। এসব অভিযোগে রাজউকের বেশকিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)

আবার অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুমোদনের অতিরিক্ত উচ্চতার ভবন নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া যায়। অনুমোদনের বাইরে গিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের ফলে দেখা যায়, নকশার সঙ্গে গড়ে ওঠা এসব ভবনের মিল নেই। আবার অনেক ভবনের পরিপূর্ণ নকশাও নেই। ধরনের ভবনে আগুন লাগলে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকে। তখন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের নকশা না দেখেই অন্ধকারে উদ্ধারকাজ চালাতে হয়। এতে করে ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যায়। নির্মাণ শেষে ব্যবহার সনদ না নেয়া হলেও এসব ভবন মালিকের বিরুদ্ধে যাবৎ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

নিয়মকানুন না মেনে গড়ে ওঠা রাজধানীর কতটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কোনো সংস্থার কাছেই নেই। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় অঞ্চলভিত্তিক সমীক্ষা করে প্রায় ৭০ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালার যদি যথাযথ বাস্তবায়ন করা যায়, তবে রাজধানীতে বহুতল ভবনের ঝুঁকি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব হবে।

বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান (সচিব) এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধনের কাজ চলছে। সেখানে অকুপ্যান্সি সনদ না নিলে ব্যাংকঋণ বিভিন্ন সেবা সংস্থার সংযোগ না দেবার বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপের বিধান যুক্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে শাস্তির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা, সে বিষয়েও আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এসব বিধানে কড়াকড়ি আরোপ করা গেলে সবাই অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট নিতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন