ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক আগ্রাসনের ফলে শুরু হওয়া এ যুুদ্ধে জয়ী কে হবে, আপাতদৃষ্টিতে তা নির্ণয় করাটা কঠিন। তবে চলমান এ যুদ্ধ শুধু ইউক্রেনের সাধারণ জনগণেরই ক্ষতি করছে না, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাশিয়ার লোকেরাও। যারা কখনই যুদ্ধ বেছে নেয়নি কিন্তু বাণিজ্য ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারণে অস্থির অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে সহ্য করতে হচ্ছে তাদেরও। সংঘর্ষ থেকে ছড়িয়ে পড়া অস্থির অর্থনীতির প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়েই। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোয়, যারা এখনো কভিড-১৯ মহামারীর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টায় নিয়োজিত।
হঠাৎ
উদ্বিগ্নতার একটি
বড় কারণ
হচ্ছে তেলের
মূল্যবৃদ্ধি। সম্প্রতি
বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট
ক্রুডের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ ডলার বেশি।
২০০৮ সালের
পর সর্বোচ্চ
দাম বেড়েছে
এ দফায়।
আমেরিকা ও তার ইউরোপীয়
মিত্ররা রাশিয়া
থেকে তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের
বিষয়ে আলোচনা
করেছে—এমন সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে রাতারাতি তেলের দাম বেড়েছে। রাশিয়া
ইউক্রেনের সঙ্গে
সংঘর্ষে জড়ালেও
এত দিন তেল আমদানির
ওপর বিধিনিষেধ
আরোপের বিষয়টি
ছিল আলোচনার
বাইরে। কিন্তু
৮ মার্চ
আমেরিকার পক্ষ
থেকে রাশিয়া
থেকে সব ধরনের জ্বালানি
পণ্য আমদানির
ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়া হয়। পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে ২০২২
সালের শেষ নাগাদ রাশিয়া
থেকে তেল ও তেলপণ্যের
আমদানি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। এ অবস্থায়
বিশ্বব্যাপী তেলের
বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা
পরিলক্ষিত হচ্ছে।
করোনাকালীন জ্বালানি মূল্যের অস্থিরতার জের ধরে এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী এর দাম বেড়ে গেছে। ২০২০ সালের এপ্রিলে করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের সময় ব্রেন্ট ক্রুডের দাম কমে ব্যারেলপ্রতি ৯ ডলার। তবে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ব্যারেলপ্রতি দাম বেড়ে হয় ৯০ ডলার। এ অবস্থায় নতুন করে তেল ও গ্যাসের দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে ইউক্রেন যুদ্ধ।
তাছাড়া রাশিয়া থেকে আমদানীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ইউরোপ অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই পশ্চিমা গণমাধ্যম জ্বালানির দাম বাড়ার ফলে ইউরোপজুড়ে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে তার ওপর স্বভাবতই অধিক দৃষ্টি দিচ্ছে। অথচ বিশ্বের বেশির ভাগ তেল ও গ্যাস আমদানিকারক দেশ তুলনামূলকভাবে দরিদ্র। আমেরিকা ও অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির তুলনায় তাদের অনেকেরই মহামারীর বিপরীতে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড়ের সক্ষমতা ছিল না। এ দেশগুলো এখনো কর্মসংস্থান সমস্যার পাশাপাশি দুর্বল পুনরুদ্ধার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি তাদের পক্ষে বহন করা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি তা ব্যালান্স অব পেমেন্টসহ অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করছে। বর্তমান অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবেই যা তাদের জন্য মোকাবেলা করাটা কঠিন।
এটা ঠিক যে ইউক্রেন যুদ্ধের
কারণে সৃষ্ট
অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির চাপ পশ্চিমা ধনী অর্থনীতির নীতিনির্ধারকদের চ্যালেঞ্জকে অনেক বেশি
জটিল করে তুলছে। বড় ধরনের অর্থনৈতিক
মন্দার মুখোমুখি
না হলেও
ক্রমে মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। বিশ্বজুড়ে তেল একটি সর্বজনীন
মধ্যবর্তী পণ্য,
যা বিভিন্নভাবে অন্যান্য পণ্য ও পরিষেবার পাশাপাশি
যানবাহন খরচকে
প্রভাবিত করে।
তাই স্বাভাবিক
ও সর্বোত্কৃষ্ট পরিস্থিতিতেও তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার
বিষয়টি মূল্যবৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতির গুরুত্বপূর্ণ চালক
হিসেবে কাজ করতে পারে।
কিন্তু ধনী দেশগুলো মূল্যস্ফীতির যে পর্যায়ে অবস্থান
করেছে তা তারা রীতিমতো
ভুলে গেছে।
নীতিনির্ধারকরাও মূল্যস্ফীতির বিপরীতে সহজ কিছু
সমাধান দেখাচ্ছেন,
যেমন সুদের
হার বৃদ্ধি
কিংবা তারল্য
নিয়ন্ত্রণ; যা মূল্যবৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতিকে সামান্য চিহ্নিত করতে
সক্ষম হলেও
সত্যিকার অর্থনৈতিক
মন্দার দিকে
ঠেলে দিতে
পারে।
উন্নয়নশীল বিশ্বে চ্যালেঞ্জগুলো এখনো অনেক বেশি, নীতিনির্ধারকদের নড়েচড়ে বসার সুযোগও কম। সম্প্রতি তেলের নাটকীয় মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে, যা পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ বাড়িয়ে তুলবে। ইউক্রেনের ট্র্যাজেডি বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিরদাঁড়া ব্যথার কারণ তৈরি করছে। কেননা মহামারী চলাকালীন উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোয় ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বেড়েছে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে। যুদ্ধের আগে ইউক্রেন ছিল পৃথিবীর পঞ্চম শীর্ষ গম রফতানিকারক দেশ। এছাড়া বার্লি, ভুট্টা, সরিষা ও সূর্যমুখী তেলের অন্যতম প্রধান জোগানদাতা। তাই যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে এ-জাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ফলে সর্বত্র শস্যজাতীয় পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে।
এখানেই শেষ নয়। আরো একটি বিপদ রয়েছে। আর্থিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যারা অ্যাসেট মার্কেটে বিনিয়োগের জন্য বাজি ধরেছিলেন, তাদের এখন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। মার্চের প্রথম পাঁচদিনে শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে গমের ভবিষ্যৎ মূল্য বেড়েছে ৪০ শতাংশ। ১৯৫৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যা সবচেয়ে বেশি সাপ্তাহিক বৃদ্ধির রেকর্ড। এদিকে সারের ঘাটতির ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কেননা রাশিয়া শুধু বিশ্বের শীর্ষ গম রফতানিকারক দেশই নয়, অন্যতম সার উৎপাদনকারীও। স্বাভাবিকভাবেই ওই পণ্যগুলোর রফতানি বাধাগ্রস্ত হওয়া বিশ্ব খাদ্যমূল্যকে অনেক বেশি বাড়িয়ে দেবে।
আগেও কিন্তু আমরা এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম। যদিও তখন পৃথিবীতে ইউক্রেন-রাশিয়ার মতো চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি ছিল না। আমাদের নিশ্চয়ই বৈশ্বিক আর্থিক সংকট পরিস্থিতির আগে অন্ধকার ও হতাশায় নিমজ্জিত সময়ের কথা মনে আছে। ২০০৭-০৮ সালের আর্থিক মন্দার সময় সৃষ্ট খাদ্য সংকট বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা বৃদ্ধির পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশের লাখ লাখ মানুষকে অসহায় এক পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। বিশ্বব্যাপী খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ ও চাহিদার তেমন কোনো পরিবর্তন না ঘটা সত্ত্বেও ওই সংকটটির উদয় হয়। আর এখন বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ হ্রাসের বিষয়টি প্রায় অনিবার্য। তাছাড়া খাদ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি আরো ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। যদি বৈশ্বিক বাজারের চাপ বৃদ্ধি পায়, সেক্ষেত্রে ভঙ্গুর অর্থনীতিগুলো আরো বেশি বিপন্ন হবে।
এদিকে আমরা লক্ষ করছি জি৭ তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রগুলো (যাদের সাম্প্রতিক কার্যক্রম বলে যে তারা বৈশ্বিক অর্থনীতির স্বঘোষিত মোড়ল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে) প্রকৃত ও আসন্ন বিপদ সম্পর্কে খুব বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করছে না। যদিও বিষয়টি নিয়ে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। তবে সংকটকালীন এ পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলোকে অবশ্যই জোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্ততপক্ষে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে উন্নয়নশীল বিশ্বকে সহায়তা করতে হবে একের পর এক ধেয়ে আসা মূল্যের ধাক্কা সামলাতে। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি বিধিবিধানগত সহায়তা দিতে হবে।
আমরা যদি এ ধরনের সহযোগিতা ও প্রচেষ্টার দিকে অগ্রসর না হই, সেক্ষেত্রে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতিকে গাঢ় করবে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে দরিদ্র দেশগুলো।
[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]
জয়তী ঘোষ: ভারতের জওহরলাল
নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক; ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস অ্যাসোসিয়েটসের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি ও ইনডিপেনডেন্ট কমিশন ফর দ্য
রিফর্ম অব
ইন্টারন্যাশনাল করপোরেট
ট্যাক্সেশনের সদস্য
ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস