সত্তরের
দশকে বাংলাদেশের
জন্মের ঊষালগ্নে
ভূমি সংস্কার
নিয়ে ব্যাপক
আলাপ-আলোচনা
হতো। এটাই
স্বাভাবিক, কারণ
জমি তখন
গ্রামীণ আয়ের
সিংহভাগ গ্রামীণ
আর ক্ষমতার
কাঠামোয় বড়
ভূমিকা পালন
করত। জমি
যার জীবন
তার—এমনই
ছিল অবস্থা
সাত কোটি
মানুষ ও
৫৫ হাজার
বর্গমাইলের দেশে।
তার পরের
ইতিহাস সবার
জানা, গ্রামীণ
জীবন-জীবিকায়
অন্যান্য উপাদানের
উপস্থিতি—যেমন
সবুজ বিপ্লব,
রাস্তাঘাট, মাইগ্রেশন—জমির
গুরুত্ব কমিয়ে
দেয়। এখন
গ্রামবাংলার গড়পড়তা
একটা খানার
প্রায় ৬০
ভাগ আয়
উৎসারিত হয়
খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড
থেকে; গ্রামীণ
ক্ষমতা কাঠামোয়
‘তুমি
মহারাজ সাধু
হলে আজ,
আমি চোর
বটে’ অবস্থা
দিনে দিনে
দুর্বল হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো,
ভূমি সংস্কার
কি এখনো
প্রাসঙ্গিক? হলে
কেন এবং
করণীয়ই-বা
কী?
এক. গত
৫০ বছরে
বাংলাদেশের ‘ব্যাপক’
উন্নয়ন ঘটেছে
সত্যি, তবে
উন্নয়ন কৌশলও
এক থাকেনি।
জাতিসংঘে কর্মরত
বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ
এম নজরুল
ইসলাম কৌশলগত
পরিবর্তন ও
পরিণাম নিয়ে
একটা প্রবন্ধ
পেশ করেছেন
এবিসিডি কনফারেন্সে।
বাংলাদেশের এ-যাবত্কালের
সার্বিক উন্নয়নে
তিনি সবার
মতোই আনন্দিত।
তবে তিনি
বলছেন, সফলতা
নিজেই নিজের
সমস্যা সৃষ্টি
করেছে। যেমন
বাংলাদেশে তির্যক
বৈষম্য বাড়ছে,
অতিরিক্তভাবে উন্নয়ন
ঢাকার ওপর
নির্ভরশীল, কমিউনিটি
স্বার্থ উপেক্ষিত,
পরিবেশ বিপর্যস্ত
ও গুরুত্বপূর্ণ
নীতিনির্ধারণে দেশটি
পরমুখাপেক্ষী। এ
পরিপ্রেক্ষিতে নজরুল
ইসলাম মনে
করেন, অতীতের
মতো উন্নয়ন
কৌশলে গ্রাম
ও দরিদ্র,
কমিউনিটি ও
পরিবেশ এবং
স্বনির্ভর হওয়ার
স্বপ্ন এখনো
প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক।
তবে এ
উন্নয়ন কৌশল
সেই উন্নয়ন
কৌশল নয়।
আপাতদৃষ্টে ‘এই’
আর ‘সেই’-এর
বিভাজনরেখা ১৯৭৫
সালে যখন
বঙ্গবন্ধু ও
তার পরিবারকে
নির্মমভাবে হত্যার
পর বল্গাহীন
পুঁজিবাদের তথা
আনফেটারড ক্যাপিটালিজমের
দিকে বাংলাদেশকে
টেনে নেয়ার
প্রক্রিয়া শুরু
হয়। নতুন
এ কৌশল
ধনীবান্ধব, শহুরে
জনগণের প্রতি
বেশি মাত্রায়
সংবেদনশীল, সম্প্রদায়ের
স্বার্থের চেয়ে
ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্য
এবং বৈদেশিক
সাহায্যনির্ভর। প্রথমত,
যে পথে
বাংলাদেশ কৃতিত্বের
পথে এগিয়েছে,
সেটা বাংলাদেশের
শুরুতে অনেক
অর্থনীতিবিদের দেয়া
উপদেশের উল্টো।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ব
পরিস্থিতি সাপেক্ষে
বাংলাদেশের সফলতার
চালিকাশক্তি বদলে
যায়; যা
প্রাথমিক পর্যায়ে
প্রক্ষেপণ করা
সম্ভবপর হয়নি;
সুতরাং বিষয়টা
এই নয়
যে প্রথম
দিককার কৌশল
নির্মাতারা ‘অন্ধ
দাগ’ দেখতে
ব্যর্থ হয়েছেন,
বরং এমন
অন্ধ দাগের
অস্তিত্বই তখন
ছিল না।
তৃতীয়ত, যদিও
প্রাথমিক পর্যায়ে
সুপারিশকৃত কৌশল
গ্রহণ কিংবা
বাস্তবায়ন করা
হয়নি, তদুপরি
উদীয়মান বর্তমান
প্রজন্মের সমস্যার
পরিপ্রেক্ষিতে তা
এখনো প্রযোজ্য—যে
সমস্যা সমাধান
করে বাংলাদেশকে
সামনের দিকে
পা বাড়াতে
হবে।
আজ থেকে
৫০ বছর
আগে মূলত
গ্রামীণ অর্থনীতি
হিসেবে যাত্রা
বাংলাদেশের, যখন
৮০ শতাংশ
মানুষ গ্রামে
বাস করত
এবং জিডিপির
৬০ শতাংশ
আসত কৃষি
খাত থেকে।
সুতরাং বলা
বাহুল্য, সেই
সময়কার বাংলাদেশের
উন্নয়নের মানে
ছিল গ্রামীণ
উন্নয়ন। উদ্বিগ্নের
উৎস ছিল
কীভাবে স্ফীত
জনগোষ্ঠীর জন্য
কর্মসংস্থান ও
আয়ের বন্দোবস্ত
করা যায়।
তবে এই
প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের
উত্তর পেতে
এক ধরনের
ঐকমত্য সাধারণত
বিরল যদিও,
তবে সত্তরের
দশকের বাম-ডান,
মধ্যম অর্থনীতিবিদদের
মধ্যে বাস্তবে
বিরাজমান ছিল।
ঐকমত্যের ব্যাপারে
উদাহরণ হিসেবে
নজরুল ইসলাম
বিভিন্ন মতামত
তুলে ধরলেন।
যেমন জাস্ট
ফাল্যান্ড ও
জে পারকিনসন
কর্মসংস্থান ও
আয় নিশ্চিতকরণে
ভূমি পুনর্বণ্টন,
এমনকি ছিনিয়ে
নিয়ে হলেও,
ব্যতীত পথ
বাদলাতে পারেননি।
অবশ্য দ্বিতীয়
চিন্তায় জনসংখ্যা
বৃদ্ধি সাপেক্ষে
পুনর্বণ্টনের অব্যাহত
পুনরাবৃত্তি তারা
বিকল্প হিসেবে
উপস্থাপন করলেন—রাষ্ট্র
কর্তৃক সব
জমি অধিগ্রহণ
অপেক্ষাকৃত ভালো
সমাধান। আর
তখন রাষ্ট্রের
অথবা কমিউনিটির
ব্যবস্থাপনায় কমিউনাল
চাষাবাদ নীতিগতভাবে
কর্মসংস্থান সৃষ্টি
করতে পারে।
পরিকল্পনা কমিশনের
প্রথম ডেপুটি
চেয়ারম্যান প্রফেসর
নুরুল ইসলাম
ভূমি সংস্কার
নিয়ে অনেকটা
একই রকম
উপসংহারে উপনীত
হয়েছিলেন—‘some kind of common ownership
or management of land would provide an effective means of sharing employment
and income…may in a way be conceived as a method of generalizing the extended
family system, prevalent in rural Bangladesh to the entire village.’
অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার
পর গ্রামীণ
উন্নয়নের রাজনৈতিক
অর্থনীতির অথরিটি
আবু আব্দুল্লাহও
প্রথম দিকে
ভূমি সংস্কারের
পক্ষে মত
দিলেও এক
পর্যায়ে মত
বদলান—‘a radical redistribution of
land on the basis of private peasant property cannot by itself solve the
problems of development and in some cases, it can aggravate them…Thus it is to
some form of communization that we must look for a solution to our agrarian
problem.’
মহিউদ্দিন আলমগীর
মার্ক্সীয় ধারায়
উপসংহার টানলেন—The
objective conditions prevailing in Bangladesh indicate that the long term well
being of the majority of the population lies in collective ownership and use of
all resources. In other words, the oppressed people, i.e., the direct
producers, must take control of the means of production.
পেপানেক জমির
মালিকানা দুই
একরে নামিয়ে
সিলিং নির্ধারণের
মতো বৈপ্লবিক
ভূমি সংস্কার
প্রস্তাব করলেন,
যদিও তার
সন্দেহ ছিল
এটা আদৌ
যথেষ্ট কিনা।
তার ধারণা,
স্ফীত জনসংখ্যার
মুখে এ
সুপারিশ সময়ক্ষেপণ
মাত্র, যার
অন্তর্গত অর্থ
জমির কমিউনাল
মালিকানা ও
ব্যবস্থাপনার দিকে
ইঙ্গিত করে।
নজরুল ইসলাম
মনে করেন,
জমির কমিউনাল
মালিকানা ও
ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত ঐকমত্যের
‘উল্লেখযোগ্য’
দিক হচ্ছে
এই যে
এখানে সব
মত ও
পথের অর্থনীতিবিদ
সুপারিশ রেখেছিলেন।
ফাল্যান্ড ও
পারকিনসন বিশ্বব্যাংকে
এবং পেপানেক
ইউএস এইডে
কাজ করতেন।
আদর্শগত দিক
থেকে তাদের
অবস্থান ডানে।
প্রফেসর নুরুল
ইসলামের অবস্থান
মাঝামাঝি (কেন্দ্রে),
আবু আব্দুল্লাহ
বাম দিকে
কাত বেশি
আর মহিউদ্দিন
আলমগীর কট্টর
মার্ক্সবাদী।
যা-ই
হোক, নজরুল
ইসলামের মতে,
অর্থনীতিবিদরা যখন
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণপূর্বক
ভূমির কমিউনাল
মালিকানায়/ব্যবস্থাপনায়
আস্থা রাখছিলেন,
ঠিক তখন
বঙ্গবন্ধু প্রায়
একই ধারণা
নিয়ে এলেন
তার রাজনৈতিক
দৃষ্টিকোণ থেকে। স্বাধীনতা
ঘোষণার চতুর্থ
বার্ষিকীতে (মার্চ
২৬, ১৯৭৫)
তিনি তার
‘দ্বিতীয়
বিপ্লব’ সম্পর্কে
যৌথ চাষের
ভিত্তিতে গ্রামীণ
সমবায় মূল
অর্থনৈতিক ধারণা।
বাংলাদেশের শুরুতে
প্রস্তাবিত উন্নয়ন
দর্শন ও
প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন
হয়নি, বরং
দেশটি একটা
ভিন্ন কৌশল
নিয়ে সামনে
এগিয়েছে। পরিণতিতে
পরিবেশ বিপর্যস্ত,
বৈষম্য বৃদ্ধি
এবং সুখে
আছে সবাই
কিন্তু শান্তিতে
নেই। টেকসই
উন্নয়ন আজ
সোনার হরিণ।
আজ বঙ্গবন্ধুর
আমলের সেই
কৌশলের কিছুটা
হলেও প্রয়োজন
অনুভব করে
দেশ—কাদম্বিনী
মরিয়া প্রমাণ
করিল সে
মরে নাই।
আব্দুল বায়েস: অর্থনীতির অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন শিক্ষক