ফ্লাইটেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বিদেশগামী কর্মীরা

বিমানবন্দরে অব্যবস্থাপনা দ্রুত দূর হোক

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালক প্রবাসী শ্রমিক। প্রবাসে শ্রম নিয়োজন করে তারা দেশে পাঠাচ্ছেন রেমিট্যান্স। চাঙ্গা হচ্ছে অর্থনীতি, স্ফীত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এমনকি করোনার অভিঘাত-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেও তারা রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। অথচ তারাই আজ বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াগত জটিলতায় বিমানবন্দরেই বিদেশগামী কর্মীদের কাটাতে হচ্ছে দীর্ঘ সময়। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে খেতে হচ্ছে বিমানবন্দর এলাকার অস্বাস্থ্যকর খাবার পানীয়। এতে ফ্লাইট চলাকালে উড়োজাহাজেই অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আবার কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন গন্তব্যে গিয়েই। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত কাতার দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বলে খবর মিলছে। বিষয়টি গভীরভাবে আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত সচেষ্টতা জরুরি। এক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে যেমন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে; তেমনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকেও (বেবিচক) বিরাজমান অব্যবস্থাপনা দূর করতে নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা।  

মহামারীর প্রাদুর্ভাব সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশী শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বহির্বিশ্বে আমাদের শ্রমিকদের চাহিদাই এখন সবচেয়ে বেশি। তবে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় আমরা চাহিদা অনুপাতে শ্রমিক পাঠাতে পারছি না। করোনার মধ্যে অনেক দিন চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ। ফলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওপর বিদেশগামী যাত্রীদের বাড়তি চাপ পড়েছে। তার মধ্যে আবার সংস্কারকাজের জন্য সেখানে রাত ৮টার পর ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখা হচ্ছে। এতে সৃষ্টি হয়েছে শিডিউল বিপর্যয়, একই সঙ্গে দিনে যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগে। যাত্রার ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষা করতে হচ্ছে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের। আবার বিমানবন্দরে প্রবেশের সময়ও লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। বাড়তি যাত্রীর চাপে করোনা সনদ পরীক্ষা, বোর্ডিং কার্ড ইমিগ্রেশনেও লম্বা লাইন। অবস্থায় ফ্লাইট ধরতে পারবেন না, এমন আতঙ্কে বিদেশগামী কর্মীদের বেশির ভাগই বিমানবন্দরে আসছেন যাত্রার ১০-১২ ঘণ্টা আগে। আর্থিক সংগতি না থাকায় অপেক্ষার দীর্ঘ সময়ে তারা অস্বাস্থ্যকর খাবার পানীয় গ্রহণে বাধ্য হচ্ছেন। সব মিলিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তারা।

দেখা যাচ্ছে বিদেশগামী যাত্রীদের থাকা-খাওয়ার ওপর নির্ভর করে বিমানবন্দর এলাকায় গড়ে উঠেছে জমজমাট আবাসিক হোটেল রেস্তোরাঁ ব্যবসা। সেগুলোর বেশির ভাগই মানুষের চাপে হিমশিম খাচ্ছে। অন্য জায়গায় যেন না যান তাই আগেভাগে গ্রাহকদের খাবার সরবরাহ করাই মুখ্য এসব রেস্তোরাঁ কর্মীর কাছে। ফলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যকর এসব শব্দ তাদের কাছে একেবারে গৌণ। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী প্রায় সব হোটেলেই জার থেকে গ্রাহকদের খাবার পানি দেয়া হচ্ছে। ওই পানি আবার সংগ্রহ করা হচ্ছে আশপাশের ওয়াসার পাম্পগুলো থেকে। যে জারগুলোয় পানি ভরে আনা হয়, সেগুলোও ভয়াবহ মাত্রায় অপরিচ্ছন্ন। এটা একটা দিক। আরেকটা দিক হলো, বিমানবন্দর মোড় এলাকাজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণকাজ চলছে। আর এর ধুলা-ময়লা গিয়ে পড়ছে রেস্তোরাঁর খাবারে, যা অসুস্থতার কারণ হচ্ছে বিদেশগামী যাত্রীদের।

বলা হচ্ছে, যেসব শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তাদের মধ্যে ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, বমি কলেরাজনিত রোগের লক্ষণ বেশি দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে দুটি দেশ নিয়ে তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে। ধরনের লক্ষণ আরো বেশি দেখা দিলে সাময়িক বাজার বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে তারা। শুধু ওই দেশ দুটি নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই এতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ব্যাপারে অনাগ্রহ তৈরি হতে পারে। আর তেমনটি হলে আমাদের বৈদেশিক শ্রমবাজারে এর অভিঘাত হবে বিপর্যয়কর। কাজেই বিষয়টিকে নীতিনির্ধারকদের বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দিতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের করণীয় ঢের। এখতিয়ারগতভাবে বিমানবন্দর এলাকার হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা নজরদারি করার দায়িত্ব ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ওই এলাকার রেস্তোরাঁগুলো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খাবার প্রস্তুত পরিবেশন করছে কিনা, পানির গুণগত মান ঠিক আছে কিনা, সেটি দেখতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তদারক করতে হবে। ধরনের উদ্যোগ অবশ্য এরই মধ্যে চলমান বলে খবর মিলছে। এটা আরো বাড়াতে হবে। অনিয়ম পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা।

দুই দেশের পক্ষ থেকে চিঠি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তত্পর হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে বিষয়টি অবগত করেছে। নিয়ে একটা বৈঠকও হয়েছে। সেখানে কিছু দিকনির্দেশনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এখন থেকে যারা বিদেশ যাবেন, তারা বাংলাদেশ থেকে খাবার নিতে পারবেন না। আজকে যে বিদেশগামী কর্মীরা ফ্লাইটে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তার একটা দায় অবশ্যই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের আছে। দায় তারা এড়াতে পারে না। মূলত দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে দীর্ঘ সময় যাত্রীদের কাটাতে হচ্ছে বিমানবন্দরে, রাত কাটাতে হচ্ছে টার্মিনালে। ফলে তাদের খেতে হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর খাবার পানীয়। কাজেই যাত্রীদের দুর্ভোগ নিরসনে বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে চালাতে হবে নানা সচেতনতামূলক প্রচারণা। পুষ্টিবিদরা বলছেন, ভালো মানের রুটি কলার সঙ্গে বোতলজাত পানি শরীরে যেমন শক্তি জোগাবে, তেমনি খরচও হবে কম। কাজেই বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে বেবিচকের আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

অতিমারীর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশী শ্রমিকের যে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি ইতিবাচক। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। তবে এর মধ্যে বিদেশগামী কর্মীদের অসুস্থ হয়ে পড়ার বিষয়টি নতুন করে কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে সেখানে। সুতরাং বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তথা সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন