জাহাজভাঙা শিল্প

আর্থিক সংকটে বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে গ্রিন শিপইয়ার্ড প্রকল্প

দেবব্রত রায়, চট্টগ্রাম ব্যুরো

দেশের শিল্প খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিপূর্ণ খাত হিসেবে পরিচিত জাহাজভাঙা শিল্প। গত এক দশকে খাতেই শ্রমিক মারা গেছেন ১৫৬ জন। শোভন কর্মপরিবেশ না থাকা, শ্রমিক মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় দেশের শিপইয়ার্ডগুলোকে গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তরের নির্দেশনা দেয় হংকং কনভেনশন। শিপইয়ার্ডগুলোকে দ্রুত গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তরিত না করা হলে বাংলাদেশে স্ক্র্যাপ জাহাজ পাঠানো বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিদেশী বিক্রেতারা।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যেসব দেশ স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করবে তাদের ইয়ার্ডগুলোকে গ্রিন ইয়ার্ড বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। কিন্তু দেশের শিপইয়ার্ড আধুনিকায়নে আর্থিক ব্যয় নিয়ে বড় সংকটে আছেন দেশের ইয়ার্ড মালিকরা। সরকারি প্রণোদনা ছাড়া সবার পক্ষে গ্রিন ইয়ার্ড বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন তারা।

বিএসবিআরএ শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রায় ১৫০টি শিপ ইয়ার্ড নিবন্ধিত আছে। তবে মাত্র ৪০টির মতো শিপইয়ার্ড তাদের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দ্য শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং রুলস ২০১১, আন্তর্জাতিক আইন এবং ২০০৯ সালের চীনে অনুষ্ঠিত হংকং কনভেশন রুলস অনুযায়ী আমূল ঢেলে সাজানো হচ্ছে শিপইয়ার্ডগুলো। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সব শিপব্রেকিং ইয়ার্ড হংকং কনভেনশন সার্টিফিকেশন রুলস অনুযায়ী গ্রিন শিপইয়ার্ডে রূপান্তরিত করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

গত বছরের ১৪ নভেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী এখন পর্যন্ত খাতের ৮৫টি প্রতিষ্ঠান গ্রিন ইয়ার্ড বাস্তবায়নে শিপ রিসাইক্লিং ফ্যাসিলিটি প্ল্যান (এসআরএফপি) শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো শিল্প মন্ত্রণালয়ের গ্রিন ইয়ার্ড প্রকল্পের কাজ শুরুর অনুমোদন পেয়েছে। ৮৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এসএন করপোরেশন, কবির স্টিল, কেআর স্টিল, জান্নাত স্টিল লিমিটেড, ম্যাক করপোরেশন, জিরি সুবেদার শিপ ইয়ার্ড, আরেফিন এন্টারপ্রাইজ, প্রিমিয়াম ট্রেড করপোরেশনসহ প্রায় ১০টি প্রতিষ্ঠান হংকং কনভেনশন অনুযায়ী শিপইয়ার্ড আধুনিকায়নে কাজ শুরু করেছে। তবে কবির স্টিল তাদের শিপইয়ার্ড গ্রিন শিপ ইয়ার্ডের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো তাদের প্রাথমিক কাজই শুরু করতে পারেনি।

গ্রিন শিপইয়ার্ড বাস্তবায়নে শিপ রিসাইক্লিং ফ্যাসিলিটি প্ল্যান (এসআরএফপি) শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হয়। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে কাজ শুরু করতে পারে ইয়ার্ডগুলো। সেক্ষেত্রে বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যারা গ্রিন শিপইয়ার্ড নির্মাণের দেখভাল করে যেমন ভারতীয় প্রতিষ্ঠান আইআরএফ, জাপানি প্রতিষ্ঠান এনকেএ, ইতালীয় প্রতিষ্ঠান রিনার, জার্মানির জিএসআর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ করতে হয়।

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সহকারী সচিব নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, হংকং কনভেনশন সার্টিফিকেশন রুলস অনুযায়ী শিপইয়ার্ডগুলোকে গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তর করতে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের শিপইয়ার্ডগুলোকে আধুনিকায়ন এবং শোভন কর্মপরিবেশ তৈরিতে নতুনভাবে প্রক্রিয়াকরণ করতে হবে। নয়তো ভবিষ্যতে স্ক্র্যাপ জাহাজ বাংলাদেশে আর আসবে না।

জাহাজমালিকরা বলছেন, জাহাজভাঙা শিল্পের রমরমা আর আগের মতো নেই। কয়েক বছর আগেও ১৫০টি শিপইয়ার্ড সক্রিয় থাকলেও এখন মাত্র ৪০টির মতো ইয়ার্ড নিয়মিত কাজ পাচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ইয়ার্ড কাজ করছে সাব কন্ট্রাক্টে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ২০টি প্রতিষ্ঠানের হাতে জাহাজভাঙা শিল্প ঘোরাফেরা করছে। এদিকে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানিতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ইয়ার্ডগুলো। অন্যদিকে যারা ব্যবসায় ফিরতে চাচ্ছেন তাদের পক্ষে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে গ্রিন ইয়ার্ড বাস্তবায়নে বিনিয়োগ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে গ্রিন ইয়ার্ড নির্মাণে সরকারের প্রণোদনা চান খাতের ব্যবসায়ীরা।

আর্থিক বিষয়টি স্বীকার করে আরেফিন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হোসাইনুল আরেফিন বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের শিপ ইয়ার্ডটিকে গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তরিত করার জন্য প্লানের অনুমোদন শিল্প মন্ত্রণালয় দিয়েছে। জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ শুরু করেছি। কিন্তু আমার ইয়ার্ডটি ছোট হলেও গ্রিন ইয়ার্ড পূর্ণাঙ্গ সম্পূর্ণ করতে অন্তত ২০ কোটি টাকা প্রয়োজন। অন্যদিকে ব্যাংকের ইন্টারেস্ট হার বেশি থাকায় আমরা আর্থিক বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।

কয়েক দশক ধরেই জাহাজভাঙা শিল্পে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। পরিবেশের ক্ষতি, দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া, শোভন কর্মপরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হওয়াসহ নানা কারণে খাতের দুর্নাম বেশি। এসব বিবেচনা করে হংকং কনভেনশন অনুযায়ী দেশের শিপইয়ার্ডগুলোকে বাধ্যতামূলক গ্রিন ইয়ার্ড নির্মাণের নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু ইয়ার্ডভেদে ২০ থেকে ৫০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে পুরনো ইয়ার্ডগুলোকে গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তরিত করতে। তবে অর্থ খরচের বিষয়টি ইয়ার্ডমালিকদের জন্য বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন